গোবরডাঙ্গা নকসা আয়োজিত পঞ্চম জাতীয় নাট্য উৎসব, রঙযাত্রা, হয়ে গেলো ১৭ থেকে ২৪ ডিসেম্বর অব্দি। এটা সকলেরই জানা যে গোবরডাঙ্গা নাটকে মজে থাকা একটি আশ্চর্য মফস্বল শহর, যার রেল স্টেশন চত্বর মোড়া থাকে নাটকের বৃহৎ বিজ্ঞাপনী ব্যানারে এবং যে শহরের নাট্য ঐতিহ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের গর্ব প্রচ্ছন্ন থাকে না। দশের অধিক নাট্য দল এখানে নিয়মিত নাট্যচর্চা করে চলেছে। তবে কেউ কেউ যেটা হয়ত জানেন না, তা হলো পঁয়ত্রিশ বছর ধরে কাজ করে চলা গোবরডাঙ্গা নকসা শহরের ভেতরে বানিয়ে ফেলেছে একটি নিজস্ব নাট্য-স্থান, নাম গোবরডাঙ্গা সংস্কৃতি কেন্দ্র, যা সহজেই অন্য অনেক নাটকের দলের কাছে অনুপ্রেরণার বিষয় হতে পারে। এই নাট্য-স্থানে রয়েছে একটি খোলা জায়গা, যেখানে কিছু ধরণের পারফর্ম্যান্স হতে পারে, আর আছে একটি হলঘর (বিচিত্রা) যা এমনভাবে বানানো যে সেখানে সর্বাধিক একশো/একশো কুড়িজন দর্শকের জন্য (নীচে ও ব্যালকনিতে বসে) অন্তরঙ্গ নাটক, ব্ল্যাক বক্স নাটক হতে পারে এবং একটু কল্পনাশক্তির ও মানিয়ে নেওয়ার মিশেলে মঞ্চ নাটকও হতে পারে।
কাহনের সচেতন নাট্য অভিজ্ঞতায় উৎসব হিসেবে রঙযাত্রার সাফল্যের সবচেয়ে বড় দিক দু’টি। এক, উৎসবে প্রদর্শিত কাজের নির্বাচনে (curating) একটি সুচিন্তিত নাট্যবোধ। দর্শকদের দেশ বিদেশের নানা ধরণের নাট্যপ্রয়োগের সাথে পরিচিত করার মধ্যে দিয়ে নাটক সম্পর্কে তাদের ভাবনার সীমার প্রসারণ ঘটানোর এই প্রচেষ্টা বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। যদিও বলা হয়েছে এটি জাতীয় নাট্যোৎসব, দু’টি প্রযোজনা এসেছিলো বিদেশ থেকে। বাকি দুনিয়ার নাটকের সাথে সাথে বাংলা থিয়েটারও ধীরে ধীরে তার প্রসেনিয়ামের স্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে অন্যতর পারফর্ম্যান্স স্পেসের সন্ধানে করছে –নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে রঙযাত্রা এই প্রবণতাটা ধরতে চেয়েছে এবং অবশ্যই এই কাজটা সহজ করে দিয়েছে বিচিত্রার স্থাপত্য। দুই, উদ্যোক্তারা উৎসব প্রাঙ্গণে সার্বিকভাবে ভাববিনিময়ের একটি বাতাবরণ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা বেশ মনোগ্রাহী। নাটকের শেষে নির্দেশক/অভিনেতাদের আনা হচ্ছিল দর্শকদের সাথে আলাপচারিতায়; এই ব্যাপারটা অভিনব না হলেও প্রয়োজনীয়। একটি অপ্রাপ্তির কথাও বলব। উৎসবে নাটকের নির্বাচনই বলে দেয় গোবরডাঙ্গা নকসা তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চেয়েছে কলকাতার নামী, বড় দলের যে পরিধি, তার বাইরে। সেই জায়গা থেকে অন্য জেলার ও মফস্বল শহরের কিছু প্রযোজনা যদি উৎসবে স্থান পেত, মন্দ হত না। আগামীদিনে গোবরডাঙ্গা নকসা হয়ত এই ব্যাপারে ভাববেন। ১৭ ও ২২ তারিখ কাহন থাকতে পারেনি এই উৎসবে – বাকি পাঁচদিনের উপস্থিতির ভিত্তিতে প্রস্তুত হয়েছে এই পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন; কিছু