বিগত সাড়ে তিন দশক ধরে কলকাতার নাট্য ক্যালেন্ডারে বর্ষশেষের নান্দীকার জাতীয় নাট্যোৎসব নাট্যমোদীদের কাছে বেশ বড় একটি ইভেন্ট। এবার ছিল এই উৎসবের চৌত্রিশ বছর (১৬ থেকে ২৫’এ ডিসেম্বর, একাডেমি অফ ফাইন আর্টস)। যখন প্রথম এই উৎসব শুরু হয়, নাট্যোৎসব বলতে পশ্চিমবাংলায় তো বটেই, গোটা দেশেও বিশেষ কিছুই ছিল না। সময় পাল্টেছে, আর তার সাথে যেটা ঘটেছে তা হল নাট্যোৎসবের একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণ– এখন দুর্গাপুজোর পরের কয়েক মাস ধরে ছোট, মাঝারী, বড় বেশ কয়েকটি নাট্যোৎসব হচ্ছে শুধু এই রাজ্যেরই নানা জায়গায়। আর এই সমস্ত নাট্যোৎসবের পথিকৃৎ নান্দীকার জাতীয় নাট্যোৎসবনানা ওঠা পড়া, প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে আজ’ও যে উপস্থাপিত হয়ে চলেছে তা নিঃসন্দেহে বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে। তবে যেহেতু এই উৎসব ঘিরে সাধারণ নাট্য-অনুরাগী মানুষের মত কাহনের প্রত্যাশা একটু হলেও বেশি, সেহেতু এবারের উৎসব নিয়ে কিছু কথা বলা আবশ্যক। উৎসবে আমরা দর্শক হসেবে কি পেলাম আর কি পেলাম না তা নথিবদ্ধ হয়ে থাকাটাও বোধহয় বিশেষভাবে জরুরী।
সবচেয়ে বড় না পাওয়ার বিষয় এটাই যে এবারের উৎসবে রাজ্যের বাইরের প্রযোজনার সংখ্যা হতাশাজনকভাবে কম। নান্দীকার উৎসব যে যে কারণে এখানকার থিয়েটার মহলে আকর্ষণ ও উত্তেজনা তৈরী করে এসেছে, তার অন্যতম হল এই উৎসবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নানা ধরণের নাটকের সাথে এখানকার দর্শকদের পরিচিতি ঘটানো। অনেকক্ষেত্রেই এই ভিন রাজ্যের নাটক শুধু যে দর্শককে আনন্দ দিত তাই নয়, এখানকার অনেক নাট্যকর্মীর কাছে সেসব নাটক হত শিক্ষার বিষয়। বাইরের নাটকের সংখ্যার এই হ্রাসপ্রাপ্তির কারণ হয়ত মূলত অর্থনৈতিক, কিন্তু কারণ যাই হোক ভিন রাজ্যের নাটকের অভাব এই উৎসবের জৌলুস যে অনেকখানি ম্লান করেছে তা বলার অবকাশ রাখে না। বাইরের নাটকের ঘাটতি দু’ভাবে মেটানোর প্রয়াস করেছেন নান্দীকার। এক, তারা নিজেদের বেশ কিছু কাজ পরিবেশন করেছেন; এমনকি তাদের একটি নাটক এই উৎসবে দু’বার মঞ্চস্থ করেছেন তারা। উৎসব মঞ্চ থেকে এই উৎসব শুরু করার পেছনে যে লক্ষ্যের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হল -অন্যদের এখানে এসে কাজ প্রদর্শনের সুযোগ করে দেওয়া– সেই লক্ষ্য থেকে নান্দীকার এবছর কিছুটা হলেও যে বিচ্যুত তা বলাই বাহুল্য। দুই, কলকাতা শহরের এই সময়ের, বলা যায় গত এক বছরের, কিছু মঞ্চসফল দর্শক-পাওয়া নাটক (যেমন,কোজাগরী, খড়ির গণ্ডী, বুকঝিম এক ভালোবাসা, নির্ভয়া ইত্যাদি) এই উৎসবে কলকাতাবাসীদের জন্য আবার হাজির করা হল। অনেকেই উৎসবে সেইসব নাটক দেখলেন যা তারা কিছুদিন আগে এমনিই দেখেছেন বা যা তারা ভবিষ্যতেও দেখতে পাবেন। উৎসব তো দৈনন্দিনের থেকে আলাদা হতে চাইবে –এক্ষেত্রে