ছুমন্তরঃ বানিজ্যিকরণের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া এক নাটক

Posted by Kaahon Desk On April 26, 2019

বিশ্বায়নের যুগে, পৃথিবীর প্রায় কোন দেশেই, থিয়েটারকে শুধুমাত্র একটা বিনোদনের মাধ্যম বলে গণ্য করা হয় না। রেকর্ডিং যন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট দৃশ্য-শ্রাব্য (অডিও-ভিসুয়াল) মাধ্যমগুলি যে ভাবে তাদের প্রযুক্তির হাত ধরে গল্প বলা এবং গল্প শোনার অভিজ্ঞতাকে পালটে দিয়ে চলেছে, সেখানে থিয়েটারকে যদি তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, তবে নিশ্চিত ভাবে, সে চলে যাবে একেবারে পিছনের সারিতে। তাই থিয়েটারকে তার নিজস্ব শৈলীর উপর ভরসা রেখে, মানুষের বিনোদনের এবং শিক্ষার ভার নিতে হয় এবং হবে। থিয়েটার মাধ্যমটির অগ্রগতি বা উন্নতি বিচার করা হয় সে কতটা বাস্তবের প্রতিচ্ছবি স্টেজে তৈরি করতে পারল তা দিয়ে নয়, বরং কত রকম ভাবে প্রতীকি উপায় দর্শকের কল্পনা বা চিন্তাশক্তির উদ্রেক করতে পারল তার মাপকাঠিতে। বাংলা থিয়েটারের জয়যাত্রাও এই স্থিতিমাপের উর্দ্ধে নয়। কখনো আধুনিকতা, কখনও উত্তর-আধুনিকতা যে শৈল্পিক দোলাচলকেই বাংলা থিয়েটার আঁকড়ে ধরুক না কেন, তার মূল লক্ষ্যপথ ছিল বাস্তবতার উর্দ্ধে গিয়ে সমাজ, সামাজিকতা, আধ্যাত্মিকতার বিশ্লেষণ করা। এই দেখা এবং দেখাতে পারার শক্তিই থিয়েটার মাধ্যমের মূলধন। শুধুমাত্র সেজেগুজে হেঁটেচলে, উঁচু আলোকিত স্থানে কোন গল্পকে পরিবেশন করা, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য তখনি ছিল, যখন দৃশ্য-যুক্ত বিনোদনের মাধ্যম বিশেষ কিছু ছিল না। সময় অনেক বদলেছে। এখন টেলিভিশন, সিনেমা, এবং ক্রমবর্দ্ধমান ইন্টারনেট মানুষের মননকে গ্রাস করে নিয়েছে। লাক্ষণিক পরাবাস্তবতার খোঁজ দেওয়াই বোধহয় আজ থিয়েটারের অনন্য শক্তি হতে পারে।

Previous Kaahon Theatre Review:

কিন্তু ভাবলে আশ্চর্য লাগে, এই সহজ বোধ এবং সময়ের স্বাভাবিক চাহিদা এখনকার কিছু বর্ষীয়ান বাংলা থিয়েটার নির্মাতারা বুঝতে পারেন না, বা কোন এক অজ্ঞাত কারণে বুঝতে চান না। তারা এখনও সেই সময়ে বেঁচে আছেন বা বেঁচে থাকতে চান যখন পরিবারের সবাই মিলে যৌথ পারিবারিক মুল্যবোধের সামাজিক নাটক দেখতে যেতেন। শুধুমাত্র অসামান্য অভিনয় দিয়ে পরিবেশিত, কারণ এবং ফলের ভিত্তিতে তৈরি সেই সব নাটক দেখে তারা রোজকার রুটিনমাফিক জীবন থেকে স্বস্তিলাভ করতেন। ঠিক সেই রকম একটি নাটক, যার নাম ‘ছুমন্তর’, এখন বাংলার মঞ্চে উপস্থাপিত হচ্ছে। মেলোড্রামার নিয়ম মেনে, সামাজিক বেষ্টন বা দাম্পত্যের প্রয়োজনীয়তা, প্রথমে সমাজের তৈরি পারিবারিক নিয়মকে অবজ্ঞার ফলে সমস্যা এবং তার সমাধান ইত্যাদি দিয়ে ঘেরা এই নাটক। নাট্যকার এবং নির্দেশক নাটক শেষের পরেই বলে দেন যে এই নাটক শিক্ষামুলক নয়, শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য তৈরি। থার্ডবেল পড়ে যাওয়ার পরেও যে মানুষ তার স্মার্টফোন থেকে চোখ সরাতে পারেননি, সে মানুষ কি করে এই নাটক দেখে বিনোদন লাভ করতে পারেন, সে এক বিশেষ প্রশ্ন বটে। এক সাধারণ মার্চেন্ট অফিসের কর্মী (ফাল্গুনি চট্টোপাধ্যায়), জীবনে বিখ্যাত হতে পারেননি বা অনেক টাকা রোজগার করতে পারেননি বলে, তার স্ত্রী (রুমকি চট্যোপাধ্যায়) এবং সন্তানের কাছে হেনস্থা হতে হয়। হঠাৎ একদিন প্রায় ছুমন্তর দিয়ে, তিনি বিজ্ঞাপনে মুখ দেখানোর সুযোগ পান এবং স্বপ্নে, আবার স্বপ্ন থেকে ফিরে এসেও বাস্তবে তার পরিবারের থেকে সম্মান পেয়ে বেঁচে থাকবার কারণ খুঁজে পান। নাটকটি লিখেছেন জিৎ-সত্রাগ্নী, নির্দেশনা দিয়েছেন প্রসুন ভট্টাচার্য্য এবং প্রযোজনা করেছে লোককৃষ্টি।

