কলকাতা রঙ্গিলার প্রযোজনা অটো’র (মূল রচনা নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস, অটো; নাট্যরূপ ও নির্দেশনা, কৌশিক কর) আলোচনার শুরুতেই এটা বলা নেওয়া প্রয়োজন যে উপন্যাসটি সমালোচকের পড়া নয়। প্রয়োজন এই কারণেই যে এই আলোচনায় সমালোচক নাটক ও নাট্য দু’টি বিষয়েই কিছু কথা বলার চেষ্টা করবে; নাট্য যে নাটক দিয়েছে তার ভিত্তিতেই থাকবে এই আলোচনার বিস্তার– নবারুণের রচনায় অন্যতর কিছু থাকতেও পারে, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই এই সমালোচকের বক্তব্য খাটবে না।
নাটকের কেন্দ্রে পাই অকালমৃত মায়ের অভাববোধ তীব্রভাবে অনুভব করা অটো চালক চন্দনকে, যে ফুটবলার হতে চেয়ে পারেনি, যে অটো চালাতে চালাতে স্বপ্ন দেখে চার-চাকা গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে নিজের এবং তার গভীর ভালবাসার মানুষ, স্ত্রী মালার জীবনটা আরেকটু মসৃণ করবে। হঠাৎ একটি দুর্ঘটনা তার জীবনকে তছনছ করে দেয় – চন্দনের অটো একটি ট্যাক্সির সামনে চলে এসে তার গতিরুদ্ধ করে, যেই ট্যাক্সিতে চড়ে পালাচ্ছিল কয়েকজন ব্যাঙ্ক ডাকাত। বাকিরা পালাতে সক্ষম হলেও একজন ধরা পড়ে যায় এবং নৃশংস গণপিটুনিতে তার প্রাণ যায়। বীর হতে না চাওয়া, ভীত সন্ত্রস্ত, প্রায় লুপ্তসংজ্ঞা চন্দন প্রত্যক্ষ করে একটি মানুষকে অনেকে মিলে থেঁতলানোর নারকীয় দৃশ্য, বিশেষত লোকটির পুরুষাঙ্গে আঘাতের পর আঘাত করা। এই বীভৎস দৃশ্য প্রোথিত হয়ে যায় চন্দনের স্মৃতি ও সত্তায় –সে ক্রমশ হারাতে থাকে তার পৌরুষ, তার যৌনক্ষমতা। ওই গণপিটুনির এক পান্ডা, স্থানীয় গ্যারেজে কাজ করা ভিকি, চন্দনকে সেদিন তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়, এবং অচিরেই মালার সাথে একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে একদিন তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। নাটকের একেবারে শেষে জীবনের হাতে মার খাওয়া চন্দন একভাবে পাল্টা মার দেয়। ভিকিকে খুন করে।
Previous Kaahon Theatre Review:
Kaahon Theatre Review
�Hantarak –The Slaughter of Reason and Logic
�Read this review in English: https://t.co/1ntCkeXN3T#bengalitheatre | #theatre | #theatrereview | #kaahontheatrereview |#KaahonPerformingArts https://t.co/3do92ftji4
— kaahon (@kaahonwall) April 16, 2018
এখানে বেশ কয়েকটি কথা বলা দরকার। নাটকটি চায় একজন পুরুষের জীবনে, তার মত করে, সফল হওয়া না হওয়াটা যৌন(অ)ক্ষমতার নিরিখে বুঝতে। চন্দনের সব না পারার মেটাফর হয়ে যায় তার ইম্পোটেন্স; সমাজ সেভাবেই তাকে দেখে (বারবার কিছু পার্শ্বচরিত্র তাকে ‘ধ্বজ’ বলে লাঞ্ছনা করে), আর হ্রাসমান যৌনক্ষমতায় সে নিজেও চূড়ান্ত বিপন্নতায় ভোগে। মালাও চিন্তিত হয়ে কবিরাজ বদ্যির খোঁজ করে চন্দনের জন্য; শেষ পর্যন্ত সে ভিকির সাথে