বুকঝিম এক ভালোবাসা নাট্যের প্রতিপাদ্য বিষয় যদি একটি বাক্যে প্রকাশ করতে হয় তাহলে আমরা বলতে পারি মধ্যযুগের বাংলায় বারো ভুঁইয়াদের শাসনকালের একটি বিয়োগান্ত ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী এটি। হায়দার নামক এক প্রান্তিক, গরীব চাষীর ভাই মনসুর বয়াতি, যে গান বাঁধে আর গায়, তার প্রেমে পড়ে যায়প্রবল প্রতাপশালী এক ভুঁইয়া মহব্বতজং-এর বোন চাঁদ সুলতানা। স্ত্রী নূরজাহানের আপত্তি সত্ত্বেও মহব্বতজং শঠতা করে চাঁদের বিয়ে দিয়ে দেয় আরেক রাজা ফিরোজ শাহের সাথে, এবং প্রাণে না মেরে মনসুরকে অন্যভাবে মেরে ফেলে বিষ খাইয়ে তার কন্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিয়ে। হায়দার’ও মারা যায় মহব্বতজং-এর সেনাদের হাতে। ফিরোজ শাহ্ যখন জানতে পারে চাঁদ সুলতানা ভালোবাসে মনসুরকে, তখন সে উদ্যোগী হয় মনসুরের কন্ঠস্বর ফিরিয়ে দিতে, তথা প্রেমিক যুগলের মিলন ঘটাতে। কিন্তু মনসুর ও চাঁদ দুজনেই প্রাণত্যাগ করে এবং শেষে থেকে যায় কেবল ফিরোজ শাহ্ এবং মনসুরের শিষ্য আবুল, যে বয়ে নিয়ে চলে তার মৃত গুরুর গানের ধারা। আমাদের দেশের বহু লোকনাট্যে, লোকগানে এই ধরণের বিয়োগান্ত প্রেমাখ্যান আমরা পাই ঠিক’ই, কিন্তু বেশ কিছু কারণে একুশ শতক নাট্যদলের উপস্থাপনাবুকঝিম এক ভালোবাসা যেন কিছু চেনা ছক ভাঙতে প্রয়াসী হয়। প্রয়াস যে পুরোটাই সফল হয়েছে তা নয়, তবে সে কথায় আসব একটু পরে।
Kaahon Theatre Review
KOJAGORI: THE SUCCESS OF DISCIPLINE AND COLLECTIVE EFFORT#bengalitheatre | #theatre |#kaahontheatrereview pic.twitter.com/F7nyJ5TCzY— kaahon (@kaahonwall) June 30, 2017
আজকের বাংলা নাটকের জগত তারকা ও বৃহৎ নামের ইন্ধনে চালিত, সরকারী গ্রান্টে পুষ্ট। নাটক তৈরীর এই পরিচিত ছকটাকেই শ্রমণ চট্টোপাধ্যায় (নির্দেশক-অভিনেতা) চ্যালেঞ্জ করেন নানাভাবে। এই নাট্যে কোন তারকা অভিনেতা নেই, মঞ্চসজ্জার, প্রপের, আলোর, গানবাজনার, পোশাকের আতিশয্য দিয়ে জমজমাট নাট্য সাজানোর চেষ্টা নেই। নেই প্রথাগত নাট্যরূপ দেওয়ার তাগিদ। সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস বুকঝিম ভালোবাসা প্রায় অপরিবর্তিতভাবেই মঞ্চে হাজির করা হয়। বাহুল্য বর্জন করে বেছে নেওয়া হয় এক মিনিমালিস্ট অভিনয়রীতিকে। সবক’টি চরিত্র, কি পুরুষ, কি নারী শ্রমণ একাই ফুটিয়ে তোলেন, বাচনভঙ্গির, চলনভঙ্গির বা দৃষ্টিপাতের খুব সামান্য হেরফের করে। এ ধরণের নির্মাণ যে আমরা আগে দেখিনি তা নয়। সকলেরই মনে পড়বে শাঁওলী মিত্রের নাথবতী অনাথবৎ বা গৌতম হালদারের মেঘনাদবধ কাব্যের কথা। তবে খুব অল্প করেও অভিনন্দনযোগ্যভাবে অনেকটা বলে দিতে পেরেছেন শ্রমণ। তিনি ঠিক কি করতে চাইছেন, কেমনভাবে তিনি তা করবেন, তা করতে গেলে কি কি রসদ লাগবে – এসব সম্পর্কে নির্দেশক-অভিনেতা শ্রমণের স্ফটিকস্বচ্ছ ধারণা এবং যা করণীয় তা সমাধা করার নিজের (ও তার দলের) ক্ষমতার ওপর অটল আস্থা, আমাদের বাধ্য করে শ্রমণ ও তার সহনির্মাতাদের কুর্নিশ জানাতে।
