কলকাতার একাডেমী মঞ্চে ১৪ই জুলাই, ২০১৯ তারিখে অভিনীত হল ‘নাটকওয়ালা’ গোষ্ঠীর প্রযোজনায় বাংলা নাটক ‘বাজিমাৎ’, নাটক ও নির্দশনায় শ্যামল কুমার চক্রবর্তী। নাটকটি কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অর্থানুকূল্যে নির্মিত। এই রিভিউ নাটকটির গত ২৫শে এপ্রিল ২০১৯-এ মধুসূদন মঞ্চে হওয়া অভিনয়ের নিরিখে করা হয়েছে।
‘জেমস হেডলি চেস অবলম্বনে বাংলায় প্রথমবার’ – বাজিমাৎ নাটকটি বিজ্ঞাপিত হয়েছে ঠিক এইভাবেই। জনপ্রিয় বৃটিশ রহস্য রোমাঞ্চ ও অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর লেখক জেমস হেডলি চেস (১৯০৬-১৯৮৫) ভারতীয় পাঠক/দর্শকের কাছে একেবারে অপরিচিত নন। তার লেখা বহু গল্প অনুদিত হয়েছে, দেশী বিদেশী অনেক ভাষায় চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। There’s Always a Price Tag গল্পটিও বেশ পরিচিত। সাধারণত রহস্য গল্পে মার্ডারকেই আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়ে থাকে। এই গল্পে কিন্তু ঘটনাটা উল্টো; এখানে চ্যালেঞ্জটা হল, একটা আত্মহত্যাকেই খুন বলে প্রমাণ করতে হবে! সেদিক থেকে দেখলে গল্পটি অদ্বিতীয়! এই গল্পটিকে অনুসরণ করে ‘মহারথী’ নামে একটি নাটক লেখেন গুজরাতি নাট্যকার উত্তম গাড়া। ১৯৮৭ সালে স্বনামধন্য অভিনেতা শ্রী পরেশ রাওয়ালের নির্দেশনা ও অভিনয়ে নাটকটি তুমুল জনপ্রিয় হয়। ২০০৮ সালে, ঐ গুজরাতি নাটকটিকে অবলম্বন করে ‘মহারথী’ নামে একটি হিন্দি ছবি তৈরি হয় যার প্রযোজক এবং মুখ্য অভিনেতা ছিলেন পরেশ রাওয়াল নিজেই, কাহিনীকার হিসাবে ছিল উত্তম গাড়া-রই নাম। গুজরাতি নাটকটি দেখা বা পড়া এই সমালোচকের পক্ষে সম্ভব হয়নি, কিন্তু হিন্দি ছবিটি সহজলভ্য। তাই এটা জোর দিয়েই বলা যায় যে এই ‘বাজিমাৎ’ নাটকটি আসলে ‘মহারথী’ ছবিটির ঘটনা, দৃশ্যবিন্যাস, ও সংলাপকেই, অন্তত ৯০% ক্ষেত্রে, আক্ষরিকভাবে অনুকরণ করেছে। হেডলি চেসের মূল ইংরিজি গল্পটির চাইতে মহারথীর সঙ্গেই নাটকটির মিল অনেক বেশি! উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কাহিনীর শুরুর দুর্ঘটনাটির কথা, ছবিতে দেখানো হয় এবং নাটকে বোঝানো হয় যে মদ্যপ ব্যক্তির গাড়িটি একটি ইলেকট্রিক পোস্টের তলায় চাপা পড়েছিল, কিন্তু মূল গল্পে বলা ছিল যে ব্যক্তিটি রাস্তায় ট্রাকের তলায় চাপা পড়তে যাচ্ছিলেন। জানলা দিয়ে ইনহেলার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার অংশটি – এটিও মূল গল্পে নেই, সিনেমাটি থেকে নেওয়া! সর্বোপরি অ্যাটর্নির চরিত্রটি – মূল গল্পে অকিঞ্চিৎকর, একবারই মাত্র দেখা যায়, অন্যদিকে সিনেমা এবং নাটকে অ্যাটর্নি একটি মুখ্য চরিত্র!!
