দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে দেশের ছবি। বোধহীনতার এক আঁধার গলিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে দেশ, কিংবা বলা চলে গোটা দেশটাই হয়ে উঠছে এক আঁধার গলি! এই আঁধার থেকে মুক্তি পাবার পথ কী? কে দেখাবে আলো? এইসব প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান করেছে হাওড়া কদমতলা থিয়েটার ওয়ার্কার্সের নতুন নাটক ‘আঁধার গলি’’। গত ৬ই সেপ্টেম্বর তপন থিয়েটারে অভিনীত হল এই নাটক। যদিও এই রিভিউ ২৫শে জুন আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে ষষ্ঠ প্রদর্শনের উপর আধারিত। নাটক রচনা তপন কুমার হাজরা এবং নির্দেশনা অশোক ঘোষ।
Previous Kaahon Theatre Review:
বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী হিরন্ময়ী বসু যে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন সম্বল করে পথ চলা শুরু করেছিল সেই স্বপ্নকে আজও লালন করে এগিয়ে চলে পুত্র অনির্বাণ। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আঁধার গলিতে ভিড় জমাচ্ছে দুষ্টু লোকেরা আর ততই তীক্ষ্ণতর হচ্ছে অনির্বাণদের সংগ্রাম। রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র সাধ’ কবিতার শিশুটির মতো শৈশবে অনির্বাণ স্বপ্ন দেখত পাহারাওয়ালা হয়ে লন্ঠন হাতে গলির মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করবে দুষ্টু লোকেদের সব ষড়যন্ত্র! পাল্টে যাওয়া সময়ের পরিধিতে দাঁড়িয়ে এবং তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আঘাতে দীর্ণ অনির্বাণ আজ বাকশক্তিহীন, হারিয়েছে স্মৃতিশক্তিও। হিরন্ময়ী অনির্বাণকে নিয়ে আসে ডাঃ সেনের চেম্বারে, এখান থেকেই নাটকের শুরু। তারপর অনির্বাণের ছোটবেলা, ভালোলাগা-মন্দলাগা নানান ঘটনা ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়; এভাবে নাটক এগিয়ে চলে। সত্তর দশকের উত্তাল রাজনৈতিক সময় থেকে বর্তমান সময়কাল অবধি এই নাটকের পরিধি। অনির্বাণের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের নানা ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে সময়ান্তরে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদলে যাওয়া ছবিটি ফুটে উঠেছে। জন্ম থেকেই অনির্বাণের একমাত্র অবলম্বন তার মা, কারণ হিরন্ময়ী মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে স্বামীর সাথে সম্পর্ক ছেদ করে এবং তাকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দেয়। অনির্বাণ ছাড়া হিরন্ময়ীর কাছে পার্টিকর্মী শান্তনু, গৌতম, ধ্রুব, হাসি, এরাও আপনজন হয়ে ওঠে। স্বভাবতই এরাও অনির্বাণের কাছের মানুষ, পরিবারেরই সদস্য। বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শ নিয়ে বেড়ে ওঠা অনির্বাণ দ্রুত পাল্টে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভীষণভাবে ধাক্কা খায়, সে যখন হিরন্ময়ীকে বলে ‘তুমি পাল্টে যাচ্ছো মা’ তখন হিরন্ময়ী বা আমাদের কাছে কোনো উত্তর থাকে না। তাই অনির্বাণের বাকশক্তি লোপ বর্তমান ভয়ংকর সময়ের মধ্য দাঁড়িয়ে আমাদের প্রতিবাদহীনতার প্রতীক হিসেবে মূর্ত হয়। ডাঃ সেনের কাছে নানা ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে যখন অনির্বাণের মানসিক আঘাতের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করবার চেষ্টা চালাতে চালাতে হিরন্ময়ী ক্রমশ উপলব্ধি করে যে এই ঘটনার জন্য সেও