গায়েন মনসুর বয়াতি ও রাজ পরিবারের কন্যা চাঁদ সুলতানার প্রেমের যে আখ্যান মঞ্চায়িত হয়, খুব স্বাভাবিক কারণেই তাতে গান বিশেষ গুরুত্ব পায়। তাই গান নিয়ে কিছু কথা। বুকঝিম এক ভালোবাসা নাট্যের গানে বয়াতি উচ্চারণ ও গায়নরীতি অনুসরণ বা অনুকরণ কোনটাই সে অর্থে করা হয়নি; যন্ত্রানুষঙ্গে দিব্যি বেজেছে ব্যাঞ্জো ও গিটার। যেভাবে একজন একুশ শতকের কলকাতার উচ্চশিক্ষিত শিল্পীর কাছে বেশ কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা গান পৌঁছয় এবং তারপর তার নাগরিক চেতনার ও বোধের রসে জারিত হয়ে নেয় এক নতুন চেহারা, সেভাবেই গাওয়া হয়েছে নাট্যের গান। এর ফলে গানের হাত ধরে এ সময়ের দর্শকরা নাট্যের সাথে অক্লেশে সংযুক্ত হতে পেরেছেন শুধু তাই নয়, ঘটেছে আরো একটা ব্যাপার যা উল্লেখ না করলেই নয়। প্রাচীন লোকগান যেহেতু আসলে মৌখিক ঐতিহ্যের (ওরাল ট্র্যাডিশন) অন্তর্গত, সেহেতু সেই ঐতিহ্যের নিয়ম মেনে এই গান নিজের শরীরে কালের ও স্থানের চিহ্ন মেখে মেখে চলতে থাকে, পরিবর্তনের পরতের পর পরত বয়ে। এই নাট্যে শ্রমণদের গাওয়া গান অবশ্যই এই ধারার গানের শরীরের ওপর পেতে দেয় আরেকটা নতুন পরত। একটি উপন্যাসের দরজা খুলে শ্রমণরা যেভাবে ঢুকে পড়েন মৌখিক ঐতিহ্যের অন্দরে এবং সেখানে রেখে যান নিজেদের ছাপ, তা আমাদের অবাক ও মুগ্ধ করে। এই সময়ের অন্যতম গায়ক, সঙ্গীত গবেষক মৌসুমী ভৌমিক সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে লোকগানের ভৌগোলিক উৎপত্তি, সে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে ‘যথাযথ’ উচ্চারণ এবং প্রামাণিকতার (অথেন্টিসিটি) বিষয়ে যা লিখেছেন (http://www.thetravellingarchive.org/journey.php?id=3), তার প্রায় সবটাই বুকঝিম এক ভালোবাসা নাট্যের গানের ক্ষেত্রে খাটে। স্থানাভাবে এই প্রবন্ধ থেকে সবিস্তারে উদ্ধৃতি না দিতে পারার জন্য মার্জনা চেয়ে কেবল একটি বাক্য তুলে দি এখানে – “শ্রোতা নিলে, ভিতরে নিলে, খোলা মনে নিলে তবেই গান হয়। তখনই গান যথাযথভাবে ‘উচ্চারণ’ করা যায়– ইয়ু ক্যান আটার দ্য সঙ”। এখানে মৌসুমী ভৌমিক উচ্চারণ শব্দের সেই মানেটা ধরতে চাইছেন যা তথাকথিত ‘যথাযথ’ উচ্চারণের বিধি ছাপিয়ে হয়ে যায় একজন শিল্পীর মননের উন্মোচন। এই বিশেষ অর্থে, শ্রমণ ও তার সাথীদের নাট্যে গাওয়া গান যে উচ্চারণ হয়ে উঠেছে, নিছকই নিয়মমাফিক গাওয়া গান হয়ে থেমে না থেকে, তা স্বীকার করতেই হয়। অকুন্ঠ প্রশস্তি করছি এই নাটকের সঙ্গীতের সাথে যুক্ত সকলের – শুভদীপ গুহ (সঙ্গীত পরিচালক), ইন্দ্রদীপ সরকার, চক্রপাণি দেব, জয়ন্ত সাহা, সুশ্রুত গোস্বামী, শ্রমণ ও তার সহঅভিনেতাদ্বয়, সর্বজিৎ ঘোষ এবং সুহানিশি চক্রবর্তী ।
এই নাট্যে/উপন্যাসে সৈয়দ শামসুল হকের ভাষা যেন একটি উপস্থিতি হয়ে ভরিয়ে তোলে মঞ্চ। মনসুর, চাঁদ সুলতানা, আবুল, হায়দার, মহব্বতজং, নূরজাহান, ফিরোজ শাহ্ প্রভৃতি চরিত্র তাদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব ও বিশিষ্টতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ভাষায়, যেমন প্রকাশিত হয় এই মানুষগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন। রাজার মহল, চাষীর কুঁড়ে, গরীবের নিষ্ফল রাগ, পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপে দমবন্ধ হয়ে আসা নারীর অস্তিত্ব এসবকিছু দিয়ে গড়া মানবসমাজ এবং মাঠ, জঙ্গল আর অবশ্যই ব্রহ্মপুত্র নিয়ে তৈরী প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল, তার সবটাই দৃশ্যকল্প-সমৃদ্ধ এই ভাষা মেলে ধরে।