চলে যায় তার কারণ ভিকির যৌনসামর্থ্য। এই নাটকের লিঙ্গ রাজনীতি খুবই সমস্যার, কারণ এখানে পরিস্কারভাবে একজন পুরুষের সামাজিক ও অস্তিত্ববাদী মূল্যকে দাঁড় করানো হচ্ছে তার পুরুষকারের, তার ম্যাসক্যুলিনিটির ওপর। ফেমিনিস্ট্ দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন নাটকটি সমস্যার, মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও তাই। চন্দন মানবিক জায়গা থেকে আক্রান্ত মানুষটির জন্য কষ্ট পায়, কিন্তু সে তার সাথে একাত্ম হয় কোন শ্রেণীগত অবস্থান থেকে নয় (যা হতেই পারত), লোকটির পৌরুষ ধ্বংস হওয়ার জায়গা থেকে। এই শ্রেণীগত সংহতি গড়ে ওঠে না নাটকের আরো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় – চন্দন ও তার বন্ধু, ‘আসমান তারা’ হোটেলের মালিক ইরফান, আলোচনা করে পৃথিবীর ছক নিয়ে, যেখানে সবচেয়ে বড় ক তার চেয়ে ছোট খ’কে মারে, খ মারে আরো ছোট গ’কে, আর গ মারে তার চেয়েও ছোট ঘ’কে। বলা হয় সবচেয়ে যে ছোট যে শুধু মারই খেয়ে যাবে তা নয়, একদিন সে ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা মারবে এমন কাউকে যে তার অস্তিত্বটাই শেষ করে দিতে চাইছে। চন্দন নির্ধারণ করে তার অস্তিত্বের শত্রু ভিকি এবং তাই সে ভিকিকে মারে। একই শ্রেণী অবস্থানে থেকে ভিকিকে তার চরম শ্ত্রু ভাবাটা মার্ক্সীয় রাজনীতির প্রথম পাঠের সম্পূর্ণ বিপরীতে যায়; চন্দন/ভিকি দ্বৈরথকে একই নারীকে (যে এখানে কেবলই means of (re)production) কব্জা করার সংগ্রাম হিসেবে দেখা যায়। যে বন্দুক দিয়ে চন্দন ভিকিকে মারে, সেই বন্দুক তার হাতে আসাটা (জ্যোতিষ চর্চা করা নন্দ’দার মারফত) প্রায় দৈব একটা ব্যাপার; ইরফান যখন বলে ‘পৃথিবীতে নিশান রেখে যাওয়াটা’ জরুরী, তা শোনায় একজন প্রখ্যাত সাধকের বাণী ‘চিহ্ণ রেখে যা’র মত। এটা বলারও কোন উপায় নেই যে এই নাটক চেয়েছে চন্দনের ম্যাসক্যুলিনিটি বা অরাজনৈতিকতাকে critique করতে বা subvert করতে, কারণ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নাটক চন্দনকে অবিসন্বাদিত ট্র্যাজিক হিরো হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করতে সক্রিয় থেকেছে। জানি না অটো উপন্যাস লেখার সময় নবারুণ তার ঘোষিত রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সাময়িক ছুটি নিয়েছিলেন কিনা, তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় নাটক অটো’র রাজনীতি গভীরভাবে সমস্যাযুক্ত।