প্রযোজনার ওপর বিশ্লেষণী দৃষ্টিপাত এক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এটা থিয়েটার দেবতার নির্মম পরিহাসই হবে যে বহুলাংশে উচ্চমানের প্রযোজনা হাজির করতে পারা একটি উৎসব শেষ হল যে কাজ দিয়ে তা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যাচ্ছে না। রাজস্থান থেকে আসা ব্রিদিং স্পেস – দ্য ড্রামা কম্পানির নিবেদন ‘কবীরা খাড়া বাজার মে’ (নির্দেশক অভিষেক গোস্বামী) ভীষ্ম সাহানির লেখা অনেককাল আগের একটি নাটক। নাটকটিকে বর্তমান সময়ের ধর্মীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত হলেও দর্শকের সাথে সম্পৃক্ত করিয়ে নেওয়ার কাজটা যেন ঠিক হয়ে ওঠেনি।অভিনয়রীতির ব্যাপারেও সমস্যা রয়ে গেছে। না মুক্তমঞ্চের অভিনয়, না প্রসেনিয়ামের অভিনয়, মাঝে মধ্যেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলা– এসবকিছু প্রায় কখনোই নাট্যমুহূর্ত তৈরী হতে দেয়না। এধরণের নাট্যে recorded সঙ্গীত বাজানো বোধহয় সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। সবকিছু মিলিয়ে প্রযোজনাটি কোনভাবেই দর্শকের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি। সংযোগ স্থাপনে ততটা সফল না হতে পারা আরেকটি কাজ দিল্লীর বোস স্টুডিয়ো’র ‘ফাউস্ট’ (নির্দেশক শান্তনু বোস), যার ভিত্তি সাহিত্যে, নাটকে বারবার ব্যবহৃত ফাউস্ট কিংবদন্তী, যেখানে অন্তহীন জ্ঞানলাভের (এই নাটকে অনন্ত যৌবনেপ্রাপ্তির) উদ্দেশ্যেএকজন মানুষ চিরতরে তার আত্মা সমর্পণ করে শয়তানের কাছে। নির্মাতা নির্দেশক শান্তনু বোস এই আখ্যানটিকে ঢেলেছেন আদ্যন্ত পোস্টড্রামাটিক থিয়েটারের ফর্মে। অতি অল্প সংলাপ ও নাচভিত্তিক শরীরী অভিনয়নির্ভর এই নাট্য জুড়ে অসংখ্য ইমেজ ও ছোট ভিডিও ক্লিপিং দেখানো হয় ব্যাকড্রপে প্রজেকশনের মাধ্যমে আর ব্যবহৃত হয় প্রচুর হিন্দী গানের অংশ। পারফর্ম্যান্স স্পেসের সামনে সাজিয়ে রাখা নানা প্রপ নাট্যটিকে দেয় আচারের আদল (theatre as ritual)। ফাউস্ট ও মেফিস্টো’র সম্পর্কের মধ্যে সমকামীতার আভাস, নাট্যের মাঝে ফাউস্ট মেফিস্টো ও মেফিস্টো ফাউস্ট হয়ে যাওয়া এবং ইমেজ ও অভিনয় দিয়ে যৌন হিংস্রতাকে একটা বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার স্তরে নিয়ে যাওয়া দিয়ে সমকালকে ছুঁতে চেয়েছে এই নাট্য। একসময় মঞ্চে উপস্থিত দুই অভিনেতা তাদের সুঠাম, সুগঠিত শরীর প্রায় নগ্ন করে হাজির করেন। এর ফলে একদিকে যেমন পরাভূত করা হয় দৃশ্যশিল্পে দৃষ্টিসুখের লিঙ্গ রাজনীতিকে, অন্যদিকে পৌরুষের যৌন আগ্রাসনের বিষয়টিকেও প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়। তবে, এই নাট্যে অত্যধিকভাবে ব্যবহার করা হিন্দী গান এবং তৎসহে নাচ মূল টেক্সটের সমূহ ক্ষতি করেছে – গানগুলো দর্শককে নিয়ে যাচ্ছিলো সেইসব সিনেমার প্রেক্ষিতে যেখান থেকে গানগুলো আহরিত, আর সেই প্রেক্ষিতের সাথে নাট্যের কোন যোগাযোগ না থাকায় নাট্যের আখ্যানের সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছিল বারংবার। দুই অভিনেতা শরীরের কাজে যতটা সক্ষম বাচিকে ততটা নন, এটাও সমস্যার। মোটের ওপর নাট্যে এই বিশেষ avant garde কাজটি দর্শকদের কাছে পুরো পৌঁছাতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর মাপকাঠিতে শোভেন্দু গাঙ্গুলির একক প্রযোজনা ‘স্বপ্নওয়ালা’ পুরোমাত্রায় সফল। অন্তরঙ্গ স্পেসের জন্য নির্মিত এই নাট্য সরাসরি দর্শকদের সাথে সংযুক্ত শুধু হয় তা নয়, অন্তরঙ্গ নাট্যের দাবী মেনে দর্শককে পারফর্ম্যান্সের অন্তর্গত করে নেয়। অন্তরঙ্গ থিয়েটার এই শব্দবন্ধের খুব গভীরে গিয়ে যে নাট্য শোভেন্দু প্রস্তুত করেন তা আসলে পারফর্ম্যান্স দিয়ে একজন পারফর্মারের অন্তরঙ্গ আত্মোন্মচন। তার অভিনয়ে অভিনয় না রেখে, সাদা সহজ আপাতভাবে গঠনহীন স্মৃতিচারণার মেজাজে শোভেন্দু শোনান, দেখান একজনের নানা স্বপ্নভঙ্গের পর (ক্লাউন, ফুটবলার, কবি, গায়ক, নর্তক হওয়ার) নাট্যাভিনেতা হয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প। নাট্যের শেষে দর্শকরা হাতে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি (যা সংকেত করে প্রত্যেকের নিজের নিজের স্বপ্নকে) নিয়ে যখন দখল করেন অভিনয়ভূমি যেখান থেকে বেরিয়ে গেছেন অভিনেতা নিজে, তখন অন্তরঙ্গ থিয়েটার তার লক্ষ্যে পৌঁছায় কারণ ততক্ষণে অর্জিত হয়ে গেছে দর্শকের ক্ষমতায়ন। এই প্রযোজনা একটু সম্পাদনা দাবী করে – একের পর এক কিছু হতে চাওয়া এবং না হতে পারার জায়গাগুলো ছোট করা যায়। গোটা প্রযোজনাতেই ছেয়ে থাকে একধরণের নস্ট্যালজিয়া বিলাস, এবং মা’কে কেন্দ্র করে যে অংশ তা বড্ড ব্যক্তিগত আবেগমথিত মনে হয়, কিছুটা মেলোড্রামাটিকও। আড়ম্বরহীনতায় গ্রোটোস্কির পুওর থিয়েটারকে মনে করিয়ে দেওয়া এই কাজে গানের/আবহের জন্য ল্যাপটপ ব্যবহার করাটা বিসদৃশ ঠেকে।
একভাবে দেখলে, শোভেন্দু গাঙ্গুলির ‘স্বপ্নওয়ালা’ একজন নাট্যকর্মীর নাট্যে প্রবেশের সময়টা ধরে যেখানে থামে, সেখান থেকে চলা শুরু করে ঊষা গাঙ্গুলির ‘অন্তরযাত্রা’, অন্য আরেকজন নাট্যকর্মীর বেশ কয়েক দশকের নাট্যের যাত্রাপথের দিকে পেছন ফিরে তাকানোর নাট্য-উপস্থাপনায়। ঊষা গাঙ্গুলির এই কাজটি প্রায় পনেরো বছর পুরানো, কিন্তু এটি এমন অন্ত-উন্মুক্তভাবে গঠিত যে সময়ের সাথে সাথে এই নাট্য নিজেকে ‘নতুন’ করে নিতে পারে। তাপস সেনের আলো ও খালেদ চৌধুরীর মঞ্চ বিন্যাস এই নাট্যের সম্পদ, যেমন সম্পদ ঊষা গাঙ্গুলির অনন্য অভিনয় দক্ষতা, যার দৌলতে এক লহমায় চরিত্র থেকে চরিত্রে চলে চলে যান তিনি। শিক্ষণীয় ঊষার শরীর ও কন্ঠের ওপর দখল, মঞ্চপরিসর ব্যবহার করার নৈপুণ্য এবং দর্শকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন। পারফর্মার/নির্দেশক ঊষা তার করা/নির্মিত বহু চরিত্রের ও বাস্তবের মানুষজনের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে যেতে আসলে মেলে ধরেন নারী হিসেবে থিয়েটারের সাথে যুক্ত থাকার তার ব্যক্তিগত, অন্তরঙ্গ ইতিহাস।
