নান্দীকারের ৫৯তম জন্মদিনে ২৯শে জুন, ২০১৮ আকাদেমী মঞ্চে যে নাট্যায়োজন করা হয়েছিল তার অঙ্গ হিসাবে মঞ্চস্থ হল বের্টোল ব্রেখটের ‘দি এক্সেপশন অ্যান্ড দা রুল’ অবলম্বনে নান্দীকারের প্রযোজনা বাংলা নাটক ‘ব্যতিক্রম’, অনুবাদও নির্দেশনা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। এই নাটকটি নান্দীকার প্রথম মঞ্চস্থ করে ১৯৮০ সালে। একই প্রযোজনাকেই নতুন করে উপস্থিত করা হয়েছে, আর এতে অংশগ্রহণ করেছে দলের একঝাঁক এখনকার তরতাজা তরুণ সদস্য।
দীর্ঘ ৫৮ বছরে নান্দীকার মোট ৮০টিরও বেশি প্রযোজনা উপহার দিয়েছে বাংলা রঙ্গমঞ্চকে। নিয়মিত প্রযোজনা ও নাট্য অভিনয়ের পাশাপাশি বস্তি, ফুটপাত ও তথা কথিত নিষিদ্ধ এলাকার শিশুদের এবং প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাট্যচর্চার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে, ১৯৮৪ সাল থেকে জাতীয় নাট্য উত্সবের আয়োজন করে আসছে, ১৯৮৬ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে যুবকদের জন্য নাট্যশিক্ষার ওয়াকর্শপ পরিচালনা করছে। ওয়াকর্শপে আংশগ্রহনকারীরা তাদের শ্রম ও নিষ্ঠাকে সম্বল করে পরবর্তীকালে বাংলা রঙ্গমঞ্চে সফলকাম হয়েছে।
Previous Kaahon Theatre Review:
Kaahon Theatre Review
Macbeth Mirror – Contemporary in performance, not so in drama
Read this review in English: https://t.co/tBc9MZKp9L #bengalitheatre | #theatre | #theatrereview | #kaahontheatrereview | #KaahonPerformingArts https://t.co/UJdlFBCBc1
— kaahon (@kaahonwall) July 7, 2018
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার নাট্যজগত দশকের পর দশক ব্রেখট চর্চায় নিযুক্ত থেকেছে, আজও বাংলার নাট্যজগত ব্রেখটকে নিয়ে সমান উৎসাহী কারণ নাট্যকার ও কবি হিসাবে তিনি ছিলেন ‘সোসাল থিমের’ শ্রেষ্ঠ রূপকার। সংগ্রামের প্রকাশ ঘটে এমন যেকোন ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক ঘটনাবলির তাত্পর্য্য ব্রেখটের কাছে একইরকম গুরুত্ত্বপূর্ণ মনে হত।শিল্পের পরিসরে রাজনীতির প্রবেশে তিনি কখন ভীত হননি। অন্যভাবে দেখতে গেলে রাজনীতিকে, শিল্পের সঙ্গে খুব সহজ স্বাভাবিক বিষয় হিসাবেই তিনি চর্চা করতেন। তিনি জানতেন, নাটককে রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা থেকে মুক্ত করলে শিল্পের সামাজিক তাৎপর্য মলিন হতে বাধ্য।
