গত ২০শে আগষ্ট আকাদেমি মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল থিয়েটার ওয়ার্কশপের নবতম প্রযোজনা ‘দীর্ঘদিনদগ্ধরাত’ নোবেল জয়ী মার্কিন নাট্যকার ইউজিন ও’নিলের পুলিৎজার পুরষ্কারপ্রাপ্ত নাটক ‘Long day’s journey into night’ অবলম্বনে নাটকটি লিখেছেন বিশিষ্ট নাট্যকার চন্দন সেন, নির্দেশনায় অশোক মুখোপাধ্যায়।
একটি সম্পূর্ণ দিন ও রাতের পরিসরে এক পরিবারের চারজন মানুষের গল্প। গৃহকর্তা দীপেশ সান্যাল অতীত দিনের বাংলা থিয়েটারের জনপ্রিয় অভিনেতা, তার স্ত্রী সুচরিতা শারীরিকভাবে অসুস্থ ও মানসিক অবসাদগ্রস্ত, সঙ্গে জীবনে প্রতিষ্ঠা না পাওয়া সাংবাদিক ছেলে রূপেশ, এবং বৈবাহিক সম্পর্কে ব্যর্থতার কারণে মানসিক বিপর্যস্ত মেয়ে বুলি। দত্ত পুকুরের মস্ত বাগানঘেরা পুরনো বাড়ি যেখানে তারা বাস করে, দীপেশ ও সুচরিতা চায় বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিতে, কারণ এখানে জড়িয়ে আছে পুরনো ঐতিহ্যের মোহ আর ভাঙা ইঁটের ফাঁকে ফাঁকে যন্ত্রণাও দীর্ঘশ্বাস। রূপেশ ও বুলি চায় বাড়ি প্রোমোটিং করে নতুন দিনের আলো খুঁজতে। প্রবীন ও নবীনের দ্বন্দ্বে এগিয়ে চলে কাহিনী। দীপেশের সাথে ছেলে মেয়ের সম্পর্ক একদম ভালো নয়। স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক আপাত দৃষ্টিতে দৃঢ় মনে হলেও, মানসিকভাবে বেশ নড় বড়ে। প্রত্যেকের অতীতই বেশ যন্ত্রনাদায়ক, তার ছায়া বর্তমানে তাদের বিপর্যস্ত করে তোলে। এই পরিবারের বহুদিনের পরিচারিকা নির্মলাই একমাত্র কিছুটা সদর্থক চরিত্র, যিনি চারজনের জীবনেই কিছুটা শান্তির প্রলেপ দেবার চেষ্টা করেন। চার বছরপর হঠাৎ মধ্যরাতে হাজির হয় বুলির স্বামী বাসুদেব; বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত পরিবারটিকে নতুন করে আশার আলো দেখায় সে, প্রথম থেকে যে চরিত্রটিকে নেগেটিভ দৃষ্টি ভঙ্গিতে উপস্থিত করা হচ্ছিল শেষে এসে তাকে নাট্যকার ভবিষ্যতের আশাব্যঞ্জক আলোর কান্ডারী হিসাবে দেখালেন, বিপর্যয়ের ঘনকালো মেঘ চিরে একফালি সূর্যকিরণের মত আশার আলো নিয়ে নাটকের যবনিকা পতন হয়, যাকে বলা যায় Happy ending।
Previous Kaahon Theatre Review:
Kaahon Theatre Review
Taray Taray: Theatre of deep emotional connect
Read this review in English: https://t.co/hvccnztM7x#bengalitheatre | #theatre | #theatrereview | #kaahontheatrereview | #KaahonPerformingArts pic.twitter.com/elcGUXy4QA— kaahon (@kaahonwall) August 17, 2018
এই নাটকের প্রধান চারটি চরিত্রই ইউজিনের মূলনাটকের মতো নিজেদের দূর্বলতা বা ব্যর্থতা গুলো স্বীকার করতে চায় না, বরং তার দায় পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। তাদের এই আত্মবিভ্রম থেকেই নাটকের যাবতীয় তর্কবিতর্ক ও নাটকীয়তার উৎপত্তি। এই সংঘাত এড়াতে ইউজিনের প্রতিটি চরিত্রই খুঁজে নেয় নেশার উপকরণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তারা নিজেদের অতীতকে কাটাছেঁড়া করে, কখনও হয়ত পরস্পরের কাছে কিছুটা স্বস্তিদায়ক হয়ে ওঠে। এই মাত্রিকতা বজায় রাখার কোনও দায় বর্তমান নাট্যকার চন্দন সেনের নেই, তিনি বেছে নিয়েছেন একটা সাদামাটা গোল গল্প, যেখানে গৃহকর্তার ব্যক্তি জীবনের কিছু স্খলনই পরিবারের বা কি সদস্যদের জীবনে দুর্যোগ নিয়ে আসে। মূলনাটকের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে একটি অতি আরোপিত কৃত্রিম মিলনান্তক দৃশ্যে নাটক শেষ হয়। নাট্য ভাষার দিক থেকে এই নাটকের মিল আশি বা নব্বই এর দশকের গোড়ার দিকের মঞ্চ সফল নাটকগুলির সঙ্গে। জানা নেই চন্দন সেন নাটকটি ঠিক কোন সময়ে লিখেছিলেন, তবে বর্তমান সময়ে উপস্থাপনার জন্য আর একটু ভাবনা চিন্তার অবকাশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পটভূমিতে লেখা একটি নাটককে তিনি বাঙালী প্রেক্ষাপট, চরিত্রও পরিবেশ দ্বারা সম্পূর্ণ বাংলা নাটক হিসাবে লিখতে চেয়েছেন বটে, তবে পাশ্চাত্য খোলস ছেড়ে পুরোপুরি বেরোতে পারেননি, ফলে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তৈরী হয়েছে। একটি বাঙালি পরিবার, যতই সদস্যদের মধ্যে সদ্ভাবের অভাব থাকুক, হঠাৎ একদিন ঠিক করছে যে আজ সকলে মিলে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ইত্যাদি করে ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর চেষ্টা করবে – এই কষ্ট কল্পনার জন্য নাটকের শুরু থেকেই দর্শকদের সঙ্গে এক রকম বিচ্ছিন্নতা তৈরী হয়। হ্যালুসিনেশনের দৃশ্যটির কল্পনা ও অতি দুর্বল, একটি চরিত্র মঞ্চে আসে শুধুই দর্শককে কয়েকটি জরুরী তথ্য জানানোর প্রয়োজনে! অত্যন্ত বেশি সংলাপ নির্ভরতার ফলে নাটক কোথাও কোথাও ভারাক্রান্ত মনে হয় যা মনসংযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। পুরো নাটকের সংলাপেই একটা dated নাটকীয়তা লক্ষ্য করা যায়, ফলে দীপেশ মাঝে মাঝেই যখন তার অভিনীত নাটকের সংলাপ বলেন সেগুলি আলাদা করে কোনও ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করতে পারেনা।
অশোক মুখোপাধ্যায় তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দীপেশ চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন, তার দীর্ঘ সংলাপ উচ্চারণ ও চলাফেরার মধ্যে দিয়ে একজন দক্ষ ও সুঅভিনেতার প্রকাশ ঘটেছে, যদিও তার আচরণে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সেই ক্লান্তি কিন্তু অভিনীত চরিত্রের ক্লান্তি নয়, বরং বলা যায় দীর্ঘ অভিনয় জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছনোর ক্লান্তি। সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত তার সাবলীল অভিনয় দিয়ে সুচরিতা চরিত্রটি দাঁড় করিয়েছেন, লোকনাথ দে রূপেশ চরিত্রের পুষে রাখা অভিমান ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন, বুলি চরিত্রের একরোখা উচ্চকিত ভাবটি বিন্দিয়া ঘোষ সামান্য লাউড অভিনয়ের মাধ্যমে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে সংলাপের কৃত্রিমতার কারণে অভিনেতারা তাদের ক্ষমতার পূর্ণব্যবহার করতে পারেননি। নয়না সাহা নির্মলা চরিত্রের চাহিদা তার অভিনয়ের মাধ্যমে সঠিক ভাবে মিটিয়েছেন, তার গানের গলাটি বেশ সুন্দর। আর এদের পাশে সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসুদেবের অভিনয় বেশ দুর্বল লাগে। টেলিফোনিক সংলাপে অঙ্গিরা চরিত্রের কন্ঠটিও উচ্চকিত!
নীল কৌশিকের মঞ্চসজ্জা ভালো লাগে। পশ্চাদপটে আলো আঁধারি জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া আকাশের উঁকি বেশ অর্থবহ। মঞ্চ ও আলোর (বাদলদাস) যুগলবন্দি ভালো কাজ করেছে। মুরারী রায় চৌধুরীর সংগীত এই নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, প্রারম্ভিক সংগীতটি সুন্দরভাবে নাটকের মুডটি ধরে দিতে সাহায্য করে, লোকগানের সুর দুটিও বেশ ভালো লাগে। সুরঞ্জনা দাশগুপ্তের পোশাক পরিকল্পনায় আধুনিকতার ছোঁয়া বর্তমান সময়কে বোঝাতে সাহায্য করে। নীলাভ চট্টোপাধ্যায়ের নামাঙ্কনের ভাবনাটি চমৎকার, এরজন্যে তিনি বিশেষ প্রসংশার যোগ্য, যদিও সচরাচর নাট্য প্রযোজনার আলোচনায় এই বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে।
থিয়েটার ওয়ার্কশপের বিগত অনেক প্রযোজনা এমন উৎকর্ষতায় পৌঁছে ছিল যে, আজ বহু বছর পরও সেইসব কাজ আমাদের স্মৃতিতে সমানভাবে উজ্জ্বল। সেই কারণে তাদের নতুন প্রযোজনা সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহ ও আশা থাকে, কিন্তু এই প্রযোজনা সেই প্রত্যাশা একেবারেই পূরণ করতে পারল না। খুব সম্ভবত এর প্রধান কারণ হল একটি দুর্বল নাটকের নির্বাচন! আশা করব অদূর ভবিষ্যতে আমরা আবার শ্রদ্ধেয় অশোক মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে চিরন্তন নাট্য-অভিজ্ঞতা লাভ করব।