বাংলাদেশের হবিগঞ্জ এলাকার নাট্যদল জীবনসংকেতের নাটক ‘জ্যোতিসংহিতা’ প্রচেষ্ট হয় একজন ব্যক্তির ইতিহাস পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে জাতীয় ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে বিস্মৃতি ও বিকৃতির অন্ধকার থেকে উদ্ধার করতে। রুমা মোদক লিখিত আদ্যন্ত রাজনৈতিক এই নাটক হবিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি দাসের জীবনের ওপর আধারিত। নাট্য হিসেবে প্রসেনিয়ামের জন্য তৈরী এই কাজটি (নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী) বিচিত্রার উচ্চমঞ্চহীন ছোট পরিসরে প্রায় বিনা মহড়ায় নিয়ে আসার দুরূহ চ্যালেঞ্জটি জীবনসংকেতের কলাকুশলীরা বেশ সাহসের সাথেই মোকাবিলা করেছেন। নাট্যের ভূমিকার অংশটি তার শৈলীকৃত, সাহিত্যিক ভাষা নিয়ে কিছুটা যেন প্রলম্বিত – বিমূর্ত থেকে মূর্তে, সাধারণ থেকে বিশেষে আসতে একটু বেশি সময় লাগে। কিন্তু জগতজ্যোতি দাসের গল্পে ঢুকে যাওয়ার পর নাটক তরতর করে এগিয়ে যায় – এমনকি জায়গায় জায়গায় শুধুই কথা বলাও (প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীনের কথানাট্যের ছাপ এখানে স্পষ্ট) তার গতি রুদ্ধ করতে পারে না। নাট্যের বিন্যাসে (গানে, আবহে, পোষাকে, আলোতে, অঙ্গসঞ্চালনে) আমরা ভারতের NSD’র প্রভাব যেমন দেখি, তেমন দেখি হবিগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে অরগ্যানিক থিয়েটারের দিকে যাওয়ার প্রচেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণ যে আসলে যে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তা এই প্রজন্মের কাছে পরিস্কার করে দেওয়াই ‘জ্যোতিসংহিতা’ নাট্যের মুখ্য সাফল্য।
জ্যোতিসংহিতা (বাংলাদেশ)
জ্যোতিসংহিতা (বাংলাদেশ)
গোবরডাঙ্গা নকসার ‘হুলো’ (নাট্যকার মৈনাক সেনগুপ্ত, নির্দেশক আশিস দাস) একটি রাজনৈতিক রূপক, যা কিছুটা মিউজিকালের রীতিতে বিদ্রুপ, শ্লেষ, ব্যঙ্গ ব্যবহার করে প্রভূত শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত সাধারণ নাগরিকের অসম কিন্তু না থেমে যাওয়া লড়াইয়ের গল্প বলে। নাট্যের ফর্মটি বেশ নমনীয়, যার ফলে এই নাট্য প্রসেনিয়াম বা মুক্তমঞ্চ বা অন্তরঙ্গ যে কোন পরিসরে নিজেকে মানানসই করে নিতে পারবে। নজর কাড়ে ট্রেন, প্ল্যাটফর্ম, ডাস্টবিন, নলকূপ, টিভির টক-শো ইত্যাদির কম্পোজিশন। নজর কাড়ে এটাও যে নাট্যে অনেক কুশীলব বয়েসে ছোট হলেও অভিনয়-দক্ষতায় বেশ পরিণত। রাষ্ট্রের সাথে আমে দুধে হয়ে ব্যবসা করে যাওয়া কর্পোরেট মিডিয়াকে শ্লেষবিদ্ধ করা নিয়ে কিছু বলার নেই, কিন্তু একটি নাম ব্যবহার করে বিশেষ একটি মিডিয়া গ্রুপের দিকে নজর না ঘুরিয়ে গোটা কর্পোরেট মিডিয়া ব্যবস্থাটাকেই আক্রমণের লক্ষ্য করলে নাট্যের রাজনৈতিক বক্তব্য আরো জোরালো হত বলে মনে হয়।
