এটা বলে এই লেখা শুরু করা যায় যে প্রজেক্ট প্রমিথিউস প্রযোজিত কোড রেড এই সময়ের বাংলা নাট্যমঞ্চের এমন একটি কাজ যা দর্শকের মনে ও মস্তিষ্কে দাগ কাটবে। কিছু প্রযোজনা এমন হয়, যা বিষয়ের ও আঙ্গিকের গুণে হয়ে ওঠে সমকালীন ভাবনার এক শৈল্পিক দলিল। একটি সর্বার্থে নিখুঁত পরিবেশনা না হয়েও কোড রেড যে কারণে আমার মতে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো এই নাট্য উঠে আসে সমকালের জঠর থেকে এবং হয়ে দাঁড়ায় সমকালের অভ্রান্তসূচক।
নয়ে নাটুয়ার হালের উপস্থাপনা মৈমনসিংহ গীতিকা : https://t.co/tZp1fY8hpU#bengalitheatre | #kaahontheatrereview pic.twitter.com/exaASYVJlq
— kaahon (@kaahonwall) May 25, 2017
ইদানীং মৌলিক বাংলা নাটক প্রায় দুষ্প্রাপ্য – বেশির ভাগ নাট্যই এখন তৈরী করা হচ্ছে দেশ ও বিদেশের নাটকের বা অন্য রচনার ওপর ভিত্তি করে। সেই অর্থে কোড রেড এই প্রবণতার বাইরে নয় কারণ এই নাটক ইন্দুদীপা সিনহা (যিনি নির্দেশনা এবং নৃত্যবিন্যাস’ও করেছেন) লিখেছেন দুটো রচনার ওপর ভিত্তি করে –ম্যাটেই ভিস্নিয়াকের মূল ফরাসী নাটক দ্য বডি অফ ওম্যান অ্যাস আ ব্যাটেলফিল্ড ইন দ্য বোসনিয়ান ওয়ার (১৯৯৭) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুতীর্থ (১৯৩১)। মৌলিক না হয়েও কোডরেড মৌলিকত্বের দাবী এজন্যই করতে পারে যে ভাষায়, রচনার সময়কালে, প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র দুটি টেক্সটকে অঙ্গীভূত ভাবে মিলিয়ে দিয়ে নতুন একখানি টেক্সট নির্মাণ সম্ভব হয়েছে সৃজনশীল ও মৌলিক এক পাঠ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের আদলে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মাথা চাড়া দেওয়ায় আর পশ্চিম দুনিয়া তার যান্ত্রিক, বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার বিজয়রথ বিশ্বব্যাপী ছুটিয়ে দেওয়ায় আশঙ্কিত রবীন্দ্রনাথ লিখছেন শিশুতীর্থ, যে কবিতার শেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য আশার আলো বহন করে নিয়ে আসে নবজাতক। অন্যদিকে, ম্যাটেই ভিস্নিয়াক পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ার ভয়াবহ জাতিগত যুদ্ধের পটভূমিতে লেখেন তার নাটক, যার নামই বলে দেয় তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন যুদ্ধ-বিদ্বেষের আগ্রাসী পুরুষতান্ত্রিক আস্ফালন নিয়ে, নারীদেহ যেখানে হয়ে যায় এমন যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে দাপিয়ে বেড়ায় পুরুষের যৌন পরাক্রম। তমসাচ্ছন্ন এই নাটকের শেষেও একটি নতুন প্রাণসঞ্চারের সম্ভাবনার আভাস থাকে। শেষাংশে জন্মের মোটিফ ছাড়া আর বিশেষ মিল না থাকা দুটো আলাদা টেক্সটকে মিলিয়ে দেওয়ার কাজ নাটককার ইন্দুদীপা সিনহা এতটাই সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন যে মনে হয় দেশ, কাল, সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে লেখাদুটো অপেক্ষা করছিল একে ওপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের।