তা বোধহয় ঠিকমত হল না। দৈনন্দিনতা এভাবেও ছিল যে মানুষজন এলেন, টিকিট কাটলেন, নাটক দেখলেন, বাড়ি চলে গেলেন ঠিক যেমন তারা অন্য সাধারণ দিনে নাটক দেখতে এসে করে থাকেন। নাটক দেখার পাশাপাশি নাটক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা শোনা ও তাতে অংশগ্রহণ করা, নাট্যকার/নির্দেশক/অভিনেতাদের সাথে আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে তাদের নাটকের অভিজ্ঞতার ও ভাবনার কথা শোনা, নাট্যের আলো, মঞ্চ, পোষাক, মেক আপ নিয়ে বিশেষ আলোচনা (নাটকের বই পত্র-পত্রিকার দোকান, নাটক সংক্রান্ত ছবি ও ফিল্মের প্রদর্শনী, স্যুভেনির শপ- এসব নাহয় বাদই থাকল) – দর্শকেরা কিন্তু উৎসবে এসব চান, কারণ এগুলো না থাকলে উৎসবে নাট্য-উদযাপন পূর্ণতা পায় না। এই ধরণের আয়োজনে বোধহয় অর্থের ততটা প্রয়োজন থাকে না, যতটা থাকে ইচ্ছার ও দৃষ্টিভঙ্গীর।
নান্দীকার উৎসবে দেখা কিছু প্রযোজনার কথায় এবারে আসা যাক। এবারের উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যে নান্দীকার, যারা এতদিন প্রসেনিয়াম ছাড়া অন্য কোন স্থানে বা মঞ্চে তেমন লক্ষনীয়ভাবে কাজ করেন নি, তারাও অন্য পরিসরের থিয়েটার নিয়ে তাদের নতুন উৎসাহের কথা বললেন, কিছু ‘ইন্টিমেট’ নাটক’ও রাখলেন উৎসবে। কিন্তু যা আমাদের যুগপৎ বিস্মিত ও হতাশ করল, নান্দীকার ইন্টিমেট নাটকের ব্যবস্থা করলেন একাডেমির প্রসেনিয়াম মঞ্চে এবং প্রযোজকরাও অবলীলায় প্রসেনিয়াম মঞ্চে ইন্টিমেট নাটক অভিনয় করে গেলেন; আমরা মুগ্ধ হয়ে ব্যাডমিন্টন কোর্টে টেনিস খেলা দেখলাম। কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি লেখায় কাহন যে মন্তব্য করেছিল, এখানে তা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলে উদ্ধৃতি করা হচ্ছে –“…অনেকেই অন্তরঙ্গ ফর্মটি বেছে নিচ্ছেন যতটা না এই ফর্মের প্রতি নান্দনিক বা রাজনৈতিক আস্থার কারণে, তার চেয়ে বেশি পরিস্থিতির চাপে, যেমন প্রসেনিয়াম মঞ্চ না পেয়ে বা আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে। পরিস্থিতির চাপে অন্তরঙ্গ থিয়েটার করা যেতেই পারে, কিন্তু তা করতে হলে আঙ্গিকগতসেই থিয়েটার ফর্মের দাবীগুলো মেটানো অবশ্যকর্তব্য”। যে ইন্টিমেট নাট্য এই উৎসবে হলো তা আঙ্গিকগত দাবী মেটালো কি, এক পরিসরের জন্য নির্মিত কাজ অন্য পরিসরে নিজেকে মানিয়ে নিতেই হিমসিম খেলো। যেমন, আত্মিক প্রযোজিত বাতিল চিঠি নাট্যে অভিনেতা বাধ্য হলেন (দর্শকরা চেঁচামেচি করে বলার পরে) জোরে সংলাপ বলতে, যা এই নাট্যে-বিন্যাসের পরিপন্থী। এই নাট্যের একটা অত্যন্ত অর্থবহ অঙ্গ নাট্যের শেষে দর্শকদের হাতে হাতে খালি পোস্টকার্ড তুলে দেওয়া –অভিনয়ের স্থান বদলে যাওয়ায় দর্শকদের নাটক শুরুর আগে, হলে প্রবেশের সময় এই পোস্টকার্ড দিতে বাধ্য হতে হল; এতে গোটা প্রযোজনারক্ষতি ছাড়া অন্য কিছু হলো কি?
