পশ্চিমবঙ্গ নাট্যমেলায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হল কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র প্রযোজিত নাটক ‘ধ্রুবপুত্র’। কলকাতার প্রত্যেকটি নাট্যমঞ্চের নিজস্ব কিছু চরিত্র আছে এবং এই চরিত্রটি প্রতিষ্ঠা পায় মূলত দীর্ঘদিন ধরে যে ধরণের দর্শকরা তাতে নিয়মিত নাটক দেখতে আসেন, তাদের উপর ভিত্তি করেই। যেমন কোন নাটকের দলের যদি সপ্তাহের মাঝখানে একটি দিন গিরিশ মঞ্চে নাটক উপস্থাপনা করার সুযোগ ঘটে, তবে নিতান্ত নিরুপায় না হলে, তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করেন না, কারণ কথিত আছে, শনিবার বা রবিবার বাদে গিরিশমঞ্চে দর্শক নাটক দেখতে আসেন না। তবে ‘ধ্রুবপুত্র’ মঞ্চস্থ হয় বুধবার, ২৯নভেম্বর ২০১৭। দর্শকের আসন ছিল প্রায় পূর্ণ। শুধুমাত্র বিনামূল্যে নাটক দেখার সুযোগের জন্য গিরিশমঞ্চের এই চরিত্রস্খলন ঘটেনি বরং এসম্ভব হয়েছে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের দীর্ঘদিনের নাট্যানুশীলনের প্রতি বাংলার মানুষের বিশ্বাস ও ভাল প্রযোজনার প্রত্যাশায়। তবে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র কি সেই লালিত আশা ও ভরসার যোগ্য সম্মান দিতে সক্ষম হল? এই আশাহত দর্শকের জবানবন্দী হবে নেতিবাচক এবং ক্রূঢ়।
Kaahon Theatre Review
NIRBHAYA – BRECHT AGAIN, WITH A TOUCH OF REVISIONISMhttps://t.co/RPCVpdsq34#bengalitheatre |#KaahonPerformingArts pic.twitter.com/72DKUI4Kg0— kaahon (@kaahonwall) October 23, 2017
পর্দা সরতেই দৃষ্টি-ছন্দের পতন ঘটল কম রিহার্সালে নির্মিত একটি কোরিওগ্রাফি দেখে। নবতম প্রযোজনা বলে সে ছন্দ পতন ক্ষমা করার মত দরদী মন এ দর্শকের থাকলেও, কোণের আসন পাবার জন্য দৃশ্যনির্মাণ ও বিন্যাসের অসামঞ্জস্য ক্ষমা করে দেওয়ার মত বড় মন এ দর্শকের নেই। অর্থমূল্যে কেনা সামনের দিকের সারিতে একটি কোণার সিটে বসে থাকা দর্শকের কথাও মাথায় রেখে নির্দেশক তার নাটকের দৃশ্য বিন্যাসের কেন্দ্র বা সেন্টার ঠিক করবেন সেটাই কাম্য।
একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে উজ্জয়িনী ও তার পার্শ্ববর্তী নগরের প্রেম, বিরহ, রাজকর্মচারীদের ঔদ্ধত্য, রাজদ্রোহিতা, লোভ, নৈতিক পতন ও সর্বোপরি জাতিভেদ নিয়ে অমর মিত্রের উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই নাটক। নাটক নির্মাণে রয়েছেন বাংলা নাটকের কিছু বিশেষ ব্যক্তিত্ব। নাট্যরূপ দিয়েছেন পরিচালক স্বয়ং কিশোর সেনগুপ্ত, মঞ্চ পরিকল্পনা হিরণ মিত্রের, আলো পরিকল্পনা করেছেন দীপক মুখোপাধ্যায়।
বিভিন্ন অনুষঙ্গে চিত্রিত একটি স্থায়ী ব্যাক ড্রপ এই নাটকের মূলমঞ্চ সজ্জার উপকরণ যা চিহ্নিত করে একটা নির্দিষ্ট সময় এবং স্থান, ধরা যাক নাটক অনুযায়ী সেটা প্রাক-বৌদ্ধ সময়ের উজ্জয়িনী নগরী। তাই তার ভেতরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার সময় এবং স্থান পরিবর্তন হওয়ার কথা আলো এবং অভিনেতাদের শরীরী ভাষার মাধ্যমে।