‘একুশ শতক’এর প্রযোজনায় ৫ই মার্চ, ২০১৯ তারিখে একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের লেডি রাণু মুখার্জি মঞ্চে অভিনীত হল বাংলা নাটক ‘বাঁশ কেনো ঝাড়ে’, নাটক ও নির্দেশনা ঋষি মুখোপাধ্যায়ের।
‘বাঁশ কেনো ঝাড়ে’ নামটি একটি বাংলা প্রবচনের অংশ বিশেষ, একাধিক সমস্যাকে এক সঙ্গে আহ্বান করা বোঝায়। নামটির মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে নাটকটি হাস্যরসাত্মক! তবে আসলে নাটকটি হাস্যরসের মোড়কে পরিবেশিত একটা মার্ডার মিস্ট্রি। নাটকের মূল চরিত্র, পচা, পেশায় একজন সিকিউরিটি গার্ড, দিনের শুরুতে স্ত্রী ঝিমলির সঙ্গে তার ঝগড়া দিয়ে নাটকের সূত্রপাত। অন্যদিকে পাড়ার চায়ের দোকান, যার সামনে আস্তানা গেড়েছে এক ভবিষৎ বক্তা সাধু ও তার সহকারী, কিন্তু এই সাধু কি আসলে প্রবঞ্চক? ইতিমধ্যে জানতে পারা যায় যে গতরাত্রে নিকটবর্তী মন্দির চত্বরে খুন হয়েছেন এক ব্যক্তি, গ্রামে মাটি কাটার বরাত পাওয়া নিয়ে যার সঙ্গে প্রতিযোগিতা ছিল পচার শ্যালক বল্টুর। তবে কি বল্টুই হত্যাকারী? পারস্পরিক দোষারোপ ও বচসার মধ্যে নিহত হন আরেক ব্যক্তি, নিখোঁজ হন অন্য আরেক জন। রহস্য ঘনীভূত হয়, পুলিশও আসে! অতঃপর শেষ দৃশ্যে গিয়ে সব রহস্যের উণ্মোচন হয়, হত্যাকারী ও ধরা পড়ে।
Previous Kaahon Theatre Review:
নাটকের চরিত্রাবলী এবং ঘটনা প্রবাহ সম্পূর্ণ দেশজ হলেও নাটকটির গঠনে বিদেশী প্রভাব লক্ষ্যণীয়। শুরুর দৈনন্দিন কলহ দৃশ্যে হাস্যরসের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত দেওয়া থাকে। তারপরে সাধু জটাশঙ্করের সংলাপে, সহকারী কালী ও বল্টুর কথোপকথনে কিছু আপাত অসঙ্গতি এমন ভাবে বুনে দেওয়া হয় যে দর্শক সেগুলো সহজে চিহ্নিত করতে পারেন, সেই অনুযায়ী ভাবতে পারেন, এবং এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে নাটকের রহস্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারেন। যদিও রহস্যের সমাধান কিছুটা আকস্মিকভাবেই হয়ে যায়, এবং কিছু প্রশ্নের অবকাশও থেকে যায়, তবুও এটা বলাই যায় যে হাস্যরসাত্মক রহস্যকাহিনী হিসেবে আলাদা করে নাটকটার একটা আবেদন আছে! একটি উল্লেখযোগ্য প্লাস পয়েন্ট হল নাটকটির দৈর্ঘ্য, সমস্ত ঘটনা বেশ দ্রুততায় সংঘটিত হয়, এবং একটি বিরতিসহ নাটকটি দেড়ঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়! নির্মাতারা ধন্যার্হ্য যে তারা আরও কৌতুকাংশ যোগ করে নাটকটিকে দীর্ঘায়িত করার প্রলোভন পরিহার করতে পেরেছেন!