আমতা পরিচয় প্রযোজিত এলাদিদি নাট্যে একক অভিনেতার প্রশংসনীয় অভিনয়ে কোন কাজেই লাগলো না প্রসেনিয়াম মঞ্চের গভীরতা। দর্শকাসনের থেকে মঞ্চের উচ্চতা হলো অন্তরায়।অভিনেতামঞ্চের এপ্রনে থেকেই এবং কখনো কখনো দর্শকাসনের কাছে নেমে এসে অভিনয় করতে বাধ্য হলেন কারণ তার নাট্য দাবী করে দর্শকের সাথে একধরণের নৈকট্য। নান্দীকারের নিজস্ব প্রযোজনা মৃত্যুঞ্জয় তৈরী করল একটি গীতি আলেখ্য’র ভিস্যুয়াল – গান বাজনা যারা করলেন তারা চেয়ারে বসে স্ট্যান্ডিং মাইক ব্যবহার করলেন এবং অভিনেতা একজায়গায় বসে কলার মাইকে বললেন তার সংলাপ। এই প্রযোজনাটি কতটা নাট্য হয়ে উঠল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়ে গেল। দুর্বল টেক্সট ও দুর্বলতর পারফর্ম্যান্স সম্বলিত হ্যাপি বার্থডে প্রযোজনাটি আদ্যন্ত আত্ম-প্রশ্রয়পূর্ণ একটি কাজ, অন্তরঙ্গ পরিসরে না হওয়ার কারণে অভিঘাত তৈরী করার যে সামান্য সুযোগ কাজটির ছিল, তা’ও ফলপ্রসূ হল না। কি কারণে যে এইসব প্রযোজনাগুলি অন্তরঙ্গ স্পেসে (দু’পা হাঁটলেই তো তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহ) নিয়ে যাওয়া হল না তা অজানাই রয়ে গেল।
নান্দীকার সহ কলকাতার অনান্য পরিচিত দলের কাজগুলো সচেতনভাবেই এই লেখার বাইরে রেখে আমরা উল্লেখ করতে চাই সেই তিনটে কাজের কথা যা আমাদের মতে এই উৎসবের সেরা প্রাপ্তি। হায়দ্রাবাদের রঙ্গকল্পের নিবেদন তুমহারা ভিন্সেন্ট, শিল্পী ভ্যান গখের জীবনের ওপর আধারিত আরভিং স্টোনের বিখ্যাত উপন্যাস লাস্ট ফর লাইফ’এর নাট্যরুপ। নাটকটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক visual design। নানা রঙের আলোয় উজ্জ্বল মঞ্চ ভ্যান গখের ছবির বর্ণাঢ্য ঔজ্জ্বল্যে হাজির করে নাট্যের ভাষায়। প্রপসের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ একের পর এক ছবি তৈরী করে যা একজন ছবিকারের জীবনীর প্রেক্ষিতে অত্যন্ত সাযুজ্যপূর্ণ, যেমন সাটিনের সাদা কাপড় দিয়ে বরফে ঢাকা পাহাড়, ধোঁয়ার মধ্যে নীলচে আলোয় বোঝানো কয়লাখনি বা সকালের রোদমাখা হাওয়ায় দোলা মাঠভর্তি সূর্যমুখী। টেক্সটের প্রয়োজনে আলো ও প্রপসের সাহায্যে অর্থবহ দৃশ্যসৃজনে নির্দেশক সত্যব্রত রাউতের কল্পনাশক্তির যে উন্মেষ আমরা দেখলাম তা মনে রাখার মত। ভ্যান গখের মানসিক অস্থিরতা নির্দেশ করতে অতি চড়া মাত্রার অভিনয়ে এবং প্রধান চরিত্রকে সারাক্ষণ ছটফটানিময় দৌড়াদৌড়ির মধ্যে রাখায় সংযমের অভাব ছিল। একটা সময়ের পর মঞ্চের চরিত্রগুলো রক্ত মাংসের বাস্তব থেকে বড্ড দূরে সরে যাওয়া কল্পজগতের সত্তায় পরিণত হয়েছিল। পর্দায় দেখানো প্রখ্যাত ফরাসী চিত্রশিল্পীদের নামের বানান ভুল পীড়াদায়ক।
