বাংলা থিয়েটারের দর্শক ক্রম হ্রাসমান, কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও নতুন নতুন নাটকের দলগুলি আত্মপ্রকাশ করছে। এর অর্থ কি এই যে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত দলগুলি বদলে যাওয়া সময়ের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না? নাট্যমোদী দর্শকদের একটা বড় ক্ষোভের জায়গা কিন্তু এটাই যে বর্তমান বাংলা নাটকে ‘সমকাল’ সেভাবে উঠে আসেনা। হয়ত এই চাহিদা বা ক্ষোভের জায়গাগুলো থেকেই ‘টালিগঞ্জ সংশপ্তক’ দলটির জন্ম, আর তাদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘ডানা’-র প্রযোজনা – যে নাটকের ষষ্ঠ অভিনয় মঞ্চস্থ হইয়েছিল ২৩শে মার্চ, ২০১৯, তারিখে, কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটার রঙ্গালয়ে। আর দশম অভিনয় হল ৩রা আগস্ট, ২০১৯ তারিখে রবীন্দ্রসদন মঞ্চে। এই রিভিউ মূলত ষষ্ঠ অভিনয়ের উপর আধারিত। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনা কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের।
Previous Kaahon Theatre Review:
‘ডানা’ নাটকটির বিষয়বস্তু হল বর্তমানের দ্রুতগতির সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে সাধারণ মানুষের তার নিজস্ব পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া! বিষয়টি নতুন নয়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, ইউরোপীয় সমাজে পুঞ্জীভূত হতাশা ও ক্ষোভ থেকে জণ্ম নিয়েছিল এই ধরণের নাট্যভাষা, আর তার পর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দুনিয়ায়। আজ এত বছর পরেও সমস্যাগুলি প্রাসঙ্গিক থেকেই গেছে, বরং বলা যায় আরও জটিলই হয়েছে, তাই এই ধরণের নাটকের সঙ্গে দর্শকেরা এখনো সহজেই ঐকাত্ম অনুভব করতে পারেন। নৈরাশ্য, উদ্বেগ, ও আশঙ্কায় পরিপূর্ণ জীবনের এই চরম নিরর্থকতার ঘেরাটোপ থেকে একজন ব্যক্তি তখনই বেরিয়ে আসতে পারেন যখন তিনি এমন কোনও চূড়ান্ত বা নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত নেন যা মানুষ হিসেবে তার আত্মসম্ভ্রমকে পুনরুদ্ধার করতে পারে! নাটকটি এমনই এক চরিত্র গোপীনাথ, ওরফে গুপীর কথা বলে, বাল্যকাল থেকেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরাজয় যাকে তাড়া করে ফেরে, তা’ সে খেলাধুলার মঞ্চেই হোক বা নারীর প্রতি ভালবাসায়! বর্তমানে গোপীনাথ একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, সংসার ও কর্মক্ষেত্রের যুগপৎ জাঁতাকলে পিষ্ট। এই কোণঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়ে সে প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করে বসে! এই প্রতিস্পর্ধার কারণে দণ্ডিত হয় গোপীনাথ, কিন্তু পিছিয়ে আসেনা, কারণ সে জানে যে নিজের অস্তিত্বকে সার্থক করে তুলতে গেলে কোনও বিশেষ সামাজিক বা রাজনৈতিক অবস্থানে দৃঢ় থাকতেই হবে!
