বালী প্রভাত নাট্য সংস্থা তাদের প্রযোজনা ভূতাণ্বেষী’র (script, concept and execution- ইনু চক্রবর্তী) মাধ্যমে বাংলা নাট্যচর্চার একটি প্রাচীন প্রশ্নের উত্তর দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। প্রশ্নটি এই – কি করলে নাটক চলবে? এই প্রশ্নটি এভাবে রাখলে নাট্যচর্চার একটি একেবারে গোড়ার কথা চলে আসে এবং তা হল, নাটক করা কেন? নাটক কি এজন্য করা যাতে তার মাধ্যমে কিছু শৈল্পিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কথা/দর্শন ব্যক্ত করা যায়, নাকি নাটক এজন্যই করা যাতে সে নাটক বহু দর্শক দেখেন, নাটক হয় হিট্? যারা বিশ্বাস রাখেন প্রথম ধরণের করায়, তারাও নিশ্চিতভাবে চেয়ে থাকেন দর্শক – প্রচুর দর্শক – তাদের নাটক দেখুন। তবে তারা খেয়াল রাখার চেষ্টা করেন তাদের নাটকের ও নাট্যের টেক্সটে অপ্রয়োজনীয়ভাবে এমন সেসব উপাদান না নিয়ে আসার, যা সাধারণভাবে দর্শক টানার পরিচিত মাল মশলা হিসেবে বহুকাল ধরেই চিহ্নিত। আর অন্যদিকে যাদের সোজাসাপ্টা উদ্দ্যেশ্য দর্শককে নাটক খাওয়ানো, তারা সেভাবেই রাঁধতে বসেন তাদের নাট্যচচ্চড়ি। এখানে কোন দ্বিধা না রেখেই বলে রাখা দরকার যে একটি নাটক যদি খুব চলে দীর্ঘদিন ধরে, যদি সে নাটক করে দল ও সদস্যরা আয় করতে পারেন অনেকটা অর্থ, তাতে কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয় – অন্তত বর্তমান সমালোচকের তো কোন আপত্তিই নেই। তবে ভূতাণ্বেষী’র ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা কারণ দর্শকের মনোরঞ্জেনের জন্য তৈরী এই নাটকটির কয়েকটা মূলগত সমস্যার দিক আছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ফিরতে হয় সেই প্রশ্নে – কি করলে নাটক চলবে?
এই প্রশ্নের যে সহজসরল উত্তর প্রভাত নাট্য সংস্থা দিয়েছেন তা হল নাটককে সিনেমা বা সিরিয়াল গোছের কিছু একটা বানিয়ে দাও, তাহলেই নাটক চলবে। নির্মাতারা ধরে নিয়েছেন দর্শক এতটাই সিনেমায় টিভিতে মজে আছেন যে নাটককে সিনেমা করে দিলে দর্শকের পছন্দ হওয়ার সুযোগটা একলাফে অনেকটা বেড়ে যাবে। কিভাবে ভূতাণ্বেষী নাটক সিনেমা হয়ে ওঠে? হালের বাংলা সিনেমায় সবচেয়ে বিক্রিযোগ্য প্রপার্টি ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে বানানো নাটকের পোস্টারে, টিকিটে প্রথমেই চোখে পড়ে,‘Timir Chakraborty presents…’। ইনি এই নাটকের একজন অভিনেতাও, কিন্তু সব ছাপিয়ে তিমির চক্রবর্তীর ভূমিকা প্রোডিউসারের। অর্থাৎ, ধরে নেওয়া যায় ইনি নাটকে টাকা ঢেলেছেন, বা লগ্নি করেছেন, আর লগ্নি তো করা হয় লাভের আশায়…।
পোস্টারে আরো যদি চোখ রাখি আমরা, দেখব টাইটেল সঙ্, প্রোডাকশন্ কন্ট্রোল, মিডিয়া পার্টনার ইত্যাদি ব্যাপারগুলো, যা ক্রমাগত ঠেলছে নাটককে সিনেমার দিকে। আর পোস্টারের গোটা বিন্যাস এমন যে পথচলতি কেউ দেয়ালের গায়ে সাঁটা এই পোস্টার দেখে ভুল করে ভেবে বসতেই পারেন যে নতুন সিনেমা এলো; অনুমান করি নির্মাতারা সচেতন ভাবেই চেয়েছেন লোকেরা এই ভাবনাটা ভাবুন। সোশ্যাল মিডিয়াতে এই নাটকের একাধিক বিজ্ঞাপনী ভিডিও ছাড়া রয়েছে যেগুলো নাটকের দর্শকদের সিনেমা দেখতে পাওয়ার লোভ দিয়ে চলেছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে একদিক থেকে দেখলে এই ভিডিওগুলো নাটকের দৃশ্য সম্পর্কে দর্শকদের মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে – ক্যামেরার এমন সব কোণ ব্যবহার করে দৃশ্য পেশ করা হয়েছে যে নাটকের দর্শককে প্রেক্ষাগৃহের ছাদ থেকে উল্টো করে না ঝোলালে সেই ভিস্যুয়াল দর্শক পাবেন না; এমন কিছু খন্ডদৃশ্য প্রোমোশনাল ভিডিওতে আছে যা নাটকে নেই।
