অশোকনগর নাট্য আননের ২৮তম জন্মদিনেএকাদেমি মঞ্চেপরিবেশন করলেন তাদের নবতম প্রযোজনা ‘অ-পবিত্র’। মূল নাটক জেরোম লরেন্স এবং রবার্ট এডউইন লী, বাংলা নাট্য-রূপান্তরও নির্দেশনা চন্দন সেন।
১৯২৫ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যে এক স্কুল শিক্ষককে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ক্লাসে ছাত্রদের চার্লস ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’ পড়ানোর জন্য। রাজ্যের আইনানুসারে বাইবেলে বর্ণিত কোন কিছুর বিপরীতে কথা বলা অপরাধ ছিল, তাই চার্চের নির্দেশে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এই মামলাটি Monkey Trail নামে বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত, আর আমেরিকার বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত। এই ঘটনার ভিত্তিতে ১৯৫৫ সালে জেরোম লরেন্স এবং রবার্ট এডউইন লী রচনা করলেন নাটক ‘Inherit the wind’, তবে তাদের প্রধান উপলক্ষ্য ছিল সমসাময়িক ম্যাকার্থি জমানার অবিচার ও নিপীড়ন! জোরদার বক্তব্যের জন্য নাটকটি সময়ান্তরে বারবার মঞ্চস্থ হয়েছে, ১৯৬০ সালে Stanley Kramer নির্মিত চলচ্চিত্র রূপটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
Previous Kaahon Theatre Review:
বর্তমানে ধর্মান্ধতা আর ক্ষমতাসীনদের মতবাদ মানুষের উপর জোর করে চাপাবার চেষ্টা সারা বিশ্বেই প্রবলভাবে জাল বিস্তার করছে, স্বাধীন চিন্তার স্থান ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে এবং অসহিষ্ণুতার যে বাতাবরণ তৈরী হয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে প্রায় একশ বছর আগের ঘটনা অবলম্বনে রচিত ইংরেজী নাটকের বাংলায় মঞ্চায়ন ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক ও সাহসী প্রতিবাদ। একশ বছর আগে আমেরিকার এক শহরের এই ঘটনার সাথে আজকের ভারতবর্ষের ছবিটা অনেকাংশে মিলে যায়, এমনকি নাটক রচনার সময়কালে আমেরিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও, এ কথা মাথায় রেখেই নাট্যকার মূল নাটকের স্থান, কাল, পাত্র এক রেখেই বাংলা নাট্যরূপ দিয়েছেন, ফলে সমাজ সচেতক দর্শক সহজেই নাটকের বিষয়বস্তু বর্তমান সময়ের সাথে রিলেট করে নেয়। কিন্তু সাধারণ দর্শককের কাছে শুধুমাত্র বিদেশী নাটকের সুন্দর বাংলা অভিনয় হিসেবেই থেকে যায়। কারণ মূল নাটকের গন্ডীর বাইরে গিয়ে নির্দেশক কোন স্বকীয়তার ছাপ রাখেননি, ফলে বিষয়বস্তুর গভীরতা মানুষের মনে তেমন কোন অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে গেল।
আমেরিকার হিলসবোরো শহরের এক স্কুল শিক্ষক বার্টন কেট তার ছাত্রদের ডারইনের ‘বিবর্তনবাদ’ পড়ান এবং চার্চ একে অপরাধ মনে করে কারণ বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীর সবকিছু তথা মানুষও ঈশ্বরের সৃষ্টি, তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, এর বিরুদ্ধাচরণ করা পাপ এবং সেকাজ যারা করে তারা শয়তানের দূত – ফলস্বরূপ চার্চের আদেশে গ্রেফতার করা হয় বার্টনকে, বাইবেল ও ধর্মের বিরোধিতার জন্য মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় আলোড়ন পড়ে যায় সমাজে, শহরের অধিকাংশ মানুষ বার্টনের বিরুদ্ধে গেলেও সে পাশে পায় তার ছাত্রদের, প্রেমিকা র্যাচেল এবং সাংবাদিক হর্নবেককে। শুরু হয় বার্টনের বিচার। ধর্মের (চার্চের) পক্ষে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উকিল হিসেবে দাঁড়ান বিখ্যাত আইনজিবী, বাইবেল বিশারদ, ও তিনবার রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ম্যাথু ব্রাডি, অপরদিকে বার্টনের পক্ষে (বিজ্ঞানের পক্ষে) সওয়াল করতে আসেন ম্যাথুর বাল্যবন্ধু দুঁদে