কিয়দংশে দায়ী। তার এই আত্মোপলব্ধি তাকে আবার সংগ্রামের পথে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। এই নাটকে বর্তমান সংকটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তার প্রকৃত ভয়াবহ রূপটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং নাট্যকার ও নির্দেশকের রাজনৈতিক আদর্শগত অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একটি দিকনির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সত্তর দশকের যে উত্তাল ও অসহনীয় রাজনৈতিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিল বাংলার মানুষ তা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মতো বর্তমানে আবার ফিরে এসেছে অন্য রূপে আরো ভয়ংকর রূপে। একদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছে যার বিরুদ্ধাচারণ করলে মিলছে দেশদ্রোহীর তকমা। অন্যদিকে কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছে যা মানুষকে আরো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবে আলোর দিশা দেখাবে কে? সেই বামপন্থাই, যারা মানুষের অধিকার ও ঐক্যের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। নাট্যকার ও নির্দেশকের মার্কসীয় দর্শনের প্রতি দৃঢ় আস্থা এই নাটকে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রযোজনাটি এই সময়ের সঙ্গে অত্যন্ত মানানসই, তবে তা’ আরও বেশি সরাসরি এবং সাহসী হওয়া প্রয়োজন। সবকালেই রাজনৈতিক নাটক প্রদর্শনে বাধা আসার সম্ভবনা থাকে, বিশেষ করে নাটকের বক্তব্য যদি সঠিক লক্ষ্যে আঘাত করতে পারে! তাই যে শক্তির বিরুদ্ধে নাটকের অবতারণা তাকে নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করা অবশ্য কর্তব্য, নাহলে নাটকের মূল উদ্দেশ্য সঠিকভাবে দর্শকদের কাছে প্রকাশ পায় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখানে বিরোধী শক্তিগুলির পরিচয় স্পষ্ট করে প্রকাশ করা হয়নি, সবসময় একটা আড়ালের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। তার ওপর, ঘটনার সময়কালগুলো নির্দিষ্ট করে না দেওয়ায় প্রবল বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। জরুরী অবস্থার সময় অনির্বাণ স্কুলের কোন শ্রেণীতে পড়ত সেটা নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, সেই অনুযায়ী এখন তার প্রৌঢ়ত্বের সীমায় অবস্থান করার কথা, অথচ তাকে দেখে যুবক বলে মনে হয়! এই বিভ্রান্তি থেকে সময়কাল নিয়ে পর্যায়ক্রমে আরও অনেক বিভ্রান্তি তৈরি হয়, যেমন কলকাতায় বেসরকারি টিভি চ্যানেলের উত্থান বা ছোট আঙারিয়ার(?) ঘটনা, ইত্যাদি! নাটকটির শেষ দিকটা দেখে এরকম মনে হওয়া আশ্চর্য নয় যে প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর পরেরদিনই অনির্বাণের অ্যাটাক হয়, সেক্ষেত্রে প্রসঙ্গটা ডাক্তারের সামনে প্রথমেই উত্থাপিত হয় না কেন? শুধুমাত্র নাটকীয়তাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার জন্য? দু’একটি সংলাপের মাধ্যমে সময়গুলি নির্দিষ্ট করলে এই বিভ্রান্তি সহজেই দূর হতে পারে (অবশ্য এটাও সম্ভব যে মূল চরিত্রাভিনেত্রী অনেক সংলাপ ‘মিস’ করেছেন)। চরিত্রচিত্রণেও একাধিক জায়গায় রয়ে গেছে বেশ কিছু বিভ্রান্তি! হাসিমাসি ও শান্তকাকুর বিষয়ে কেন অনির্বাণ হাসির পক্ষে নয়, উল্টে শান্তর পক্ষে, সেটা একেবারেই পরিষ্কার নয়! হিরণ্ময়ীও যেন তিরিশ বছর পরে হঠাৎ করে একদিন লোকাল নেতাদের