বেলঘরিয়া অভিমুখ প্রযোজিত নাটক ‘এক মানুষ, ছাই’। বিনোদ ঘোষালের একটি ছোট গল্প অবলম্বনে লেখা নাটকটি সম্পাদনা ও নির্দেশনা করেছেন অশোক মজুমদার। এটি একটি প্রতীকী নাটক, অভিনয় অংশে মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনের অসঙ্গতি, অসারতা ও অসহয়তাকে তুলে ধরে। নাটকের মূল উপাখ্যান আবর্তিত হয় একটি যুবককে ঘিরে। মৃত্যুর পরে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকে যুবকটি তার ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকায়, আর বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে যে কেন এবং কী পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে, পরিত্রাণের শেষ উপায় হিসেবে, তাকে আত্মহত্যার মতো একটা চরম সিদ্ধান্ত নিতে হল! চরম দারিদ্র্যের পীড়া, প্রেমে ব্যর্থতা, একাকীত্ব, পরিবারের সদস্যদের তীব্র হতাশা – শেষ পর্যন্ত সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটে মৃত্যুতে।
এই নাটক দেশের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের গতানুগতিকতা ও অসারতাকে তুলে ধরে। কিন্তু তবুও এই ব্যর্থতা, একাকীত্ব, নৈরাশ্য, বা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের প্রতিচ্ছবি, উপস্থিত দর্শকদের আবেগকে স্পর্শ করতে পারে না। এর মূল কারণ হল নাটকের প্রেক্ষাপটের সময় কাল, যা বর্তমান সময়ের দর্শকরা বহুদিন আগেই পার করে এসেছেন! অতীতকালে উঁকি দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম ও ব্যর্থতার কাহিনীর রসগ্রহণ করা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক ভাবে সম্ভব; কিন্তু সেই একই কাহিনীর থিয়েটার মাধ্যমের কাছে দাবী অন্যরকম। থিয়েটারে দর্শকের সঙ্গে অভিনেতার ঘটমান সময়ে (real time) সংযোগ স্থাপিত হয়। এই সংযোগ কাহিনীর উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা এই নাটকে একেবারেই উপেক্ষিত।
Previous Kaahon Theatre Review:
এই নাটকের সময়কাল ষাটের দশকের শেষ বা সত্তরের দশকের শুরু, যখন বাংলার সমাজ ডুবেছিল কঠিন ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধের অনুশাসনে, সঙ্গী ছিল চরম বেকারত্ব আর রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের জোয়ার বাংলায় এসে পৌঁছলে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রচুর পরিবর্তন আসে, আর তার সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, যন্ত্রণা ও ভোগান্তির নতুন দিগন্ত ও খুলে যায়। নাটকের বক্তব্য কাহিনীর সময়কাল অতিক্রম করে চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে না। বাঙালির প্রিয় নস্টালজিয়া বা স্মৃতিমেদুরতার মধ্যেই আটকে থাকে। পুরোনো সময়কে আঁকড়ে থাকার এই অভ্যাস বাঙালিকে সহজে নতুন কিছু গ্রহণ করতে বা বর্তমান সময়কে নিয়ে কাটা ছেঁড়া করতে চিরকাল বাধা দিয়ে এসেছে। বিশ্বায়নের ফলে উদ্ভূত তথাকথিত এই সমৃদ্ধ সময়ে বিপন্নতাকে চিহ্নিত করা এবং তা নিংড়ে শিল্প সৃষ্টি করা অবশ্যই কষ্টসাধ্য, আর বর্তমানের বাঙালি সেই কঠিন শ্রমে আগ্রহী নয়। এই প্রবণতাটা নাটকে খুব পরিষ্কার করেই প্রতিফলিত হয়েছে।
বর্তমান সমাজে বেছে নেওয়ার মতো বিকল্পের বাহুল্যের কারণে এক ধরণের choice paralysis বা বাছাই-বৈকল্য তৈরি হয়, যাতে করে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর মানুষের ভাল থাকা, দুইয়েরই গুরুত্ব কমে যায়। এর থেকে তৈরি হয় FOMO (Fear of Missing Out) বা পিছিয়ে পড়ার ভয়। এই নতুন বিষয়টি সম্প্রতি মিডিয়ার নজরে এসেছে, এবং একেই এখন কমবয়সীদের মানসিক শান্তিভঙ্গের একটা প্রধান কারণ হিসেবে মেনে নেওয়া হচ্ছে, যা থেকে অনেক সময় আত্মহত্যার প্রবণতা আসছে। বর্তমান বিশ্বে ব্যক্তিপরিচয় যে ভাবে আক্রান্ত, তাতে করে ভয়, উদ্বেগ, আর নিরাপত্তাহীনতা হয়েছে নিত্যসঙ্গী। আলোচ্য নাটকটি কোন আধুনিক সঙ্কটের কথা বলে না। যথেষ্ট হতাশাজনক ভাবে আধুনিক সময়ের প্রতিফলন ঘটানোর কোন চেষ্টা করে না। অতীতবিধুর মেলোড্রামার মলমের মতো সহজ রাস্তা ছেড়ে কবে বাংলা নাটক সাবালক হয়ে উঠবে? আর কবেই বা বর্তমান সময়কে নিয়ে শিল্প ভাবনার কঠোর প্রচেষ্টা শুরু করবে?