উকিল হেনরী ড্রামন্ড। দুই যুযুধান প্রতিপক্ষের বাক্যপ্রয়োগ, যুক্তি পাল্টাযুক্তির আদান প্রদানে আদালত হয়ে ওঠে আইনি যুদ্ধক্ষেত্র। চার্চের যাজকদের মতে মতানুসারে বাইবেলই শেষ কথা বলে, বিজ্ঞানশিক্ষা এবং বিবর্তনবাদীরা সমাজে বিষ ছড়ায়, ধর্মগ্রন্থই সংবিধান – এইসব চাপিয়ে দেওয়া মতকে ড্রামন্ড যুক্তি সহকারে খণ্ডন করেন এবং বুঝিয়ে দেন যে বাইবেল হ’ল শুধুমাত্র একটি বই, চার্চ ও ধর্মগুরুরা মানুষকে তাদের মত করে চালনা করবার জন্যে এই বইটিকে ব্যবহার করে। যদিও শেষ পর্যন্ত বার্টন দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাকে একশ ডলার জরিমানা করা হয় এবং এই মামলা উচ্চ আদালতে স্থানান্তরিত হয়। এই নাটকের মূলভাবটি ড্রামন্ডের সংলাপে স্পষ্ট হয়, সে যখন বার্টনকে বলে – “শেষপর্যন্ত এই মামলা তুমি জিতবে কি হারবে জানি না, তবে তোমার এই প্রতিবাদী মানসিকতা অনেক মানুষকে সাহস যোগল।”
আসলে বিজ্ঞান তো তাদেরই বিরোধিতা করে, যারা যুগ যুগ ধরে ধর্মকে হাতিয়ার করে গোঁড়ামি, কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে নিজেদের অধীনে রাখতে চেয়েছে! বিজ্ঞান শুধুমাত্র সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে, জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটায়। মজার ব্যাপার যারা বিজ্ঞান শিক্ষার বিরুদ্ধাচারণ করে তারই আবার বিজ্ঞান দ্বারা আবিস্কৃত বহু সামগ্রী ব্যবহার করে অবলীলায়, তাই নাটকে সাংবাদিক হর্ণবেকের মুখে শুনি – “আমরা হয়তো আত্মাকে বাইবেলে চুবিয়ে রেখেছি কিন্তু রোজকার বাঁচার জন্য বিজ্ঞানকে চাকরি দিয়েছি।”
হেনরী ড্রামন্ডের ভূমিকায় সব্যসাচী চক্রবর্তীর সাবলীল অভিনয় নাটকের ভারকে অনেকখানি বহন করেছে, মঞ্চে তার দৃপ্ত চলাফেরা আর ঋজু বাচনভঙ্গি চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। পাদ্রি ব্রাউনের ভূমিকায় শান্তিলাল মুখার্জি, উদ্ধত যাজক ও স্নেহপ্রবণ পিতা, দুটি ব্যাক্তিত্ব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অসিত বসু তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ম্যাথু ব্রাডির চরিত্রটি প্রাণবন্ত করে তোলার চেষ্টা করেছন, তবে স্মৃতি দু-একবার তার সঙ্গে প্রতারনা করায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও নাটকের স্বাভাবিক গতি বাধা পায়। হর্ণবেক চরিত্রটি কমিক হলেও তার সংলাপের মাধ্যমে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে, চন্দন সেন সুন্দর নিয়ন্ত্রণে এবং দারুণ সময়জ্ঞানে চরিত্রটি অভিনয় করেছেন ফলে সংলাপের গুরুত্ব বিন্দুমাত্র হ্রাস হয়নি। র্যাচেলের ভূমিকায় তোর্ষা ব্যানার্জি ও ছাত্র হাওয়ার্ডের ভূমিকায় ঋতব্রত মুখার্জির অভিনয় চোখে পড়ার মত।
আলো (কল্যাণ ঘোষ) ও সঙ্গীত (গৌতম ঘোষ) নাটকের চাহিদা পূরণ করেছে মাত্র, অন্য কোন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। মঞ্চ (মদন হালদার) বেশ প্রশংসাযোগ্য, একটা রস্ট্রামকে পরিবর্তন করে বিচারালয় থেকে উপাসনা গৃহ তৈরি হয়ে যায়, তিরিশ জনের বেশী অভিনেতা অভিনেত্রী একসঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও সকলেই সুন্দর ভাবে দৃশ্যমান হন। পোশাক (মিতালি মুখার্জি, সোমা নাহা) ও রূপসজ্জা (দিলীপ দে) সময় এবং চরিত্রানুযায়ী হয়েছে।
নাটকের শেষ দৃশ্যে ড্রামন্ড এক হাতে বাইবেল ও অন্য হাতে ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ নিয়ে বুঝতে চায় কার ওজন বেশী! এই প্রতীকী দৃশ্যের মাধ্যমে এটাই বোঝা যায় যে বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ কি ভবিষ্যতের আলোর দিকে অগ্রসর হবে না আবার ফিরে যাবে মধ্যযুগীয় আঁধারে, তা ঠিক করতে হবে মানুষকেই!