আরেকটি মনে দাগ কেটে যাওয়া প্রযোজনা Across the Sea, (The National School of Drama Theatre In Education Company)। মানুষ শরীর ও পাপেট শরীর মিলমিশে তৈরী করা এই নাট্য । নাট্যনির্দেশক, পাপেটিয়ার অনুরূপা রায়ের পাপেট নিয়ে নাট্যচর্চা ও মঞ্চভাবনা অনেকদিনের। এর আগে অনুরূপার পাপেটশিল্পের দ্বারা মঞ্চস্থ হয়েছে বিভূতিভূষণেরপথের পাঁচালি অবলম্বনেদুর্গা, দ্রৌপদীর চোখে মহাভারত, Her Voice ও কাশ্মীরি মহিলাদের গর্জে ওঠা কন্ঠস্বর, Kashmir Project। Animation ছবির স্বাদ ও স্পর্শ ডিজিটাল মাধ্যমকে ছাপিয়ে মঞ্চে নিয়ে আসার ভাবনা থেকে তৈরী Across the Sea যখন অভিনীত হয়, তখন মঞ্চ দেখে মনে হয়যেন একটুকরো ডিজনিল্যান্ড। এক ছোট্ট পেঙ্গুইনের আন্টার্কটিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে আফ্রিকায় এসে পড়া ও সেখানে অনেক পশুপাখির সাথে নতুন বন্ধুত্ব পাতানোএবং শেষে ঘরে ফিরে যাওয়ার কাহিনী দেখায়, বলে Across the Sea। পাপেটশিল্পের ব্যবহারে পশুপাখিদের নিয়ে সহজ সরল মজার গল্প বলায় ও একটা কল্পানার জগত তৈরী করায় একটি অভিনব নাট্য ভাষা সৃষ্টি হয়। এই কল্পজগতে প্রবেশ করতে দর্শকদের শুরুতে একটু অসুবিধে হলেও খানিক পরে সাবলীল যোগাযোগ ঘটে। মঞ্চে আলো ও সাদা চাদরের ব্যবহারে সমুদ্রের ঢেউ’এ পেঙ্গুইনের ভেসে যাওয়ার দৃশ্য অনেকদিন মনে থাকার মতো। পাপেট উটপাখির চলনে মানবশরীরের বিভঙ্গ প্রশংশনীয়। কল্পজগতের জিরাফ, হাতি, কুমীর, পেঙ্গুইন যখন পরস্পরের সাথে কথা বলে, তাদের শৈলীকৃত কন্ঠগুলো শোনায় ভালো, তবে মডিউলেশান নিয়ে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা হয়তো করা যেত। পশুজগতে শিকারী-মানুষ ও তার বন্দুকের অংশটি নাট্যের শেষে এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রা আনে। না-মানুষের ভাষার সাঙ্কেতিক বিচরণের পর মানুষের ভাষা যেন অনধিকার প্রবেশ বলে মনে হয়। এই নির্মল পশুজগতে মানুষ যে অপ্রয়োজনীয় ও প্রায় খলনায়ক তা ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা পায়। সংলাপে, সঙ্গীতে, নাচে, গানে, পাপেট শরীরের কারীকুরিতে এক ঘন্টা দিব্যি মাতিয়ে রাখা এই চমৎকার প্রযোজনাটি পারফর্ম্যান্সে তীক্ষ্ণতা বাড়িয়ে, নতুন কিছু নাট্য উপাদানেরও নাট্য মুহুর্তের খোঁজ জারি রেখে একটি সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের নাট্য হয়ে উঠবে এ আশায় আমরা থাকলাম।