Previous Kaahon Theatre Review:
Kaahon Theatre Review
Bhaadrajaa- Research based play, lesser height theatrically
Read this review in English: https://t.co/9FrEq1KCj0#bengalitheatre | #theatre | #theatrereview | #kaahontheatrereview | #KaahonPerformingArts pic.twitter.com/tqLTnxYR4T— kaahon (@kaahonwall) May 14, 2018
নাটকের বাহ্যিকে সিনেমা বানানোর এত আয়োজন যেখানে, নাটকের অন্দরে তা যে আরো বেশি করে থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা বাঙালীরা আত্মপরিচয় নির্মাণ এমনভাবে করেছি যে আমরা যখন আমাদের শিল্পে যৌনতা, হিংস্রতা ইত্যাদি চাই, তখন আমরা তা চাই বুদ্ধিমত্তার মোড়কে আর এই প্রয়োজন মেটে শরদিন্দুর জগতে প্রবেশ করলে, যেখানে হিংস্রতা আছে, আছে যৌনতা, অর্থলিপ্সা, আর আছে বুদ্ধি দিয়ে রহস্য উন্মোচন করা। উপরি পাওনা, শরদিন্দু করলে ক্লাসিকচর্চার শ্লাঘাও অনুভব করা যায়।ভূতাণ্বেষী যে ছিপ ফেলে দর্শক ধরতে চেয়েছে তার নাম শরদিন্দু। তবে শরদিন্দুর একার বাষ্পে নাটক চলবে এই ভরসা করতে পারেন নি নির্মাতারা, আর তাই সেখানে তারা নিজেরাই ঢুকে পড়েছেন। তারা পাল্টেছেন শরদিন্দুর গল্প, এবং এমন জিনিস এনেছেন গল্পে যা খুব পরিস্কার বলে দেয় নির্মাতারা ঠিক কিসের ওপর ভরসা করছেন দর্শক টানতে। কয়েকটা উদাহরণ দেব। ১, সত্যবতীকে হাজির করা হয় এই নাটকে – এবং সত্যবতীর আবির্ভাবের দৃশ্যটি অসাধারণ। লেগিংস ও টি শার্ট পড়া সত্যবতীকে দেখা যায় পেছন দিক থেকে, নীচু হয়ে হাত দিয়ে পায়ের পাতা ছোঁয়ার যোগাসন করতে। তারপর সত্যবতী খুব বেশি সময় মঞ্চে কাটায় না, যে সময়ের মধ্যে কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ব্যোমকেশ দুবার তাকে কোলে টেনে বসিয়ে নিয়ে খেয়াল করে অজিত’ও সেখানে উপস্থিত এবং নাটকের মূল আখ্যানে একবিন্দুও অবদান না রেখে সত্যবতী একসময় বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়। ২, নাটকে খুন হয়ে যাওয়া উমাপতি সেনের কন্যা বৃষ্টির ভূমিকা আখ্যানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাতারা ভাবতে বসলেন এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটির মধ্যে অভিনব কি আনা যায় যাতে আরো দর্শক আসেন; ভেবেচিন্তে তারা আমদানি করলেন একটি বড়লোকের বাড়িতে স্যুইমিং পুলের দৃশ্য, যেখানে দেখা গেল বেদিং রোবে উন্মুক্ত বক্ষ, হুইস্কি পানরত এক পুরুষকে, তাকে পাহারা দেওয়া কালো চশমা পরিহিত গুন্ডাসদৃশ এক বডিগার্ডকে, কিছুক্ষণ পর ব্যোমকেশ, অজিতকে এবং সবশেষে টাওয়ালের কিছুটা আড়ালে কিছুটা প্রকাশ্যে স্যুইমিং কস্টিউম পড়া তন্বী বৃষ্টিকে। ৩, একটি চরিত্র, যার নাম