রঙযাত্রা উৎসবের দু’টি সেরা প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করে এই লেখা শেষ হবে। সুদীপ গুপ্ত’র নির্দেশনায়, ডলস থিয়েটারের প্রযোজনা ‘সাহেব বাগানের দুঃখিনী’ (মূল নাটক মনোজ মিত্রের ‘সাহেব বাগানের সুন্দরী’) শুধুমাত্র এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা পেতে পারে যে আমরা নাট্য বলতে যা বুঝি তার সীমাটাই এই কাজ অনেকটা প্রসারিত করে দেয়। পুতুল নাটক বললেই আমরা যে এখনো বাচ্চাদের জন্য মজার, মিষ্টি, শিক্ষামূলক কিছু একটা ভেবে নি, সেই ধারণাটার গোড়ায় আঘাত করে এই অত্যন্ত পরিশীলিত প্রযোজনা। সাধারণভাবে পুতুল নাচে আমরা যে ফ্রেম পাই তা ভেঙ্গে সুদীপ গুপ্ত এই নাট্য প্রসেনিয়ামযোগ্য করে তুলেছেন এবং নাট্য লাভ করেছে একটি বিশেষ মাত্রা। তবে ‘বিচিত্রা’ নাট্যমঞ্চ প্রসেনিয়ামের দূরত্ব ও গভীরতা না দিতে পারার কারণে পুতুলের সুতো দেখা যায় ও ইল্যুশন তৈরীতে বিঘ্ন ঘটে। পুতুলের সাথে মানুষও অভিনয় করে এবং আরো একটি মাত্রা যুক্ত হয়। এখানে পুতুল কথা বলে, মানুষ মূক এবং পুতুল মানুষের আদানপ্রদান সাবলীল, স্বচ্ছন্দ। এই নাট্যের আবেদনের বিশেষ জায়গা এটাও যে পুতুল পথ করে দেয় জাদুবাস্তবতা সৃষ্টি করায়, যা শুধুমাত্র মানব অভিনেতা দিয়ে সম্ভব নয়। ইয়রোপীয় পুতুল ব্যবহার করে ভারতীয় রুপকথার দৃশ্য-অনুভব সৃষ্টি এবং একটি নিটোল কাহিনী সুচারুভাবে পারফর্ম করার মধ্য দিয়ে সুদীপ নাট্যে যা করা সম্ভব তার দিগন্তটা কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
নাট্যে আপেক্ষিকভাবে স্বল্প উপকরণ ব্যবহার করে কি বা কতটা করা সম্ভব, কেবলমাত্র সৃজনী কল্পনা আর পারফর্ম্যান্স-দক্ষতার সাহায্যে নাট্যকে কোন স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ব্রাজিল থেকে আসা অপোস্টো টিয়েট্রো ল্যাবোরাতোরিও’র প্রযোজনা ‘এস্ট্রেলাস’ (ভাষা – ইংরাজি, মূল উপন্যাস – ক্ল্যারিস লিস্পেক্টর, নির্দেশনা – জুলিয়া ভারলে, একক অভিনয় – ম্যারিলিন নুনেস)। নাটকটিতে আমরা পাই একজন লেখিকাকে যিনি একটি গরীব কিন্তু তারকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এক কম বয়েসী মেয়ের কাহিনী লিখছেন, যে কাহিনীতে আসে একাধিক চরিত্র। নাটকের শেষে মেয়েটির কোন স্বপ্নই পূরণ হয় না, সে গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারায়। আপাত সরল এই আখ্যান জুড়ে থাকে লেখিকার ও তার প্রধান চরিত্র ম্যাকাবেয়া’র আত্মানুসন্ধান কেন্দ্রিক অস্তিত্ববাদী নানা প্রশ্ন। নাট্যে ম্যারিলিন একাই সমস্ত চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন – এই ফুটিয়ে তোলায় পোষাকের অসীম গুরুত্ব প্রতিভাত হয় যখন মঞ্চে থেকেই বারবার পোষাক পাল্টে তিনি প্রবিষ্ট হন বিভিন্ন নারী ও পুরুষ চরিত্রে। সাথে সাথে পাল্টে যায় তার কথা বলা, হাঁটাচলা, শরীরী ভাষা। অন্তরঙ্গ স্পেস পারফর্ম্যান্সের যে সুযোগ দেয় তার সবটুকু যথার্থ ব্যবহার করে তিনি কখনো হাতের আঙুল, কখনো চোখ, কখনো চুল, কখনো বা লাল জুতো পরা একখানি