চাঁদ মনসার কিস্‌সা – কাব্য যখন কিস্‌সা হয়

Posted by Kaahon Desk On February 8, 2018

০৩।০২।২০১৮ তারিখে দর্শক পরিপূর্ণ মিনার্ভা থিয়েটার সংসৃতি প্রযোজিত (পঞ্চম বৈদিকের সহযোগিতায়) চাঁদ মনসার কিস্‌সা নাট্যটির যে প্রথম মঞ্চায়ন দেখল, যুগপৎ দুঃখ ও হতাশার সাথে বলতেই হচ্ছে, রাজনৈতিক ভাবাদর্শের বিচারে তা নিতান্ত পশ্চাদমুখী। এই নাট্যে আমরা পাই এমন এক মনসাকে যিনি আগাগোড়া একটি নঞর্থক, ধ্বংসাত্মক চরিত্র, আখ্যানের স্থিরীকৃত খলনায়ক। তিনি কেবলই ক্রোধে গুমরোন আর ভাবেন কিভাবে চাঁদ সওদাগরের ক্ষতিসাধন করবেন, এবং থেকে থেকে চাঁদকে ভীষণরকম আঘাত করে বিজাতীয় উল্লাস করেন। ভাবতে অবাক লাগে, খারাপ’ও লাগে কিছু কম নয়, যে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে সারা দেশে যখন ব্রাহ্মণ্যবাদের ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়ার প্রয়োজন হচ্ছে এবং তা গড়েও উঠছে ঈষৎ বিক্ষিপ্তভাবে, তখন একটি বাংলা নাটক বাংলা লোকসংস্কৃতির এমন একটি টেক্সটের পশ্চাদমুখী পাঠ পেশ করল যেই টেক্সট আসলে মনসার সাথে চাঁদের বিবাদের মধ্যে দিয়ে একদিকে সমাজের অন্ত্যজ বর্গের সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার ও সংগ্রামের কথাই বলে ও অন্যদিকে একজন সর্বার্থে স্বাধীনচেতা, দুঃসাহসী, পরাক্রমশালী নারীচরিত্রকে আখ্যানের কেন্দ্রে স্থাপন করে পুরুষতন্ত্রের ভিতটাই টলিয়ে দিতে চায়। মনসামঙ্গলে যে মনসাকে আমরা পাই তিনি বারবার প্রত্যাখ্যাত, অপ্রার্থিত, অপমানিত, আঘাতপ্রাপ্ত। যে শিবের বীর্য থেকে তার উৎপত্তি, সেই শিব তাকে যৌন কামনা করেন, বিদ্বেষী বিমাতার হাতে তার অঙ্গহানি ঘটে, তার স্বামী তাকে ভয় পেয়ে পরিত্যাগ করেন (অবশ্য মাঝে ফিরে এসে বংশরক্ষার কাজটি করে যান) – দেবলোকে ও নিজসংসারে মর্যাদা না পাওয়া মনসা পুজো চান মানুষের। চাঁদ মনসার কিস্‌সা এমন একটি retelling যা (১) সম্পূর্ণ ছেঁটে দেয় মনসার রাগের যথার্থ কারণগুলি; (২) তার ধ্বংসাত্মক দিক আলোতে এনে প্রায়ান্ধকারে রাখে এটা যে অনন্ত উর্বরতার প্রতীক মনসা যেমন জীবন নেন তিনি তা ফিরিয়েও দেন; (৩) কোন প্রয়াসই করে না মনসার দিকে অনবরত ছুঁড়ে দেওয়া চাঁদের কটুক্তির – ‘চেঙমুড়ী’,‘লঘুজাতি’– বিশ্লেষণ করার (যে শব্দগুলি বহন করে একলা, স্বাধীন নারীকে নিয়ে পুরুষতন্ত্রের উৎকণ্ঠার এবং উচ্চবর্ণের জাতি বিদ্বেষের ইতিহাস)। যেকোন retelling’এ কী থাকল আর কী বাদ পড়ল, কোনটা সামনে এলো আর কোনটা পেছনে চলে গেলো, এসবই নির্ধারণ করে দেয় সেই retelling’এর রাজনীতি আর সেই নিরিখে চাঁদ মনসার কিস্‌সা  রাজনৈতিকভাবে অবস্থিত হয় বেশ সমস্যাপূর্ণ একটা জায়গায়।