নিমাই হাজরা, তাকে অনেক্ষণ মঞ্চ-সময় দেওয়া হয়, যদিও আখ্যানে তার অবদান যৎসামান্য। নিমাই একজন ‘মেয়েদের মত করে কথা বলা পুরুষ’ (সম্ভবত সমকামী) হিসেবে সামনে আসে, যাতে তাকে নিয়ে স্থূল হাসাহাসি করতে পারেন দর্শকরা। অর্থাৎ এক চামচ গ্ল্যামার, এক চিমটে যৌন সুড়সুড়ি ও বেশ ক’হাতা অত্যন্ত politically incorrect ও offensive নিম্নরুচির হাস্যরস – যা কিনা একধরণের বাংলা সিনেমার বাজার মাতানোর ফর্মুলার কয়েকটি উপাদান – তা দিয়ে বানানো হয়েছে নাটক। মার্ডার মিস্ট্রি হিসেবে মূল গল্পটিও বেশ দুর্বল, তার সবচেয়ে বড় কারণ এই ধরণের উচ্চমানের গল্পের যে প্রাথমিক শর্ত (খুনির পরিচয় সম্পর্কে দর্শককে সংকেত দিতে দিতে গল্পের এগোনো) তা এখানে মানা হয়নি; খুব অন্যায় হবে না এটা বললে যে ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’ শরদিন্দুর ভালো কাজের তালিকায় আসে না। আর, আখ্যানে সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও মানুষের মধ্যেকার লোভ, লালসা ও হিংস্রতার একটু তলিয়ে, একটু গভীর অধ্যয়ন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেন নি নির্মাতারা, পাছে দর্শক পালিয়ে যান।
যে নাটক শুধুই চেয়েছে হাজার হাজার সিনেমায় ব্যবহার করা হিট্ হওয়ানোর বস্তাপচা কিছু পদ্ধতি, প্রকরণ,তন্ত্রমন্ত্র কাজে লাগিয়ে উতরে যেতে, সে নাটকের আলো, মঞ্চ, আবহ খুব স্বভাবিকভাবেই যতটা না টেক্সটের প্রয়োজন মাথায় রেখে তৈরী হবে, তার চেয়ে বেশি তৈরী হবে চমক সৃষ্টির জন্য। এবং ভূতাণ্বেষী’তে হয়েওছে তাই। তার মধ্যে আবার এই সমালোচক যেদিন দর্শকাসনে (তপন থিয়েটার, ৫’ই মে), সেদিন মঞ্চের গঠনতান্ত্রিক সমস্যার জন্য অন্তত দুবার বেশ বড়সড় দুর্ঘটনা প্রায় ঘটছিল। সেদিন কিছু ক্ষেত্রে আলোর প্রক্ষেপণেও সমস্যা ছিল। অভিনয় নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই, এটুকু ছাড়া যে প্রায় প্রত্যেক অভিনেতাই দক্ষতার সাথে তাদের জটিলতাবিহীন একমাত্রিক চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। পরিচিত অভিনেতাদের মধ্যে সুমিত রায়, শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়, প্রসেঞ্জিত বর্ধন, আম্রপালী মিত্র প্রমুখ যেমন নাট্যের দাবীমাফিক কাজ করেছেন, তুলনায় নবাগতদের মধ্যে নজর কেড়েছেন প্রসেঞ্জিত বিশ্বাস ও অনুরণ সেনগুপ্ত।
বেশ কিছুদিন হল একটা সুনির্দিষ্ট প্রচেষ্টা চলছে, মূলত কয়েকজন বরিষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে, নাট্যে সিনেমার চাকচিক্য ও চলন এনে বাংলা থিয়েটারকে লক্ষ্মীপ্রাপ্ত করে তোলার। আগেও বলেছি, আবারো বলি – বহু দর্শকের প্রসাদধন্য হয়ে বাংলা নাটক যদি অর্থবলে বলীয়ান হয়ে ওঠে, তা খুবই আনন্দের বিষয় হবে। তবে মনে হয় না নাটককে সিনেমার মত করে দিয়ে, বা সিনেমার ফর্মুলায় নাটক সাজিয়ে সিদ্ধিলাভ হবে। বর্তমান সময়টা এভাবে চিহ্নিত করাই যায় যে এখন কিছু বাংলা নাটক বাংলা সিনেমার ভূতগ্রস্ত; ভূতাণ্বেষী এমনই এক ভৌতিক সময়ের উৎপাদন। দর্শকরা এই ভূতের গল্পে আচ্ছন্ন হবেন নাকি ভুত তাড়াতে ওঝার ভূমিকায় নামবেন, তা বলবে ভূত নয়, ভবিষ্যত।