সমাজ ও সংসারের বিরুদ্ধে গোপীনাথের এই বিদ্রোহকে প্রতিষ্ঠা করতে নাট্যকার নির্দেশক কৌশিক আশ্রয় নিয়েছেন একটি রূপকের! রূপকটি সহজবোধ্য, তাই দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। নাটকের শুরুতেই একজন উদ্ভট চরিত্রের ‘নাট্যকার’ মঞ্চে ঢুকে পড়েন, কতকটা কথকের ভূমিকা নিয়ে তিনিই নাটকটিকে টেনে নিয়ে যান, আবার কখনো খুব সামান্য সময়ের জন্য কাহিনীতেও ঢুকে পড়েন। নাটকের শুরু থেকেই এই বিজাতীয় পরিমণ্ডলটি বজায় থাকায় রূপকের ব্যবহারটি আকস্মিক বলে মনে হয় না। এই পরিমণ্ডল তৈরির ভাবনার যথাযথ পরিপূরক হয়ে ওঠে নীল কৌশিকের মঞ্চ ও সৌমেন চক্রবর্তীর আলোক পরিকল্পনা। মঞ্চে অসম্পূর্ণ ইমেজের প্রয়োগ বহু ব্যবহারে জীর্ণ হলেও যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ; সিঁড়ির ব্যবহার ও সঙ্গত, যদিও কখনো কখনো তা’ নাট্যচলনকে মন্থর করে। উজান চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীতে পাশ্চাত্য ছোঁয়া, কিছুটা উচ্চকিতও, তবে নাট্যমুহুর্ত তৈরিতে সহায়ক। কোরিওগ্রাফি ও সুপরিকল্পিত, নৃত্যশিল্পীদের সমন্বয়ে, এবং পোশাক, মুখোশ, ও আবহ সঙ্গীতের যথার্থ সঙ্গতে দর্শকমনে বিশেষ ভাবনার সঞ্চার করতে সক্ষম। পলাশ কর্মকার অভিনীত নাট্যকার চরিত্রটির উচ্চারণরীতিও পরিচালকের নাট্য ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং চরিত্রটিতে পলাশ বিশেষ সংযম দেখিয়েছেন। তবে নাটকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে গোপীনাথ চরিত্রে সুঅভিনেতা প্রসেনজিৎ বর্ধনের দক্ষতার উপরে। বাচিক ও শারীরিক অভিনয়ের অনন্য মিশ্রণে তিনি চরিত্রটির অস্তিত্বের সংকটকে দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তবে তাকে সদাসতর্ক থাকতে হবে যাতে শারীরিক অভিনয়ের অতি-ব্যবহার নাটকের বিষয়বস্তুকে ভারাক্রান্ত না করে, এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠিটি যেন তার নিজের হাতেই থাকে, দর্শক চাহিদা যেন তাকে নিয়ন্ত্রণ না করে।চরিত্রের সংকটকে দর্শকমনে সঞ্চারিত করতে নাটকটি কিছুটা সফল হলেও কয়েকটি প্রশ্ন চিহ্ন রেখেই যায়! নাটকের চরিত্র ও ঘটনাগুলি বর্তমান সময়ের, কিন্তু তার একমাত্র প্রমাণ পাওয়া যায় সংলাপে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামোচ্চারিত হওয়ায়! চরিত্রচিত্রণে কোথাও পাওয়া যায় না সেই আধুনিকতার ছোঁয়া। গোপীনাথ, তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, অফিসের সহকর্মীরা, মনিব, সবকটি চরিত্রই যেন সেই তিরিশ বা চল্লিশ বছর পূর্বের বাংলা নাটকের ছেঁড়াপাতা থেকে উঠে আসা! অস্তিত্বের সংকট অবশ্যই চিরকালীন, কিন্তু নাটকে গোপীনাথের সংকটের পেছনে এমন কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, যা একান্তই এই সময়ের বিশেষত্ব! তার পরিবারের বাকি সদস্যদের সমস্যাগুলি ও সেই একই রকমের গতানুগতিক – সেই স্ত্রীর উদয়াস্ত পরিশ্রম, ছেলের চাকরি, মেয়ের বিয়ে, ইত্যাদি। নাটকের বহিরঙ্গেও রয়েছে এই সমস্যা, যেমন অফিসের যান্ত্রিকতা বোঝাতে ব্যবহৃত দৃশ্যটি ফাইল আর টাইপ রাইটারের মাইম-বাহুল্যে পৃক্ত! একি বাঙালীর সেই চিরকালীন স্মৃতি বিধুরতার হ্যাংওভার, নাকি বর্তমান সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য এড়িয়ে চলার প্রচেষ্টা, নাকি বর্তমান সময়ের বিপন্নতা চিহ্নিত করে তা’থেকে সার্থক শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে বাস্তবিক অপারগতা, এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়! অন্যদিকে আবার গোপীনাথের প্রাক্তন প্রেমিকা চন্দ্রাণীর সুদীর্ঘ উপস্থিতি এবং দুর্বল কাব্যের সোচ্চার প্রকাশ নাটকটিকে দীর্ঘায়িত এবং ক্লান্তিকর করে তোলে, আর ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর অনুরূপ দীর্ঘ দৃশ্যগুলি মনে পড়ায়। সব মিলিয়ে নাটকটি একটি মিশ্র অনুভূতি দেয় – অভিনব দৃশ্যভাবনা, সুনিয়ন্ত্রিত কোরিওগ্রাফি, মিউজিক ও আলোক সম্পাত, তদুপরি প্রসেনজিতের অভিনয়, সবকিছু মিলে নাটকটিকে গড়পড়তা নাটকের তুলনায় স্বতন্ত্র করে তুললেও, সমকালকে ছুঁয়ে দেখার প্রত্যাশাটি যথাযথভাবে পূরণ করতে পারে না!