Previous Kaahon Theatre Review:

নির্মাতারা যদি ভেবে থাকেন এই সমস্যার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার রাস্তা হতে পারে মঙ্গলকাব্যে না থাকা মামা ভাগ্নের দুটি চরিত্রের আমদানি করে, ভাঁড়ামোর আঙ্গিকে তাদের দিয়ে কিছু টীকা টিপ্পনী করানো, যাতে নাট্যেকে দেওয়া যায় রাজনৈতিক সঠিকতা, তাহলে তারা সঠিক ভাবেননি। প্রথমত, নাটকের বাইরে থাকা ওই দুই চরিত্রের মাধ্যমে নাটকের ঘটনা দর্শক কিভাবে গ্রহণ করবেন তা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার এই পন্থাটাই প্রশ্নযোগ্য – এটা হয় যখন নির্মাতারা এতে বিশ্বাস রাখতে পারেন না যে তারা যা বলতে চাইছেন তা তারা বলতে সক্ষম হচ্ছেন এবং যখন তারা দর্শকদের নাট্যটেক্সট গ্রহণ করার ক্ষমতা নিয়ে থাকেন সন্দিহান। দ্বিতীয়ত, মামাভাগ্নেদ্বয় তাদের টীকার ক্ষেত্রে যে খুব সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে পেরেছেন তেমনটাও নয়। একবার যখন তারা বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রসঙ্গ টেনে বিদ্রূপাত্মক হলেন, তা আরোপিত হয়ে রইল কারণ তারা যা বললেন নাট্যের রাজনীতি থেকে গেলো তার সম্পূর্ণ বিপরীতে। আরেকবার যখন তারা নারীবাদী প্রশ্নটা তুললেন কেন মঙ্গলকাব্যের রচয়িতারাও এটা নিয়ে মুখ খোলেন নি যে লক্ষিন্দর বেঁচে উঠেই কেন সন্দেহ প্রকাশ করবেন তার স্ত্রীর সতীত্ব নিয়ে, তখন বোঝা গেল তাদের মঙ্গলকাব্য পাঠেই গলদ রয়ে গেছে। বেহুলার স্বামীর পুনর্জীবনের জন্য অসাধ্য সাধন করার অনুপুঙ্খ বর্ণনার পর যখন লক্ষিন্দর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেন, সেই প্রশ্নই যথেষ্ট তাকে মজ্জাগতভাবে পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী হিসেবে চিহ্নিত করে কিছুটা উপহাসের পাত্র করে দেওয়ায় – তার জন্য আলাদা করে আর একটিও শব্দ ব্যবহার করা যে নিষ্প্রয়োজন তা মঙ্গলকাব্যকারেরা বিলক্ষণ জানতেন।