মেলানোর এই কাজটা করতে গিয়ে ইন্দুদীপা কিছু বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যার ফলে কোড রেড বিশেষভাবে ঋদ্ধ হয়েছে। ১) তিনি একেবারেই চেষ্টা করেননি শিশুতীর্থের ‘পূর্বদেশের বৃদ্ধের’ (গৌতম বুদ্ধ? রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং?) বা ‘ভক্তের’ (মহাত্মা গান্ধী?) বা নবজাতকের (যীশু? মহামানব?) পরিচয় নির্ণয় করার, ঠিক যেমন তিনি দ্য বডি’র ফ্রয়েডিয় তত্ত্বের ওজনে কোড রেড’কে খুব বেশি ভারাক্রান্ত হতে দেন নি। দর্শন ও তত্ত্ব ছুঁয়ে থেকেছে কোড রেড, কিন্তু তা নিজের নাট্যচলন রুদ্ধ না করে। বরং দুটো লেখাতেই পথ চলার ও সন্ধানের (একটিতে প্রধানত মনস্তত্ত্বিক, অন্যটিতে বস্তুত) যে অনুষঙ্গ আছে তা ইন্দুদীপা প্রস্ফুটন করেছেন নাট্যের স্বার্থে। ২) তিনি ফরাসী নাটকের ধর্ষিত, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ডোরার নাম পাল্টে করে দেন মাটি এবং মাটি সম্পৃক্ত হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের কল্পনার উর্বর পৃথিবী মায়ের সাথে। এছাড়াও, ডোরা মাটি হয়ে গিয়ে হাজির করে এই ইকোফেমিনিস্ট ভাবনা যে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার ও লোভের দ্বারা নিরন্তর শোষিত মাটি-পৃথিবী তবু হারায় না তার প্রজননশক্তি, গণকবরের অন্ধকার চিরে মাটি নিয়ত নির্গত করে চলে নতুন প্রাণ। আরো বড় কথা হলো, এই নাম পরিবর্তন সুযোগ করে দেয় মৃত্তিকার অনন্ত উর্বরতার হাত ধরে মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের বিজয়ের ভাবনাটা পারফর্ম করার, যা না হলে নাট্যই অসম্ভব।
নির্দেশক ইন্দুদীপা পারফরম্যান্সের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেন এবং তাই এখানেও তিনি মেলান; মেলান নৃত্য ও অভিনয়। নৃত্য পরিকল্পনার ক্ষেত্রে তিনি সারগ্রাহী – যে ধরণকে আমরা কনটেম্পোরারি নাচ হিসেবে চিহ্নিত করি (যার মধ্যেই মিশে আছে বিভিন্ন নৃত্যধারা) মূলত তার ওপর ভিত্তি করে, তার সাথে কখনো কত্থকের, কখনো কথাকলির, কখনো বা মার্শাল আর্ট থেকে উঠে আসা নৃত্যধারার ছোঁয়া লাগিয়ে ইন্দুদীপা সাজিয়েছেন কোড রেডের নাচের অংশ। অবহিত দর্শক হয়ত খেয়াল করবেন কিছু ফর্মেশনের ক্ষেত্রে নৃত্যবিন্যাসকারী ইন্দুদীপা কয়েকটি নৃত্য টেক্সটের দিকে ইশারা করেছেন, যেমন তনুশ্রী শঙ্করের নির্দেশনায় হওয়া শিশুতীর্থ বা দিমিত্রিস পাপাইওনুর নোওয়্যর নাচের সেই দৃশ্য যা পিনা বশকে শ্রদ্ধা জানায়।
এবার কিছু কথা, যে নাট্য মঞ্চস্থ হতে দেখেছি তা নিয়ে। নাট্যের শুরুতে এবং বিরতির ঠিক পরে একটি করে স্লাইড-শো হয় ‘আসল’ পারফরম্যান্স শুরুর আগে। কিন্তু তা শ্রবণদর্শন অভিজ্ঞতার নিরিখে থেকে যায় আপাত অসম্পৃক্ত। তাই কোড রেডের নির্মাতারা পূর্ণাঙ্গভাবে মাল্টিমিডিয়া অভিজ্ঞতা তৈরী করার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তার সদ্ব্যবহার হয়ে ওঠে না। দিশারী চক্রবর্তী যে আবহ সঙ্গীত তৈরী করেছেন তা বাহুল্যদোষে দুষ্ট মনে হয়েছে – তিনি ভাবতে পারেন নৈশব্দকে আরো বেশি মাত্রায় আবহের অঙ্গ করে তোলা যায় কি না। আলোকভাবনায় থাকা দীনেশ পোদ্দারের কাজটা ছিল বেশ কঠিন, কারণ যে