বাংলা থিয়েটারে পুরনো গল্প উপন্যাস নাটক সিনেমাকে মঞ্চস্থ করার ট্রেন্ডে নতুন এক সংযোজন হল কার্টেন কলের নতুন নাটক ‘ভুনিবাবুর চাঁদনী’। অস্কার ওয়াইল্ডের বিখ্যাত ছোট গল্প ‘দ্য ক্যান্টারভিল ঘোস্ট’ থেকে এই নাটকটি লিখেছেন শর্মিলা মৈত্র। নির্দেশনা দিয়েছেন তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। এই গল্পটা হলিউড, বলিউড, রেডিও, টেলিভিশন মিলিয়ে এতবার অভিনীত হয়েছে যে প্লট লাইন নিয়ে ডিসকাস করার দরকার পড়ে না। (উপরন্তু প্লট লাইনটা বলে দিলে আপনি নাটকটা দেখতেই বা যাবেন কেন?) তবে এটুকু বলাই যায়, এই ভূতের গল্প মোটেই ভূতুড়ে নয়, বরং খুব মজার এবং এই গল্পের শেষটা বেশ একটা মরালিস্টিক এন্ডিং এর মত।
এই গল্পে ভূতের সংখ্যা দুই। এক ভুনি বাবু, দ্বিতীয় তাঁর শাগরেদ। গোটা নাটকটা আসলে এই দুই ভূতের কিছু মানুষের সাথে হওয়া ইন্টার্যাকশন দিয়ে সাজানো। এর মধ্যে আবার অনেক বছরের পুরনো একটা বাগানবাড়ির ব্যাপার আছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে নাটকটার মধ্যে নতুন আর পুরনোর দ্বৈরথের মত একটা ব্যাপার আছে। নতুন কেমন করে পুরনোকে ভিরমি খাইয়ে নিজের নতুনত্ব প্রকাশ করে, আর পুরনো কিভাবে পুরনো হলেও বলে যায় মনুষ্যত্বের আসল কথা গুলো… শেষ পর্যন্ত অবশ্য নতুন পুরনো মিলে মিশে জয়ী হয় মানুষের সেন্সিসিটিভিটি আর ইমোশন। ইনফ্যাক্ট, অস্কার ওয়াইল্ডের বেশীরভাগ গল্পের মধ্যেই যে এই মানবতা, এই সেন্সিসিটিভিটি পাওয়া যায়, সেটা কারুরই অজানা নয়।
Previous Kaahon Theatre Review:
গৌতম হালদার এবং গম্ভীরা ভট্টাচার্য খুব মন দিয়ে নিজেদের ভৌতিকতা প্রকাশ করার চেষ্টা করে গেছেন। যদিও নাটকের বেশ কিছু দৃশ্য আজকের দর্শকের কাছে বেশ মোটা দাগের এবং খুব স্পষ্ট ভাবে অ্যান্টিসিপেট করা যায় বলে বেশ বোরিং, তাও কিছু কিছু মুহূর্তে দুই ভূত মিলে কিছু নাট্যমুহূর্ত তৈরি করতে পেরেছেন। স্পেশালি, আবির্ভাবের (আবির্ভাবই বটে!) সময় গৌতম হালদারের বিসর্জন নাটকের চরিত্র রঘুপতির ডায়লগ বলতে বলতে প্রকট হওয়া এক ধরণের অভিনেতা স্পেসিফিক কমিক ইনকংগ্রুইটি তৈরি করে কারণ রঘুপতির তাঁর পুর্বাভিনীত এক বিখ্যাত চরিত্র। অবশ্য “কে বলিল হত্যাকান্ড পাপ, এ জগৎ এক মহা হত্যাশালা” জাতীয় ডায়ালগও নাট্যকার শর্মিলা মৈত্র বেশ ভেবেচিন্তেই মজা তৈরি করার জন্য ব্যবহার করেছেন কারণ নাটকের গল্পের শিকড় লুকিয়ে রয়েছে এক হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই।