‘দি এক্সেপশন অ্যান্ড দারুল’ হল ১৯৩০ সালে লেখা ব্রেখটের অন্যতম ‘লার্নিং প্লে।’ এই পর্যায়ের নাটকগুলিতে ব্রেখট দর্শকদের মনকে সর্বদা কঠিন সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়ে তাকে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করেন, পুঁজিবাদের নৃশংসতা সম্পর্কে অবহিত করান। শক্তিশালী সর্বদা দুর্বলের উপর অত্যাচার করে, শক্তিশালী সবসময় শোষক শ্রেণী আর দুর্বল সর্বদাশোষিত শ্রেণী, আমরা ভাবি অত্যাচারিত বোধ হয় শেষে গিয়ে তার প্রতি অত্যাচারের বিচার পায়, কিন্তু আসলে তা হয় না – অত্যন্ত নেতিবাচক হলে ও এই নাটক আমাদের এই বার্তাই দেয়। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হল অর্থলোভী, সন্দেহপ্রবণ এক সওদাগর। মরুভূমির উপর দিয়ে ছুটছে সাওদাগর তেলের খনির খোঁজে, সঙ্গে একজন কুলি ও গাইড, পেছনে ছুটে আসছ আরো সব প্রতিদ্বন্দ্বী সওদাগর। সওদাগর তাড়া দেয় গাইডকে কারণ সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের আগে তাঁকে পৌঁছতে হবে উড়গা শহরে যেখানে আছে তেলের খনি। ‘যদি সফল হতে চাও তো সব্বাইকে সন্দেহ কর’ – এটাই হল সওদাগরের দর্শন। সেভাবে তার সঙ্গের ভাড়াটে লোকগুলো মোটেই তার বন্ধু নয়, ওদের শ্রেণীচরিত্র আলাদা, ওরা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করবে আর সুযোগ পেলেই ছুরি মারবে মালিককে। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সে প্রথমে বরখাস্ত করে গাইডটিকে। সওদাগর ছুটছে টাকার পিছনে, মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য, পায়ের তলায় গরম বালি, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ, উত্তেজনাও পরিশ্রমে সওদাগর প্রায় মরতে বসেছে। এমতাবস্থায় কুলিটি তার নিজের জলের পাত্রটি সওদাগরের দিকে এগিয়ে দেয়। কারণ কুলিটি ভাবে তৃষ্ণার্ত মানুষকে জল না দেওয়া সে’তো অপরাধ, পাপ। কিন্তু সওদাগর ভাবে কুলিটি বুঝি পাথর ছুঁড়ে মারতে আসছে তাকে, সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালায় আর মারা যায় কুলিটি। কুলির স্ত্রী আদালতে নালিশ করে সওদাগরের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে। শুরু হয় আসামি সওদাগরের বিচার। বিচার না বলে একে প্রহসন বলাই ভালো। আসামীকে নির্দোষ বা না বার সমস্ত ব্যবস্থাই পাকা।পুলিশ, বিচারব্যবস্থা, সর্বত্রই অর্থের বলে সওদাগরের অবাধ যাতায়াত। বিচার করায় দেন সওদাগরের কোন দোষ নেই, দোষ কুলিরই কারণ সে সর্বদা নিজেকে শোষিত মনে করে, ঘৃণা করে শোষক শ্রেণীকে। তবে কেন সে শুধু শুধু শোষকের তৃষ্ণা মেটাতে যাবে? এই অযৌক্তিক দয়া ‘ব্যতিক্রম।’ কুলির মারতে আসাই স্বাভাবিক, সুতরাং সওদাগর জলের পাত্রকে পাথর ভেবে ভুল করতেই পারে, ফলে আত্মরক্ষার তাগিদেই এই খুন। নির্দোষ সাব্যস্ত হয় সওদাগর, দোষী চিহ্নিত হয় খুন হয়ে যাওয়া কুলিটি, ওর অসহায় স্ত্রীর নালিশ নাকচ করে আদালত!