নাটকের রাজনীতি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, নাট্যটি দেখার সময়ের ভাবনা ও অনুভূতির প্রতি সৎ থেকে, নাট্যটি চমৎকার। জানি, নাটক সরিয়ে রেখে নাট্য নিয়ে কথা বলাটাও রাজনৈতিকভাবে গোলমেলে, কিন্তু নাট্যটি দেখতে দেখতে নানা কারণে চমৎকৃত হওয়ার সত্যটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রথমেই বলি, নাট্যটির প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি উপাদান অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে, তীক্ষ্ণ নাট্য বোধ ও বুদ্ধি দ্বারা সযত্নে নির্মিত। নির্দেশক কৌশিক কর, অনুমান করি, নাট্যটির সাথে মনে মাথায় এতদিন ঘর করেছেন যতদিন লাগে একটি নাট্যের সমস্ত খুঁটিনাটির, অলিগলির সাথে নিবিড়তম পরিচয় গড়তে ও তারপর সেসব কিছুর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে। অত্যন্ত আঁটসাঁট, টানটান এই নাট্য, যেখানে আলো, আবহ, মঞ্চ এবং সর্বোপরি অভিনয় একে অপরের পরিপূরক ও মাত্রাজ্ঞানের নিরিখে প্রায় নিখুঁত। বলে রাখা ভালো, কৌশিকের নাট্যের ভাষা সিনেমার ভাষা থেকে বহু উপাদান সংগ্রহ করেছে – নাট্যের প্রচুর দৃশ্যান্তরগুলো সিনেমার cut মনে পড়ায়; লুপে বাজতে থাকা ‘কোই হমদম না রহা, কোই সাহারা না রহা’ ট্র্যাজিক হিরোর থিম সঙ্ হয়ে ওঠে; নন-লিনিয়ার আখ্যান নির্মিত হয় সিনেমারসেই idiom ব্যবহার করে যেখানে একই দৃশ্য বৃদ্ধিলাভ করে ফিরে আসে। অটো নাট্যের ক্ষেত্রে একটা মিডিয়ামের ভাষা অন্য মিডিয়ামে নিয়ে আসার প্রয়োগটি যে মোটের ওপর সফল হয়েছে তা বলতেই হয়।
বিশেষ কিছু দৃশ্য তথা মুহূর্ত নির্মাণের কথা বলব। মায়ের অভাববোধ নাট্যায়িত হবে কিভাবে? নাট্যের প্রথম উচ্চারিত শব্দ ‘মা’, যা চাপা হাহাকারের মত শোনায়। না চাইতেও চন্দনের জীবন থেকে ফুটবল চলে যাওয়া পারফর্মড হবে কিভাবে? একটা দৃশ্য আসে, কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক, কিছুটা স্বপ্নের মত, যেখানে বল নিয়ে ড্রিবেল্ করে চন্দন – আচমকাই বলটা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, সে টাল খেয়ে পড়ে যায়। Slow motion ব্যবহার করে গণপিটুনির বীভৎসতাকে সম্প্রসারণ করা হয়, সাথে থাকে নাটকীয় আলো ও আবহের পরিমিত কিন্তু সুসংগত ব্যবহার। নাট্যের শেষের দিকে চন্দন যখন কথা বলে তার অটোর সাথে, অটো’র হেডলাইট ঈষৎ জ্বলে উঠে চন্দনের ডাকে সাড়া দেয় এক ধরণের magic realism সৃষ্টি করে। বহুদিন মনে থাকবে প্রায় তিরিশ সেকেন্ডের শব্দহীনতা দিয়ে তৈরী চন্দন, মালা আর চায়ের কাপ হাতে বসা ভিকিকে নিয়ে তৈরী ওই দৃশ্যখণ্ড, যেখান থেকে তিনটে জীবন জড়িয়ে পেঁচিয়ে যায়– চাপা যৌন উত্তেজনা, আশঙ্কা, বীতরাগ এতকিছু যেভাবে নৈশব্দ এবং অতি স্বল্প অঙ্গবিক্ষেপ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়, তা শিক্ষণীয়।
ইরফানের ভূমিকায় সত্রাজিৎ সরকার তার চরিত্রের অন্তর্নিহিত শান্তভাব ফুটিয়ে তুলেছেন অন্যদের তুলনায় ঈষৎ ধীর লয়ে অভিনয় করে; সচেতনভাবেই তিনি পরিস্কার, পরিশীলিত উচ্চারণে, অন্যদের তুলনায় একটু নীচু স্বরগ্রামে, তার সংলাপ বলেছেন ইরফানের মনের স্বচ্ছতা প্রকাশ করতে। পার্শ্বচরিত্র থেকেও টেক্সটের প্রয়োজনে কিভাবে চরিত্রকে সামনে আনতে হয়, তা সত্রাজিৎ যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। গম্ভীরা ভট্টাচার্য ভিকির চরিত্রের আগ্রাসী ভাবখানা ইঙ্গিত করেছেন সাবলীল দক্ষতায়; তার তড়বড় করে কথা বলা, হাত পা বেগে নাড়ানো ভিকির খল স্বভাবের পরিচায়ক। চন্দনের সাথে তার দৃশ্যগুলোতে, চন্দনের চোখের দিকে সরাসরি প্রায় কখনই না তাকানোর মুদ্রায় গম্ভীরা ফুটিয়ে তুলেছেন ভিকির অপরাধবোধে কলুষিত বিবেক। মালার ভূমিকায় তণ্বীষ্ঠা বিশ্বাস তার চলনে বলনে অত্যন্ত বাস্তবোচিতভাবে পরিস্ফুট করেছেন মালা চরিত্রের আর্থ-সামাজিক পরিচয় ও ব্যক্তিজীবনের ইতিহাস। তাদের দাম্পত্যে ভিকির প্রবেশের আগে, মালা এবং চন্দনের সম্পর্কের মাধুর্য ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তণ্বীষ্ঠার দরদী অভিনয় মন ছুঁয়ে যায়। সুকান্ত দাস (নন্দ), সমীরণ (আক্রান্ত মানুষ ও মিউচ্যুয়াল ম্যান) এবং অনান্যরা সকলেই তাদের চরিত্রের দাবী মিটিয়েছেন। কৌশিক করের চন্দন সম্ভবত তার অদ্যাবধি সেরা অভিনয়, যেখানে তিনি তার অভিনয় বেঁধেছেন বুদ্ধিদীপ্ত সংযমী সুরে। গোটা শরীর দিয়ে অভিনয় করেছেন কৌশিক – স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত চন্দনের বাহুর পেশী যখন ইঙ্গিত করে তার খেটে খাওয়া বর্তমান ও খেলাধুলা করা অতীত, তখন তার নুয়ে পড়া কাঁধ আর যন্ত্রণায় দগ্ধ দুচোখ পরিস্কার করে দেয় চন্দনের মানসিক বিধ্বস্ততা। নিজের চলাফেরার গতির তারতম্য ঘটিয়েও কৌশিক চন্দনের বিভিন্ন মানসিক অবস্থার হদিশ দিয়েছেন।
কৌশিক ও গম্ভীরার আলোক-বিন্যাস এমনই যে আলোর যাবতীয় নাটকীয় সম্ভাবনাকেই বাস্তবায়িত করা হয়েছে নাট্যে, কিন্তু কখনই মনে হয় নি এক চিলতে আলোও অকারণে এসে পড়েছে নাট্যের অন্দরে (প্রক্ষেপণে, শুভঙ্কর দাস)। আলো দিয়ে তৈরী করা zone চোখে পড়ার মত; আবার আবহে যখন একই ধ্বনি বাজছে, শুধুমাত্র আলোর পরিবর্তনই ঘটনার নতুন বাঁক নেওয়া সুচিত করেছে (নাট্যের শেষের দিকে চন্দন/ইরফান ও তারপর চন্দন/নন্দ দৃশ্যান্তরে)। অত্যুক্তি হবে না এটা বললে যে আলো এই নাট্যে কথা বলেছে। মঞ্চভাবনাও উপরোক্ত দুজনের; বোঝাই যায়, নাট্য গড়ার শুরু থেকেই আলোক ও মঞ্চ বিন্যাসের কাজ চলেছে। আবহ’ও এই নাট্যের সম্পদ (বিন্যাস- সমীরণ; প্রক্ষেপণ- কল্যাণ); চন্দন যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকায় আশা নিয়ে, বা যখন তার যৌন ইচ্ছা জেগে ওঠে, তখন অটো’র চলা শুরু করার গর্জন সেই ক্ষুদ্র নাট্য-মুহূর্তগুলোকে দেয় একটা বাড়তি মাত্রা।
অটো যে ভাবে চালালেন কৌশিক কর, তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে অনেক কিছু পাওয়ার আশা জাগলো। মহানগরীর রাজপথে আমাদের সহ নাগরিক কোন কোন অটো চালক মাঝেমধ্যেই কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে তাদের গাড়ি ছুটিয়ে দেন দুর্ঘটনা লক্ষ্য করে, আশা করি নাটকের ক্ষেত্রে নির্দেশক/অভিনেতা কৌশিক তেমনটা কখনই করবেন না।