গৌতম হালদারের বিখ্যাত ম্যানারিসম তাঁর চরিত্রের সাথে খুব ভালো ভাবে মানালেও কোথাও কোথাও বহুল ব্যবহারে ক্লান্তিকর মনে হয়। তাঁর অভিনীত নাটকগুলি দেখলে আজকাল মনে হয় নির্দেশকরা তাঁর ম্যানারিসমকে ব্যবহার করার জন্যই তাঁকে ওই চরিত্রে নিতে চেয়েছেন। তাঁর মত এনার্জির ব্যবহার জানা অতুলনীয় সেন্সিসিটিভ অভিনেতাকে চরিত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে খুব কম নির্দেশককেই দেখা যায়। অবশ্য একথা ও বলতে দ্বিধা নেই যে তাঁর মত বিশাল মাপের অভিনেতাকে ব্যবহার করার মত নির্দেশকও বাংলা থিয়েটারে হাতে গোনা। শাগরেদ ভূত গম্ভীরা ভট্টাচার্য খুব সাহস করে অথচ পরিমিতি বোধের সাথে গৌতম হালদারের পাশে পাশে অভিনয় করার চেষ্টা করে গেছেন, এই প্রচেষ্টার জন্য তাঁর সাধুবাদ অবশ্যই প্রাপ্য।
আরও সাধুবাদ প্রাপ্য মঞ্চ ডিজাইন করেছেন যিনি, সেই অরুণ মণ্ডলের। সৌমিক-পিয়ালির দ্বৈত মঞ্চ সজ্জা বেশ কিছু নাটকে এখনও একরকমের ভালোলাগা তৈরি করে রেখেছে। বহুদিন পরে এই নাটকেও এমন একটা মঞ্চ দেখতে পাওয়া গেছে যা একই সঙ্গে নাটকের সুপারন্যাচারাল থিম, কমিক টোন এবং এক্সাজারেটেড মুডকে দারুণ ভাবে কমপ্লিমেন্ট করে। বিশেষত বেশ কিছু জায়গায় বিশাল বাগান বাড়ির উপরের জানলার একটা ভাঙ্গা কাঁচ মাঝে মধ্যে হাওয়ায় দুলে ওঠে, যদি সেটা সত্যিই এরকম ডিটেইলে প্ল্যান করা হয়ে থাকে (যদি কোন টেকনিক্যাল ফল্ট না হয়), তাহলে থিয়েটারের একনিষ্ঠ ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে আমাদের ভাবতে ভালো লাগবে, এখনও কিছু কিছু লোক এত সিরিয়াসলি এত ছোট ছোট ডিটেইলিং নিয়েও ভাবতে চায়!
কিন্তু এতকিছুর পরেও, বলতেই হয় আর কতদিন পুরনো লেখালিখি থেকে ইন্সপায়ার্ড হয়ে বাংলা থিয়েটার এগোবে? অনেকে প্রশ্ন করেন কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে নাটক করলে তা নতুন নাটক নিয়েই করতে হবে? পুরনো লেখা নিয়ে নতুন নাটক করলে আপত্তি কোথায়? আপত্তির কোন জায়গা নেই, কিন্তু নতুন নাটক, নতুন লেখক ছাড়া একটা দেশের নাট্য সংস্কৃতি কিভাবে উৎকর্ষ লাভ করবে সে প্রশ্নের উত্তরও কেউ দেন না। পুরাতন আমাদের শিক্ষা দেয়, বহমান এক সংস্কৃতির শিক্ষা, কিন্তু তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব, নতুনের মত করে বদলে নেওয়ার দায়িত্ব পড়ে নতুনের হাতেই। একটা সময় ভুনিবাবু চলে যান, তাঁর চাঁদনী থেকে যায় নতুনের হাতে, নতুনের আদর যত্ন আর ভালবাসায়।