‘থিয়েলাইট’ গ্রুপের নাট্য প্রযোজনা ‘ভয়’, নাট্যকার – ব্রাত্য বসু, পরিচালনা – অতনু সরকার; প্রথম অভিনয় হয়ে গেল ৩১শে জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যায়, মিনার্ভা থিয়েটারে।
নাটকের প্রথম দৃশ্যে দেখা মেলে এক জোড়া স্বামী-স্ত্রীর, তারা সারান্ডার জঙ্গলে বেড়াতে এসেছেন, ফরেস্ট বাংলোর ম্যানেজার তাদেরকে বাংলোর ঘরে নিয়ে এসেছেন। নাটক বা সিনেমায় হোটেলের ম্যানেজারের রোল মানেই মোটামুটি ভাবে কমেডি বলে ধরে নেওয়া যায়, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু স্বামীটিও যখন কৌতুকাভিনয় করতে থাকেন তখন এরা আসল স্বামী-স্ত্রী কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে। ম্যনেজারের কথা বার্তায় আভাস পাওয়া যায় যে বাংলোতে ভয় পাবার মতো কিছু একটা ব্যাপার আছে – কিন্তু সেটা কি ‘ভূত’, না ‘মাওবাদী’? ম্যানেজার দুবছরের পুরনো একটা কাহিনী শোনান, বাংলো থেকে এক যুগলের নিরুদ্দেশ হবার কাহিনী, জানা যায় যে যুগলের একজনের বাড়ি ‘সিঙ্গুর’, অন্যজনের ‘নন্দীগ্রাম’!!!! এইসব দিয়ে নাটক শুরুর প্রথম দশ বারো মিনিটের মধ্যেই নাটকটা দর্শকদের বেশ খানিকটা প্যাঁচে ফেলে দেয়। নাটকটা ঠিক কী নিয়ে হতে চলেছে সেই বিষয়ে দর্শক দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েন!
Previous Kaahon Theatre Review:
একটি দশ মিনিটের বিরতি সহ আনুমানিক দু’ঘণ্টার এই নাটকের পুরো সময়টা জুড়ে এই কাজটাই সুচারুভাবে হতে থাকে। দর্শককে সবদিক থেকে গুলিয়ে দেওয়া হয় – যাতে তারা কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারেন! বৈশিষ্ট্যগতভাবে এটা সেই ধরণের নাটকগুলোর মধ্যে পড়ে যেখানে এক বা একাধিক চরিত্র স্বপ্নে বা কল্পনায় নিজের অতীতের মুখোমুখি হয়।সেই অতীত আর বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে একটা প্রবল দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। নাটকের শেষে গিয়ে সেই দ্বন্দ্বের নিরসন হয়, আর চরিত্রটি বা চরিত্রগুলির বোধোদয় ঘটে। এখানেও স্বামী চরিত্রটি, অর্থাৎ শুভঙ্করের সঙ্গে দেখা হয় ‘ভূত’রূপী অতীতের (তাকে অবশ্য পেত্নী বলাই শ্রেয়)। দর্শক-মনোরঞ্জনের উপযোগী চোখা-চোখা সব বাক্যবাণ বিনিময় হয়। শুভঙ্করের রাজনৈতিক অতীতের সূত্র ধরে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে, বিশেষ করে বলতে গেলে মার্কসবাদী কমুনিস্ট পার্টির চিন্তাধারাকে, প্রবলভাবে তিরস্কার করা হয়–মনে হয় যেন এই কথাগুলো চিৎকার করে বলার জন্যই নাটকটির রচনা, আর আনুষাঙ্গিক সমস্ত কিছুর আয়োজন! বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ঐ গতানুগতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণের শূন্যগর্ভ আস্ফালনের সঙ্গে সঙ্গে শুভঙ্করের আইডেন্টিটি নিয়েও একটা বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়; শুভঙ্কর আসলে একটি, দুটি, নাকি তিনটি চরিত্র, এই প্রশ্নে দর্শককে ধাঁধায় ফেলা হয়। মিস পেত্নী যখন তার সঙ্গে শুভঙ্করের আপাত বিশ্বাসঘাতকতা (জীবন ও রাজনীতি দুই ক্ষেত্রেই) নিয়ে এইসব আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তখনই কোনো এক মিঃ ভূত, শুভঙ্করের স্ত্রী অর্থাৎ সীমাকে তার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা শুনিয়ে ভয় দেখিয়ে চলেন। তারপর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টেনশন আর দোষারোপের পালা, বোধোদয়, আপোষ এবং সামান্য কৌতুকের সঙ্গে টেনশনের পরিসমাপ্তি! নাটক শেষে ভূতদ্বয়ের পরিচয়ও স্পষ্ট করা হয়না, দর্শকদের জন্যই ছেড়ে রাখা হয়। এই কথোপকথন নাটকীয় বাস্তব না স্বপ্ন, সেটা নিয়েও থেকে যায় ধোঁয়াশা। এই বিভ্রান্তি তৈরি করাটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিনা, অর্থাৎ ‘এইসময়ে দাঁড়িয়ে সকলেই বিভ্রান্ত’ – এমন কোনও বক্তব্য নাটকের আছে কিনা, সেটা নিয়েও নিশ্চিত হওয়া যায় না!!