Previous Kaahon Theatre Review:
There’s Always a Price Tag সহ হেডলি চেসের একাধিক গল্পেই একটা বিশেষ ট্র্যাজেডির সুর লক্ষ্য করা যায়। অপরাধী ব্যক্তিটি অনেক প্ল্যান কষে একটা অপরাধ করেন, কিন্তু শেষে গিয়ে বুঝতে পারেন যে অপরাধটি একেবারেই অর্থহীন, যেটা করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না! নাটক বা সিনেমার পরিচালকদের কাছে এইরকম একটা ট্র্যাজেডি বহু আকাঙ্ক্ষিত। মহারথী-তে কিন্তু এই ট্র্যাজেডিটি ছেঁটে ফেলা হয়েছে (একইসঙ্গে বাজিমাৎ-এও)। মূল গল্পের মুখ্য চরিত্রটি এমনিতেই একজন অপরাধী মানসিকতার লোক, সে একটি অপরাধের চক্রান্ত করে, পরে দুর্ঘটনাবশত তার হাতে একটি খুন হয়ে যায়, এবং শেষে গিয়ে সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। মহারথী ছবিতেও চরিত্রটি ছোটখাটো ক্রিমিনাল, একইভাবে চক্রান্ত করলেও মৃত্যুটাও তার হাতে ঘটে না, আর শেষে গিয়ে সে অনেক টাকার মালিক হয়ে যায়, সঙ্গে একটি নায়িকাও জুটে যায়! এই পরিবর্তনের মূলে খুব সম্ভবত রয়েছে ‘অ্যান্টি-হিরো’ সম্পর্কে ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অপরিণত মানসিকতা ! তারা সম্ভবত ধরেই নেন যে মূল চরিত্র যতই অপরাধ করুক না কেন, তাকে শেষ পর্যন্ত দর্শকের সহানুভূতি পেতে দিতেই হবে (বাঘবন্দী খেলা, বাজিগর, ইত্যাদি প্রচুর উদাহরণ)! এই মানসিকতার আরও সম্প্রসারণ দেখি বাজিমাৎ নাটকে, সেখানে বঙ্কু (গৌতম হালদার) চরিত্রটিকে অপরাধী বলে দেখানোই হয়না, বরং সচ্চরিত্র বলেই দেখানো হয়, এমনকি নাটকের শেষে গিয়ে পাওয়া টাকা দিয়ে সে হাসপাতাল অবধি তৈরি করে দেয় (বাকিটা মহারথীর সঙ্গে এক)! আর এই হাসপাতালের প্রসঙ্গটি নিয়ে আসার জন্য, অন্য একটি চরিত্রকে সিনেমার প্রোডিউসার থেকে পালটে নিয়ে, করে দেওয়া হয় এক মহান চিকিৎসকের উত্তরপুরুষ! কিন্তু তার ফলে যে অন্য অনেক ঘটনার কার্যকারণের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, সেটা খেয়াল রাখা হয়না! মহিলা কেয়ারটেকার চরিত্রটিও নাটকের একটি দুর্বল জায়গা (সিনেমারও), তার চরিত্র এবং সম্পর্কিত ঘটনাবলীর মধ্যে প্রবলভাবে রয়ে গেছে বিদেশী ছাপ। চরিত্রটিকে ভারতীয় প্রেক্ষিতে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করা হয়না! সবমিলিয়ে বলা যায় যে হেডলি চেসের মূল কাহিনীটি মহারথী সিনেমাতেই ধরাশায়ী হয়েছিল, বাজিমাতে এসে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে!
কিন্তু একটি নাটক তো শুধু টেক্সট নয়, আরো অনেক কিছু মিলে তৈরি হয়। কিন্তু একটা অনুকরণ-সর্বস্ব নাটকে আলাদাভাবে সেগুলির গুরুত্ব কতখানি? মদন হালদারের তৈরি সেটটি ভীষণ ঝকঝকে আর দামী! তার সঙ্গে মঞ্চে দেখা যায় প্রচুর লাইট সোর্স (আলোকভাবনায় দীনেশ পোদ্দার), যদিও সেগুলির যে আলাদা করে উপযোগিতা রয়েছে, তা’ বলতে পারা যায় না! অভিনয়ে বাবু দত্তরায় শম্ভু মিত্রের ছায়া থেকে বেরোতে পারেন না। গৌতম হালদার এই সময়ের একজন কিংবদন্তীসম অভিনেতা! কিন্তু চরিত্রে বা নাট্যনির্মাণে অদ্ভুতরসের আধিক্য না থাকলে গৌতমকে সেখানে বেমানান লাগে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রোলটি (এবং নাটকটিও) গৌতমের জন্য লেখা নয়। গৌতম অনেক চেষ্টা করেছেন রোলটিকে নিজের ছাঁচে ঢেলে নেবার, কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূল ছিল না। অন্যদিক দিয়ে বলা যেতে পারে, এই নাটকে গৌতমের অভিনয় প্রতিভাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়নি। বরং কেয়ারটেকার চরিত্রাভিনেত্রী অনেকটাই গৌতমসুলভ অভিনয় করে নজর কেড়েছেন। অ্যাটর্নির চরিত্রে শ্যামল কুমার চক্রবর্তী দুর্বল । কমল ব্রহ্মর চেহারা ইন্সপেক্টর চরিত্রটির সঙ্গে মানানসই, কিন্তু আরও দৃপ্তির প্রয়োজন ছিল। পুরো নাটকটার মধ্যেই একটা জোড়াতালি দেওয়ার মত ব্যাপার রয়েছে যেটা সচেতন দর্শকের চোখ এড়াবে না! তবে ক্রাফটের জাঁকজমক এবং গৌতম হালদারের মত একজন স্টারের উপস্থিতি নাটকের দুর্বলতা গুলোর ওপর একটা আপাত আবরণ দিয়ে রাখে, তাই সাধারণ দর্শকের নাটকটি দেখতে খুব একটা খারাপ লাগে না!
এই প্রযোজনাটি বাংলা নাট্যজগতের এমন একটি অসৎ প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করছে যাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়! স্পষ্টতই নাটকটি মহারথী সিনেমাটি (বা নাটকটি) থেকে অনুবাদ করা হয়েছে, এবং যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যে অনুবাদক হয়ত মূল গল্পটি পড়েও দেখেননি! অথচ মহারথীর লেখককে স্বীকৃতি তো দেওয়া হয়ই নি, উপরন্তু নাটকটিকে অরিজিনাল ইংরিজি গল্পের অ্যাডাপ্টেশন বলে দাবি করা হয়েছে! এ কি বিদেশী নাম সম্পর্কে দর্শকের মোহকে নিশানা করার চেষ্টা, ভারতীয় লেখককে স্বীকৃতিদানে অনীহা, নাকি দর্শক সম্পর্কে একটা সার্বিক অবমূল্যায়নের ফল, সেটা তর্কসাপেক্ষ! তবে সরকারি অর্থানুকূল্যে দামী সেট ও লাইটিং ব্যবহার করে, সঙ্গে বড় স্টার নিয়ে তৈরি এমন নাটক দেখলে সন্দেহ জাগে, প্রযোজনাটি আরও বড় কোনও অসাধু উদ্দেশ্যকে বহন করছে কিনা!!