পা দিয়ে নির্দিষ্ট অর্থ তৈরী করেন। তার পারফর্ম্যান্সের সাথে নিখুঁত সঙ্গত করে আলো ও আবহের বিন্যাস। এর সাথে যুক্ত হয় একটু গান, সামান্য নাচ আর আক্ষরিক অর্থেই একটু জাদুর ছোঁয়া – অর্থাৎ, নাট্যে যা যা করা সম্ভব তার সবটাই ব্যবহৃত হয় এখানে। অথচ সবকিছুই ব্যবহৃত হয় পরিমিতভাবে, টেক্সটের একান্ত প্রয়োজনে এবং তাই কোন কিছুই বাহুল্য বলে মনে হয় না। নাট্যের অন্তিম দৃশ্যে ম্যাকাবেয়া’র মৃত্যুর সাথে সাথে লেখিকার’ও একপ্রকার মৃত্যু ঘটে, তিনি শুয়ে পড়েন, মঞ্চের সব আলো নিভে যায় আর তখন মেঝেতে জ্বলজ্বল করতে থাকে একরাশ ফ্লুরোসেন্ট তারা (এস্ট্রেলাস)। রচিত হয় একটি আসাধারণ নাট্যমুহূর্ত; তারাগুলো ম্যাকাবেয়া’র অপূর্ণ স্বপ্নের ইঙ্গিতবাহী হলেও সেগুলোর দীপ্তি আরেক তারকার উত্থানের দ্যোতক হয়ে যায় – তিনি ম্যারিলিন স্বয়ং এবং নামের আশ্চর্য সমাপতনে নাট্যে উল্লিখিত ম্যাকাবেয়া’র ম্যারিলিন মনরো হওয়ার স্বপ্ন যেন অন্য একভাবে সফল হয়।
এস্ট্রেলাস (ব্রাজিল)
এস্ট্রেলাস (ব্রাজিল)
শুধু এই ক’টা নাটক দিয়েই নয়, গোবরডাঙ্গা নকসা আয়োজিত নাট্য উৎসবে প্রতিদিনই মুক্তমঞ্চ ‘উঠোন’-এ গান, নাট্য বিষয়ক আলোচনা, স্বল্প দৈর্ঘ্যের আরো নাটকের আয়োজনে সার্বিকভাবে উদযাপিত হল “থিয়েটার”। দেশে বিদেশে নাটকের বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা ও অন্যতর প্রয়োগ আর নাটক নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা করার পথ যখন এই উৎসব সন্ধান করছে দর্শককে সঙ্গে নিয়ে, তখন কলকাতার বড় বড় নাট্যোৎসব ব্যস্ত থাকছে মূলত কলকাতার ব্যায়বহুল, মঞ্চসফল প্রযোজনাগুলোকে দর্শকের সামনে আবার হাজির করায়। কলকাতা আটকে পড়ছে কলকাতাতেই, আর গোবরডাঙ্গা পাড়ি দিচ্ছে বহির্বিশ্বে। সেই সময় বোধহয় খুব বেশি দূরে নয় যখন বাংলার সমসাময়িক নাট্যচর্চার ভরকেন্দ্র কলকাতা থেকে সরে গোবরডাঙ্গা বা এইরকম কোন মফস্বলে চলে আসবে। ‘রঙযাত্রা’ এই সম্ভাবনাটিকে জাগিয়েছে, এবং ঠিক এই কারণেই গোবরডাঙ্গা নকসার ওপর দ্বায়িত্ব এসে পড়েছে আগামীদিনের নাটকে নতুনের অনুসন্ধানের। কাহনও অপেক্ষায় থাকবে সেই অনুসন্ধানের সাক্ষী হতে।
পুনঃ১ – হায়দ্রাবাদের রঙ্গকল্পের ‘তুমহারি ভিন্সেন্ট’ প্রযোজনাটি অন্য একটি উৎসবের আওয়তায় রেখে আলোচিত হবে।
পুনঃ ২ – ‘উঠোন’ মুক্তমঞ্চেযখন ‘পারম্পর্য’ (নির্দেশনা – অনিল মন্ডল) নাটকটি চলছে, মাইকে বাজতে থাকা অন্য একটি অনুষ্ঠানের সোচ্চার ঘোষণায় তখন চারদিক কন্টকিত। অভিনয়রত কুশীলবেরা সকলেই শিশু, কিশোর কিশোরী, তাদের সংলাপ শোনা দায়। কিন্তু কি আশ্চর্য, কোনরকম ছন্দপতন না হতে দিয়ে, মনঃসংযোগ অবিচল রেখে তারা করে গেল অভিনয়, গোটা অভিনয়-পরিসর দাপিয়ে। কোনকিছুই যাদের অভিনয় থামাতে পারে না, মফস্বলের সেইসব কম বয়েসী অভিনেতারাই ধরবেন আগামীদিনে বাংলা নাটকের হাল। তাদের থামতে না জানার জন্য রইল আমাদের অকুন্ঠ অভিনন্দন।
দীপঙ্কর সেন
শ্রীজয়ী ভট্টাচার্য