আলো বদলালেও, স্থান পরিবর্তনের আভাস দর্শকদের কল্পনা করে নিতে হয় সংলাপের সূত্র ধরে, মঞ্চদৃশ্য সে আভাস দিতে ব্যর্থ হয়। মঞ্চ-ক্ষেত্র শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রই থেকে যায়, দর্শকদের কল্পনায় তা কখনই নদীর পার, ঘরের কোণ, রাজপথ বা বেশ্যালয় হয়ে ওঠে না। নাট্য-ব্যাকরণ বলে, উদ্দেশ্য ছাড়া মঞ্চে চোখের পলকটুকুও ফেলা যায় না। অভিনেতার প্রত্যেকটি শারীরিক সঞ্চালনাকে অনুসরণ করে দর্শকের মননে মঞ্চের এক একটি কোণ প্রাণ পায় একটি ‘স্থান’ রূপে। কিন্তু এই নাটকে দেখা গেল, অভিনেতারা সকলেই মঞ্চের বিভিন্ন অংশ বিনা কারণে ব্যবহার করছেন, কখনও সামনে তাকিয়ে পিছনে হাঁটছেন, যার জন্য কোন স্থানকেই কল্পনা করে নেওয়া যায় না এবং সব থেকে দুঃখের বিষয়, এই নাটকে কোন নাট্য-মুহুর্তই তৈরী হয়না। অভিনেতারা সংলাপ প্রক্ষেপনে যতটা কৌশলী, শরীরকে ব্যবহার করে দৃশ্য নির্মাণে ততটা নয়।
নাটক দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম। কিন্তু এ নাটকে প্রথম পর্বে দৃশ্যের প্রতি উদাসীন থেকে শুধু শুনে উপভোগ করা হয়তো যায়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে, চোখ খুললে, একটি অন্যায্য দৃশ্য সত্যিই মনকে বিচলিত করে। একটি গানের দৃশ্যে দেখা যায় শুদ্র-পল্লির একদল মানুষ মুসলমান ধর্মের মানুষদের মত হাত তুলে বৃষ্টি প্রার্থনা করছেন। শ্রেণী বৈষম্যও জাতি ভেদকে আঘাত করবার উদ্দেশ্যে নির্মিত এই নাটকে এরকম একটি দৃশ্য নাট্যকার ও নির্দেশকের অবস্থান সম্পর্কে সংশয়ের উদ্রেক করে নিশ্চিত ভাবে। যে সময় বৌদ্ধধর্ম তখনও আসেনি, ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব কি করে সম্ভব? নাট্যকার ও নির্দেশক যদি ধরে নেন যে বাংলার দর্শক ইতিহাস বিস্মৃত, তবে তা গুরুতর অপরাধ। উজ্জয়িনী বাংলায় অবস্থিত নয় এবং শুদ্র মানেই তারা সাঁওতাল নয়। তাই শুদ্রপল্লী বোঝাতে মানুষকে সাঁওতাল রূপে দর্শকদের সামনে আনতে হবে, এতটা সরলীকরণ একেবারেই কাম্য নয়। ভারতের জাতি প্রথার কারণ ও ব্যাপ্তি, তার বীভৎস রূপ অনেক জটিল এবং ইতিহাস নির্ভর। তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে, কিছু উচ্চবর্ণীয় শিক্ষিত মানুষের নিম্নবর্ণের মানুষদের নিয়ে অলীক কল্পনাকে উসকে দিয়ে কোন শিক্ষামূলক শিল্প সৃষ্টির প্রচেষ্টা প্রতিবাদযোগ্য।
এ নাটকের সংলাপ ও দর্শকদের মনে কোন প্রভাব তৈরী করে না, কারণ নাটকের আখ্যান কোন দ্বন্দ্ব তৈরী করতে পারেনা। রাজ কর্মচারীর ক্ষমতার অপব্যবহার, কুটনীতির চালে রাজ্য লাভ করে নিম্নবর্গীয় মানুষদের উপর অত্যাচার, এ সমস্ত জটিল দ্বন্দ্বের সমাধান অবলীলায় হয়ে যায় খুন অথবা শিক্ষাবাগীশ কিছু চরিত্রের সংলাপের মাধ্যমে। কোন সংঘাত তৈরিই হয় না। ফলত বাংলা ভাষার সুন্দর শব্দ গঠনে ঠাসা সংলাপের প্রাচুর্য্যে ধুঁকতে থাকে এই প্রযোজনা।
ইদানীং কালের বাংলা নাটকে গানের দৃশ্যে সিনেমার বিশেষ করে বলিউডের প্রভাব নতুন নয়। তবে এরকম ঐতিহাসিক নাটকের গানে বলিউডি প্রভাব সত্যিই এক হাঁসজারুর কথা মনে করিয়ে দেয়। এত গুণীজনের সম্মিলনে নির্মিত এ নাটকটি পরিশেষে মনের ঝুলিতে রাখার মত কোন উপহার দিতে সক্ষম হয় না- এটা দুঃখের।