১৯৮০ সালের নান্দীকারের প্রযোজনায় ‘ব্যতিক্রম’ একশোর বেশী বার অভিনীত হয়েছিল, তাকেই আধুনিক মোড়কে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন নির্দেশক রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন সোহিনী সেনগুপ্ত, অভিনয়ে দলের তরুণ সদস্যরা। নিরাভরন মঞ্চ (দেবব্রত মাইতি), দুএকটি প্রয়োজনীয় উপকরণ, পোস্টার, ওপ্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে স্থান, কাল, পরিস্থিতি, তুলে ধরা হয়েছে।কোরাসদল দ্বারা নাচ গান ও মূল অভিনেতাদের সাহায্য করেছে। প্রযোজনাটি মূলত নাচ, গান, ও অভিনয়ের একটি কোলাজ। গান এখানে নাটককে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ সাহায্য করে। গানের কথা এখানে সংলাপের পরিপূরক। গৌতম চৌধুরী অত্যন্ত সাধারণ ভাষায়, সাবলীলভাবে অথচ ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ করে গানগুলি রচনা করেছিলেন। অভিনয়ের ব্যাপারে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় সওদাগরের ভূমিকায় সপ্তর্ষি মৌলিকের কথা, তিনি কন্ঠস্বর ও মঞ্চে সাবলীল চলাফেরার মাধ্যমে চরিত্রটি যথাসাধ্য বিশ্বাসযোগ্য করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কুলি (সোমেশ সাহা) ও গাইড (অয়ন ঘোষ) নিজেদের চরিত্র উপস্থাপন করতে বেশ পরিশ্রম করেছেন।
নাটকে আলোর (অভ্রজিত ব্যানার্জি) বিশেষ কারিগরি নেই, অধিকাংশ সময় কিছুটা লো-লাইট ব্যবহার করা হয় যা নাটকের সঙ্গে বেশ সাযুজ্যপূর্ণ। নদী পার হবার দৃশ্যটি সুপরিকল্পিত, আলোর সুন্দর ব্যবহারের সাহায্যে মুহূর্তটি সহজেই দর্শকদের মনে গেঁথে যায়।
নাটকের সুর করেছিলেন বাংলা নাট্য জগতের অত্যন্ত গুণী ও জনপ্রিয় সুরকার প্রয়াত শ্রী দেবাশিস দাশগুপ্ত। তার মূল সুর অপরিবর্তিত রেখে, নতুন করে সঙ্গীতায়োজন করা হয়েছে। অর্কেস্ট্রার সাহায্যে লাইভ মিউজিক পরিবেশন করা হয়েছে। প্রায় সব গান কোরাসে গাওয়া এবং মিউজিক অত্যন্ত উচ্চ গ্রামে থাকায়, কখনও কখনও গানের কথা শুনতে অসুবিধা হয় এবং কোন কোন গানে সুরের লালিত্য ক্ষুন্ন হয়।
একঝাঁক নবীন ও তরতাজা অভিনেতা অভিনেত্রীর কঠোর শ্রম ও আন্তরিকতার মাধ্যমে একটি সফল নাট্য নির্মাণ হল একথা বলা যায়। নাট্য পরিবেশনে আধুনিকতার ছোঁয়া পাওয়া গেল একথাও বলা যায়। তবে মূল আখ্যানটিকে বর্তমান প্রেক্ষিতে সমসাময়িক করে ভাবলে হয়তো আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারত, দর্শকরা চরিত্রের এলিয়েনেশনের সঙ্গে আরো একাত্ম হতে পারতেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই ধরণের নাটক কেন বর্তমানের রাজনীতির কথা বলবে না, তা না বোঝাই থেকে যায়। তাই একটা অপূর্ণতার স্বাদ থেকেই যায়। নান্দীকার তাদের দীর্ঘ সময়ের কাজের মাধ্যমে নিজরাই নিজেদের একটা উচ্চতা নির্মাণ করেছেন। এই প্রযোজনা সেই উচ্চতা থেকে সামান্য হলেও একটু নিচুতে অবস্থান করছে।
ব্রেখট নিজে শুধু মার্কসবাদীই ছিলেন না, তিনি মনে করতেন মার্কসবাদী না হলে নাট্যকারই হওয়া যায় না। এই দর্শনকে বিশ্বাস করে তিনি তার সমস্ত রচনা করে ছিলেন। আজ বিশ্বজুড়ে যখন মার্কসবাদী শক্তি প্রায় ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে তখনও ব্রেখটের নাটকের প্রযোজনার তগিদ কিছু কম হয়নি। বিশেষত যখন দেখি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অপরাধ করে দেশে অথবা বিদেশে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন এই নাটকের বিচার দৃশ্যটি আলাদাভাবে মনে দাগ কেটে যায়।