নাটক জীবনের অন্ধকার দিক নিয়ে মগ্ন (যুদ্ধ, ধর্ষণ, মনোবিকার) আলো দিয়ে সে নাটকের অন্ধকার ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। এই কঠিন কাজটা দীনেশ দক্ষতার সাথে সমাধা করেছেন। একদম অন্তিম দৃশ্যের আলোকসজ্জা অন্য একটি জনপ্রিয় নাটকে দীনেশেরই করা কাজকে কিছুটা হলেও মনে পড়িয়ে দেয়। কৃষ্ণেন্দু অধিকারী (জয়) অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে তার চরিত্রের আত্মপ্রত্যয়ী সাইকোলজিস্ট থেকে যুদ্ধবিক্ষত, ভাঙ্গা একটি মানুষ হয়ে যাওয়ার যাত্রাটা বাচনভঙ্গির ও শরীরী ভাষার সূক্ষ্ম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পারফর্ম করেন। কৃষ্ণেন্দু এবং গুলশনারা খাতুন (মাটি) যখন একসাথে অভিনয় করেন, তখন জায়গায় জায়গায় তাদের আলাদা স্বরগ্রামে বলা সংলাপ একটা অসমানতা তৈরী করে যা দুটো চরিত্রকেই বেশ ফুটিয়ে তোলে। আমার মনে হয়েছে বারংবার মঞ্চে ঢোকা বেরোনোয় গুলশনারার মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটেছে – কিছু দৃশ্যে তিনি যেন চরিত্রে প্রবেশ করেছেন একটু সময় নিয়ে। যারা নাচ করেছেন – স্থানাভাবে তাদের নাম না দিতে পারার জন্য মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি – তারা সবাই নাচে সমানভাবে দক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও চেষ্টার কসুর করেননি। যারা অপেক্ষাকৃত নৃত্যক্ষম তাদের মাথায় রাখা উচিত দলবদ্ধ পারফরম্যান্সের ক্ষেত্রে কোন দু’একজনকে অন্যদের তুলনায় ‘ভালো’ দেখতে লাগাটা কোন একটি দৃশ্যকে নয়নাভিরাম করে না। কোড রেড কতটা নৃত্যনির্ভর তা বোঝা যায় যখন দেখি এই নাট্যের সেরা মুহূর্তগুলো নির্মিত হয় নাচের মধ্য দিয়ে –গণকবরের তলদেশ থেকে উঠে আসা প্রাণের সঙ্কেতের দৃশ্য বা গর্ভাশয়ে ভ্রূণের আর্তির দৃশ্য দর্শক বহুদিন মনে রাখবেন আশা করি।
শেষ করব দুটো বিষয় উল্লেখ করে। ১) মূল ফরাসী নাটকের দুটি মূখ্য চরিত্রই নারী – কোড রেড নাটকে একজন হয়ে যান পুরুষ (জয়)। এই বদলটা আমি প্রাথমিকভাবে দেখব একটা (লিঙ্গ) রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে, যেখানে নাটককার ও নির্দেশক ইন্দুদীপা প্রশংসনীয়ভাবে পুরুষতন্ত্র ও ব্যক্তি পুরুষের মধ্যে একটা ফারাক করেছেন। দ্বিতীয়ত, সুযোগ থাকা সত্বেও ইন্দুদীপা যে দুটি নারী চরিত্র রেখে দিয়ে তার মধ্যে একটি নিজের জন্য সংরক্ষিত করেননি, তা নিঃসন্দেহে আশার কারণ – থিয়েটার তো কোন একজনের বিবিধ ক্ষমতার প্রদর্শনক্ষেত্র নয়। ২) এই অংশের আত্মবাদী ঝোঁকের জন্য মার্জনা চেয়ে নিয়ে বলছি, কোড রেড আমাকে বেশ কিছুবার নিয়ে গিয়েছিল অন্য বেশ কিছু টেক্সটের কাছে – যেমন, সাইকোলজিস্টের একটি কথায় মাটির যান্ত্রিকভাবে দু’পা ফাঁক করে দেওয়া আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল সাদাত হোসেন মান্টোর একাধিক গল্পে, বা অসম্ভব প্রতিকূলতা কাটিয়ে নতুন প্রাণের প্রতিশ্রুতি আমাকে নিয়ে গিয়েছিল মৌসুমি ভৌমিকের চিঠি গানটার কাছে। আপনি কোড রেড দেখুন, দেখে বলুন, এই নাটক আপনাকে কোন টেক্সটের কাছে নিয়ে যায়।
দীপঙ্কর সেন