মিনিমালিস্ট এই প্রযোজনা নাট্যনির্মাণের বেশ কিছু চেনা ছক ভাঙ্গার যে প্রয়াস করেছে তা সম্পূর্ণতা কেন পায় নি সে কথায় আসি। অনুজ বন্ধু, প্রাবন্ধিক প্রিয়ক মিত্র বুকঝিম এক ভালোবাসা নিয়ে একটি অবশ্যপাঠ্য লেখা লিখেছেন (https://goo.gl/EmPAo4), যে লেখা আমাকে শিক্ষিত করেছে; সেই লেখার কেবলমাত্র একটি অংশের সাথে আমার দ্বিমত থাকবে। প্রিয়ক এই নাট্যে আলো (চন্দন দাস) ও মঞ্চ (কৌস্তভ চক্রবর্তী, অনির্বাণ চক্রবর্তী) যেভাবে অর্থবহ হয়ে উঠেছে তা বলেছেন – আমি এর বিপ্রতীপে বলব এই নাট্য চাইছিল একদম স্থির আলো, শুধুমাত্র দৃশ্যমানতার প্রয়োজন মেটানোর জন্য, এবং একটি অচিহ্নিত পশ্চাৎপট। যেখানে কেবলমাত্র শরীর ও কন্ঠ দিয়ে এতকিছু করা গেলো, সেখানে প্রথাগত আলোর ব্যবহার –বহমান জলরাশি বোঝাতে ঢেউ-তোলা নীল আলো ও মৃত্যু বোঝাতে লাল –এবং কিছুটা বিমূর্ত, কিছুটা সাঙ্কেতিক রঙ, রেখা সম্বলিত পশ্চাৎপট যেন গতানুগতিক নাটুকে অতিশয়োক্তির হাত ধরে ফেলে। বর্তমানের একজন বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক ও নির্মাতা, সুবোধ পট্টনায়ক, স্থির আলো ব্যবহার কেমনভাবে ও কেন করে চলেছেন তা বিশেষত এই প্রযোজনার ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। দ্রষ্টব্য – https://goo.gl/Psqrrj
শেষ করব আরো একটি কথা বলে। এটা সত্য যে কাহিনীর কাঠামো ও লোকগানের ধারা (যেখানে একজন গায়েন অনেকের কন্ঠে গান করেন) একক পারফরম্যান্স অনুমোদন করে। এও অনস্বীকার্য যে শ্রমণ মস্তিষ্ক ও হৃদয় উজাড় করে পারফর্ম করেন। কিন্তু, থিয়েটার মিডিয়ামের কথা মাথায় রেখে এই ভাবনা জাগে – অনেকে মিলে অভিনয় করে কি বুকঝিম এক ভালোবাসা মঞ্চায়িত করা যেত না? সহঅভিনেতারা যখন তাদের স্বল্প অথচ গুরুত্বপূর্ণ পার্ট করেন, তখন এই প্রশ্নটা যেন খুব বেশি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
পুঃ – মনসুর, চাঁদ ও ফিরোজের ত্রিকোণ প্রেম আমাদের নিঃসন্দেহে মনে করিয়ে দেবে সঞ্জয় লীলা বানসালি-র “হম দিল দে চুকে সনম” চলচ্চিত্রের কথা। সমস্ত চলচ্চিত্র জুড়ে একের পর এক অত্যন্ত জমকালো নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরী করা না হয় বাদ দিলাম, শুধু খেয়াল করতে অনুরোধ করছি চলচ্চিত্রের শেষে কেমনভাবে স্ত্রী-কে স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে একই সাথে বিয়োগান্ত আখ্যানকে করে দেওয়া হয় মিলনান্ত এবং বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের ভিত শক্ত করা হয়। উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির পরিমণ্ডলে শিল্প শুধু আকর্ষণীয় ভোগ্যপণ্য নয়, তার কাজই হচ্ছে একটা অনন্ত ‘ফিল গুড’ পরিবেশ তৈরী করে ভোগ করার ইচ্ছেটাকেও জাগিয়ে রাখা, যেখানে বিয়োগান্তের জায়গা নেই, যেখানে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশ্নের মুখে পড়ে না। বুকঝিম এক ভালোবাসা নাট্য মনসুর, চাঁদ ও ফিরোজের দুঃখময়, অ-সামাজিক প্রেমের গল্প অতিরঞ্জিতভাবে না বলে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা হলেও যেন দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে যুগের হাওয়ার বিরুদ্ধে।
দীপঙ্কর সেন