উচ্চকিত, পড়ুন প্রায় ভাঁড়ামি অভিনয়, অতি ডায়ালগের ভারে ন্যুব্জ, চৌকি, পিচ বোর্ডের তৈরি যাত্রা শিল্পের থেকে ধার করা সেট ডিজাইন দিয়ে সাজান এই নাটক বিনোদনের থেকে, সময় অপচয় হওয়ার ভয়ই বেশি দেখায়। সেই ভয় কাটানোর সহজ উপায় এই নাটকের বিজ্ঞাপন দেখে ভুল করে নাটকটি দেখে ফেলার পরে সেই অভিজ্ঞতাকে ভুলে যাওয়া। কিন্তু সেটা সম্ভবপর হয় না, কারণ এই নাটক জনসাধারণের টাকা দিয়ে তৈরি। ভারত সরকারের, সংস্কৃতি মন্ত্রক কি উদ্দ্যেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এই ধরনের নাটকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট করে রোজগার করা tax-এর টাকা বিনিয়োগ করছেন, তা ভেবে একটু ভয়ই লাগে। সংস্কৃতি মন্ত্রকও কি আসলে তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে মত্ত হয়ে গিয়ে ভুলে গেলেন যে ভারতীয় পারিবারিক মুল্যবোধের এই নাটক বর্ত্তমান প্রজন্মকে থিয়েটারমুখী না করে, ছিটকে দূরে সরিয়ে দেবে! দিল্লী শহরে বসে থাকা মানুষদের দোষই বা দিই কি করে! ফেসবুকের পেজে এই নাটকের বহু উচ্চকিত প্রশংসা দেখলে বোঝা যায়, বাংলা থিয়েটারের গণ্ডি আসলে ছোট হচ্ছে। এখানে সত্যি কথা বলা মানে থিয়েটার পরিবারের চক্ষুশুল হওয়া। তাই নাটকের খারাপ প্রজেকশনে খারাপ ভাবে শুট করা আবীর চট্টোপাধ্যায়কে দেখে সিনেমার হিরোর প্রতি প্রেম ব্যক্ত করতে গেলে তার বাবার করা যেকোন কাজেরই প্রশংসা করতে হয়।

https://archive.kaahon.com/theatre/naye-natua-presents-new-production-matir-gari-mrichchhakatika/

পরিশেষে বলা যেতে পারে যে সময়কে অস্বীকার করে, কোন শিল্পকর্ম হয় না। যদি বর্ত্তমান সময়ে, এবং সময়ে প্রাসঙ্গিক শিল্পরীতিতে বিশ্বাস না থাকে, তবে শিল্পসৃষ্টি থেকে কিছু সময়ের জন্যে বিরতি নেওয়াই ভাল।

 

Srijayee Bhattacharjee
A postgraduate in film studies from Jadavpur University, Research Project Assistant in Maulana Abul Kalam Azad Institute of Asian Studies, a thespian, creative producer and a writer.

 

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us