পারফর্ম্যান্স সম্পর্কে কিছু কথা। চাঁদ মনসার কিস্‌সা নাট্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এটা যে আমরা এখানে যতটা দৃশ্যকাব্যকারের মঞ্চজোড়া উপস্থিতি পাই, সে তুলনায় নির্দেশক থাকেন ততটাই অনুপস্থিত (যদিও আমরা জানি নাট্যে নির্দেশক থাকেন অনুপস্থিত উপস্থিতি হয়ে)। এই নাট্য অবশ্যই সেই ঘরানার কাজ নয় যা মূলত পারফর্ম্যান্স-নির্ভর এবং যেখানে নাট্যের শরীর থেকে সচেতনভাবেই নির্দেশকের চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়।নির্দেশক নেই, দৃশ্যকাব্যকার আছেন এটা হতেই পারে, কারণ নাট্যের টেক্সটের প্রয়োজনে একজন প্রকাশিত একজন নিহিত থাকতেই পারেন। গোটা ব্যাপারটা তাই টেক্সটের প্রয়োজনের জায়গা থেকেই দেখা যাক। ‘দৃশ্যকাব্য’ শব্দের কাব্য অংশটি বিশেষ তাৎপর্যের কারণ সাধারণভাবে কাব্য বললেই আমাদের মনে তৈরী হয় সুন্দর, সুচারু কিছুর ধারণা। অর্থাৎ ‘দৃশ্যকাব্য’ হল দৃশ্য দিয়ে সুন্দর কিছু, দৃষ্টিনন্দন কিছু সৃষ্টি করা। এবং গোটা নাট্য জুড়েই আমরা পাই দৃষ্টিসুখের ঢালাও আয়োজন, যার মধ্যে থাকে সমস্ত কোরিক চরিত্রদের এক রঙ নকশার পরিপাটি পোশাক যা সবরকম ভিন্নতার, দারিদ্র্যের, ক্লেশের চিহ্ণ মুছে দেয়। অপার সম্পদের মালিক চাঁদ বণিক এবং প্রান্তিক মানুষদের প্রতিনিধি মনসার বেশভূষার বিন্যাসে ও গুণমানে আসে আশ্চর্য সমতা যা দেখে মনে হয় তারা একই শপিং মলে বাজার করেন। দৃষ্টিসুখ কত দরকারী তা যেমন সুন্দর ময়ূরপঙ্খী নৌকা বোঝায়, তেমনই বোঝায় সাইক্লোরামায় ভেসে ওঠা মনসার লোগো বা দুটি ছায়াশরীরের গান গাইতে গাইতে চলে যাওয়া। বিরতির পরে মামা ভাগ্নে দক্ষিণ ভারতীয় মার্শাল আর্টের আঙ্গিকে একটু নেচে নেন, তা’ও বোধহয় দৃশ্য দিয়ে কাব্য রচনার স্বার্থে। নাট্য যখন বিষ, মৃত্যু, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লালসা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, তখনও দৃশ্যকাব্য মনোরঞ্জনের লক্ষ্য থেকে একচুল’ও সরে না। চাঁদ মনসার কিস্‌সা এমন একটি প্রযোজনা যেখানে টেক্সটের প্রয়োজনে দৃশ্যকাব্য রচিত হয় না, বরং দৃশ্যকাব্য রচনার করার অছিলা হিসেবে একটি টেক্সট লাগে।

এসবের মধ্যে, মনসার ভূমিকায় মোনালিসা চট্টোপাধ্যায় তার পারফর্ম্যান্স দিয়ে আশ্চর্য একটি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেন। একদিকে তার অভিনয়ের দক্ষতাই – তার বিকৃত কন্ঠস্বর, মাথার ওপর সটান তোলা ডান হাতের করাল মুদ্রা যা দেবতাদের আশীর্বাদ করার ভঙ্গির দিকে ছুঁড়ে দেয় ব্যঙ্গ, তার শরীরে অস্থির এক এনার্জি বয়ে নিয়ে চলা – মনসাকে করে তোলে বীভৎস খলনায়ক। অন্যদিকে, তার এই বীভৎসতা নির্মাণ কিছুটা হলেও সক্ষম হয় দৃশ্যকাব্যের মধুরসে ডুবে থাকা চাঁদ আর মনসার আজও না মেটা এই মহাকাব্যিক বিবাদকে দৃষ্টিসুখের পরিধির বাইরে টেনে নিয়ে এসে ফেলতে বৃহত্তর রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানের ঘামে, রক্তে, কাদায়। যেভাবে visual design’এর মধ্যে থেকেও পারফর্ম্যান্স দিয়ে মোনালিসা ক্রমাগত সেই design’এরপ্রতিপক্ষ হয়ে থাকলেন, তাতে বিশ্বাসীরা ভাবতেই পারেন মোনালিসা অর্জন করে নিয়েছেন মনসার প্রসাদ।

দীপঙ্কর সেন | শ্রীজয়ী ভট্টাচার্য

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us