এই নাটকের মঞ্চ ও আলোক ভাবনায় রয়েছেন যথাক্রমে জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দীপঙ্কর দে। এই দুই শিল্পীর ভাবনার আশ্চর্য সমাপতনের ফলে, নাটকের মূল চরিত্রের উপলব্ধির প্রবাহের প্রকাশের মধ্যে খুব যত্ন সহকারে উঠে আসে রোমান্টিকতার অনুরণন। এর মধ্যে একটি চিত্রকল্পে, যেখানে মূল চরিত্রটি পর পর রাখা কয়েকটি রাস্তার মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে (যেগুলি আসলে চরিত্রটির জীবনে সম্মুখীন হওয়া মৃত্যুর সংখ্যা নির্দেশ করে), একটি আলোক রশ্মি এসে মাইল ফলকগুলির উপর পড়ে। এইখানে দর্শক অনুভব করেন যে জীবন আসলে একটা যাত্রাপথ, প্রত্যেক মানুষকে অবিরাম সেই যাত্রা চালিয়ে যেতে হয়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে মঞ্চসজ্জা দায়সারা, যেমন পেইন্টিংগুলোর ব্যবহারের ক্ষেত্রে। উজান চ্যাটার্জীর পরিকল্পিত সঙ্গীত নাটকে আলাদা কোনো মাত্রা তো যোগ করেই না, বরং বিশেষ ক্ষেত্রে নাট্যরস গ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
নাটকটি আসলে একটি মনোলগ, যেটি অভিনয় করেন অনুজয় চট্টোপাধ্যায়। অনুজয় অভিনয়কলার প্রয়োগিক দিকটিতে যথেষ্ট ভাল, কিন্তু তার সেই ক্ষমতার একটু ঘাটতি আছে যা কিনা একা একজন দর্শককে নাটকের মধ্যে টেনে ধরে রাখতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষমতার ছাপ অনুজয়ের অভিনয়ের মধ্যে আছে; হয়ত এই নাটকের অন্য কোনো শোতে বা অন্য কোনো নাটকে তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে। কৌশানী মুখোপাধ্যায়ের ক্ষণিকের জন্য মঞ্চে আসা একে বারেই বিক্ষিপ্ত লাগে।
বর্তমান সময়ের দর্শকের কাছে নাটকটি তার প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ। এই কাহিনীটি ইতিপূর্বে বাংলা ভাষার সমস্ত শিল্প মাধ্যমেই বহুশ্রুত, তা সে সাহিত্যই হোক, বা সঙ্গীত, সিনেমা, থিয়েটার, যাই হোক। একবিংশ শতকের দর্শক এই নাটকের নতুন ব্যাখ্যা দাবি করে।আশা করতে দোষ নেই যে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার সঙ্কটগুলো অন্তত একবারের জন্য হলেও বাংলা নাটকে উঠে আসবে, এবং জীবনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস যোগাবে।
বাংলা অনুবাদঃ অঞ্জন নন্দী