নাট্যনির্মাণেও রয়ে যায় এই বিভ্রান্তির ছাপ! শুভঙ্করকে দেখে মনে হয় তিনি বছর তিরিশের যুবা। কিন্তু সব হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে যায় যখন জানা যায় যে শুভঙ্করের ছাত্র জীবনে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হয়েছিল! এই বিভ্রান্তির অবসান হয় নাটকের শেষে কার্টেন-কলের সময়, যখন জানতে পারা যায় যে নাটকটি আসলে ২০০৮ সালের রচনা। সঙ্গে এই রহস্যেরও অবসান হয় যে কেন রাজনৈতিক বক্তব্যগুলোকে এত আরোপিত আর অপ্রাসঙ্গিক লাগছিল! ঐ বক্তব্যগুলোকে জেনেরালাইজ করে অবশ্যই নাটকটিকে বর্তমান সময়ে এনে ফেলা যেত, কিন্তু সেই সাহস নির্মাতাদের নেই। এই অস্থির সময়ে নিরুপদ্রবে যা করা সম্ভব তারা তাই করতে চেয়েছেন। মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্ত দর্শককে লক্ষ্য করে মুচমুচে কথার পৃষ্ঠে কথা সাজিয়ে গড়ে তোলা একটা রোমাঞ্চকর নাটক, তার মাঝে ঐ বিশেষ শ্রেনীর অপরাধবোধ ও আত্মসমালোচনা, আর মামুলি কিছু রাজনৈতিক কথাবার্তা দিয়ে একটা ছদ্ম-গাম্ভীর্য তৈরি করা হয়েছে। এই কপটতার কারণে নাটকটি দর্শকদের কোথাও স্পর্শ করতে পারে না। লিঙ্গভিত্তিক পাঠের নিরিখেও নাটকটি হতাশজনক – কাহিনীর কেন্দ্রে থাকেন পুরুষরা আর মহিলা চরিত্রগুলো হয়ে ওঠে তাদের স্যাটেলাইট। তার ওপর মহিলা চরিত্রে নেগেটিভিটির উণ্মেষ বোঝাতে তাকে দিয়ে ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলানো বেশ একটা সাদা মাটা চিন্তাভাবনার পরিচায়ক।
অভিনয়ে সকলেই শিক্ষিত, পরিশীলিত, কিন্তু অভিনয়ের স্টাইল সেই পুরনো কালেই আটকে পড়েছে; ‘এটা থিয়েটার’ – এই ব্যাপারটা অভিনয়ের স্টাইলে খুবই প্রকট। এরই মধ্যে অভিনেতা সন্দীপন চ্যাটার্জী শুভঙ্করের চরিত্রের বিভিন্ন শেড বিশ্বস্ততার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন। চরম উত্তেজনার মুহূর্তগুলো বা দরাখলে তার অভিনয় বেশ স্বাভাবিক। মিঃ ভূতরূপী অশোক মজুমদার ল্যাপেল ব্যবহারের সুযোগে কিছুটা স্বাভাবিক বাচন ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, কিন্তু কখনো কখনো আবার পুরোনো স্টাইলে ফিরে গেছেন। বাস্তবানুগ মঞ্চ ভাবনাতেও গতানুগতিকতার ছোঁয়া, কিন্তু এরা পুরো মঞ্চটিকে ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন। সঙ্গীত ভাবনা সাধারণ মানের, বরং আলোকভাবনা এবং আলোকসম্পাত কিছুটা আকর্ষণীয় ও উপযুক্ত। শুভঙ্কর ও সীমার সঙ্গে ভূতেদের সমান্তরাল আলোচনার দৃশ্যে ফ্ল্যাশব্যাক ও ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডের ভাবনা চমকপ্রদ। তবে সব মিলিয়ে একটা আলগা স্মার্টনেস থাকলেও প্রযোজনা হিসাবে বেশ সাধারণ মানের। হালকা কমেডি, চতুর সংলাপ, আর আপাত-সিরিয়াসনেসের কারণে দর্শক আনুকূল্য পেতে পারে, কিন্তু বৃহত্তর নাট্যচর্চার নিরিখে একচুলও এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে বলে মনে হয়না।