নাটকটি আরেকটি কারণে অভিনন্দন যোগ্য যে এর মধ্যে কোনো প্রিটেনশন বা ভণ্ডামি নেই। নির্মাতারা একটি সহজ সরল মনোরঞ্জন উপহার দিতে চেয়েছেন, এবং পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাতে কোন রকম সামাজিক বা রাজনৈতিক গাম্ভীর্যের মোড়ক দেননি। তবে নাট্যনির্মাণে এমন কিছু কিছু প্রয়োগ করা হয়েছে যা নাটকটি উপভোগের ক্ষেত্রে প্রবল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়! প্রথমেই আসবে অভিনয়রীতির প্রশ্ন! এই নাটকের প্রতিটি অভিনেতা, প্রতিটি অভিনেত্রী, প্রতি মুহূর্তে এমন চিৎকার করে কথা বলেন যে মনে হয় তারা যেন আবদ্ধ মঞ্চে নয়, কোনো খোলা মাঠে অভিনয় করছেন! কৌতুকাভিনয়ের দায়িত্ব ছিল মোটামুটি ভাবে দুজনের উপর – ঝিমলি এবং জটাশঙ্কর – তার মধ্যে ঝিমলি চরিত্রটি প্রাচীন যুগের শ্রুতিনাটকের দজ্জাল গৃহিণীর স্টিরিও টাইপে পর্যবসিত, কখনও তিনি খুন্তি বাগিয়ে স্বামী পচাকে প্রহার করতে উদ্যত, কখনো বা বিলাপ সহকারে ক্রন্দনরতা। অন্যদিকে জটাশঙ্করের অভিনয়দৌর্বল্যর কারণে কৌতুকটা সেরকম মনোগ্রাহী হয় না। মঞ্চভাবনা স্বয়ং পরিচালকের; প্রধানত দুভাগে ভাগ করা মঞ্চ, একদিকে পচা ও ঝিমলির ঘর, সেখানে তক্তাপোষের পেছনে একটি শেল্ফ জাতীয় সামগ্রী চকচকে প্লাস্টিকে সারাক্ষণ ঢাকা থাকে, কারণটা সহজবোধ্য নয়! ঘরের মধ্যে দড়িতে ইস্ত্রি করা জামাকাপড় এমনভাবে ঝোলানো থাকে যে মনে হয় মঞ্চটা অত্যন্ত দায়সারা ভাবে সাজানো হয়েছে। মঞ্চের অন্য অংশটি চায়ের দোকান, সেখানে বাংলা সিনেমার ছেঁড়া পোস্টার দিয়ে অলংকরণের ভাবনা যথেষ্ট যুক্তি সংগত, কিন্তু তারই মধ্যে জনপ্রিয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত পর্ণস্টারের একটি অত্যুজ্জ্বল ছবি বড্ড বেশিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ছবিটি একটু মলিন হলে প্রযোজনার সামগ্রিক স্বার্থ বেশি সুরক্ষিত হবে বলে মনে হয়। স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীতভাবনা সময় বিশেষে প্রয়োজনাতিরিক্ত, যেমন সংলাপে মোটর সাইকেলের অনুসঙ্গ এলে নেপথ্যে তার শব্দ এবং তৎসহ মাইম অভিনয় করাটা বাহুল্য বলে মনে হয়। অবশ্য বাদল দাসের আলো যথাযথ, মঞ্চের দুটি অংশের মধ্যে প্রয়োজনানুগ সংযোগ স্থাপনে সক্ষম। তবে সব মিলিয়ে প্রযোজনাটির মধ্যে একটু সেকেলে উচ্চকিত ছাপ আছে, যা প্রযোজনার মানকে নিম্নাভিমুখী করে।
বাংলা নাটকের জগতে লাইট এন্টারমেইন্টের একটা চাহিদা রয়েছে সেটা অনস্বীকার্য, এবং এই ধরণের নাটক সেই চাহিদা পূরণ করতে অনেকটাই সক্ষম। তবে নাটকের নামটি এক অর্থে বিভ্রান্তিকর, লঘু হাস্যরসের দিকটিই ইঙ্গিত করে মাত্র, কাজেই উন্নাসিক দর্শক হয়ত নাটকটি এড়িয়ে যাবেন! একটু ইনক্লুসিভ ধরণের নামকরণ, সঙ্গে আধুনিক অভিনয়রীতির প্রয়োগ, কিছু স্টিরিওটাইপ বর্জন, এবং প্রযোজনার খুঁটিনাটি বিষয়ে আরেকটু বেশি মনোযোগ দিলে নাটকটি আরও বেশি সংখ্যক দর্শক আকর্ষণ করতে পারত বলে মনে হয়!