নাট্যোৎসবের অনেক অপ্রাপ্তি যদি একদিকে রাখি আর অন্যদিকে পেবেট নাট্যটি (কলাক্ষেত্র, মণিপুর; নাট্যকার, নির্দেশক হেইসনাম কানহাইলাল), তাহলে শুধুমাত্র এই প্রযোজনাটিই পারে প্রাপ্তির পাল্লা ভারী করে দিতে। প্রথমেই যা নজর কাড়ে তা হলো নাট্যের minimal অভিমুখ – সেট প্রায় নেই, আলো অত্যন্ত পরিমিত (নীল আলো দিয়ে পাখির বাসার ওম বোঝানো চমৎকৃত করে), আছে শুধুমাত্র শরীরের শৈলীকৃত সঞ্চালন। একটি বিশেষ রঙের পোষাক যেভাবে অর্থবহ হয়ে ওঠে তা শিহরণ জাগায় আমাদের মনে। নাট্যের সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে একধরণের সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ যার ফলে কথার কোন প্রয়োজন এই নাট্যে থাকে না।আর যা নজর কাড়ে তা হলো নাট্যের আগাগোড়া রাজনৈতিক অভিমুখ। মণিপুরের একটি প্রচলিত লোকগল্পে এই নাট্য প্রোথিত – নিজেদের কথা বলার জন্য নিজেদেরই প্রাচীন লোকগল্পের ঐতিহ্য খনন করাটা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই নাট্য শুধুমাত্র একটি লোককথা মঞ্চে পরিবেশন করেএমন নয়– সময়ের দাবী মেনে এই লোককথাকে পাল্টে নেওয়া হয় বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা বলার উদ্দেশ্যে। ধূর্ত বিড়ালের হাত থেকে তার সন্তানদের বাঁচানোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করা মা পাখির (পেবেট) লড়াই আসলে ইঙ্গিত করে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে গোটা মণিপুরের নিজেদের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখার লড়াই। তবে এটাও বোধহয় এই নাটকের শক্তি যে আজকের কলকাতায় বাঙালি হিসেবে আমরা যখন এই নাটক দেখি, খুব সহজেই মণিপুর অনেকটা বিস্তার লাভ করে হয়ে ওঠে গোটা ভারতবর্ষ। আর যদি কেউ চান, অন্য প্রেক্ষিতে, হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক যে কোন ধর্ম দিয়েই প্রতিস্থাপন করে নিতে পারেন। নাট্যের একটি অংশে মা পাখি (সাবিত্রী হেইসনাম) ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন ব্যাকস্টেজের আবছায়ায় আর সামনে তখন চলে বিড়ালের আস্ফালন – খুব অল্পেই বোঝানো হয় অশুভ শক্তির উত্থানে দেশমাতৃকার অসহায়, করুণ অবস্থা। স্বল্পতার নান্দনিকতা কি পরিমাণে রাজনৈতিক প্রখরতা দিতে পারে একটি নাট্য, পেবেট সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষিত করল আর আমরা এক লহমায় পৌঁছে গেলাম নান্দীকারের জাতীয় নাট্যোৎসবের সুদিনের সেই দিনগুলিতে যখন এই উৎসব হয়ে উঠত নাট্যোৎসাহীদের পাঠশালা। এই লেখা শেষ হোক এই আশায় যে নান্দীকার ভবিষ্যতে তাদের অতীতে ফিরবেন নিশ্চয়।
শ্রীজয়ী ভট্টাচার্য | দীপঙ্কর সেন | নবীন মহাপাত্র | লাবণ্য দে