স্বরূপ আবিষ্কার করলেন! বামপন্থীরা ভোটে হেরে যাবার পরেই ময়দানে এসে গেল সাম্প্রদায়িক শক্তি – যেহেতু নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয় না, তাই এটা মনে হওয়া আশ্চর্যজনক নয় যে তৃনমূল কংগ্রেসের প্রসঙ্গটি যেন ইচ্ছা করেই যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে নাটকের উপস্থাপনার মধ্যে এমন একটা বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তৈরি হয় যা নাটকের রাজনৈতিক বক্তব্যকেও অনেকাংশে লঘু করে দেয়।
নাটকের অভিনয়ের কথা বলতে গেলে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ছোট অনির্বাণের ভূমিকায় স্নিগ্ধ বারুই-এর কথা, তার সাবলীল (stage free) অভিনয় সত্যিই মনে রাখার মতো। বড় অনির্বাণের ভূমিকায় গম্ভীরা ভট্টাচার্য বরাবরের মতো ভীষণ স্বাভাবিক অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রের ভিন্ন স্তর সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিন্দিয়া ঘোষ একজন সুঅভিনেত্রী, এ নাটকেও তার প্রমাণ রেখেছেন। মেক্-আপ পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় শুধুমাত্র কন্ঠ ও অভিব্যক্তি পার্থক্যের মাধ্যমে বয়সের তফাৎ উপস্থাপন করতে হয়েছে। তবে বৃদ্ধা হিরন্ময়ীর ভূমিকায় তার অতিরিক্ত কম্পিত কন্ঠ কিছুটা কৃত্রিম লাগে। ডাঃ সেনের ভূমিকায় রূপম ভট্টাচার্য বেশ মানানসই। হাসি চরিত্রে তুহিনা বসু সেন তার স্বাভাবিক অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। শান্তনুর ভূমিকায় অনুপম পালের অভিনয়ের মধ্যে একমাত্রিকতা থাকার ফলে চরিত্রটির বিভিন্ন স্তর সম্পূর্ণ রূপে এবং সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারেনি। নীল কৌশিকের মঞ্চপরিকল্পনার মধ্যে একটা বুদ্ধিমত্তার ছাপ পাওয়া যায়। নাটকের বিষয়বস্তুর সাথে তার ভাবনা সামঞ্জস্যপূর্ণ, আর অজিত রায়ের মঞ্চনির্মাণ তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। তাপস রায়ের ছিমছাম আবহের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের একটা সুর অনুভূত হয়, যা নাটকে বিশেষ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। নাটকে যে দুটি গান (নীল আকাশের নীচে চলচ্চিত্রে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার রচিত শীর্ষ সঙ্গীত ও নাট্যকার রচিত ‘কাদের সাথে হাঁটতে তুমি… ‘) ব্যবহার করা হয়েছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়ের আলোক পরিকল্পনায় কিছুটা পরিমিতি বোধের অভাব লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া উক্ত দিনের আলোকপ্রক্ষেপন বেশ ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় নাট্য গতিকে কিছুটা ব্যাহত করেছে। পল্লবী দাসের পোশাক পরিকল্পনার মধ্যে একটা ভাবনার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। যদিও নাটকের গঠনশৈলীর জন্য সব চরিত্রের পোশাক পরিকল্পনার সমান সুযোগ ছিল না তবুও অতি সাধারণ পোশাক আশাক দিয়ে তিনি চরিত্রগুলিকে যথাসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করে গেছেন।
বর্তমান টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এধরনের নাট্যপ্রযোজনা বেশ জরুরি। নাটকের শেষে যখন হিরন্ময়ীর কন্ঠে শুনতে পাই ‘একটা জন বিস্ফোরণ চাই’, সেটা হয়ে ওঠে আঁধার গলি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান। আশা করা যায়, দুর্বলতাগুলি দ্রুত কাটিয়ে উঠে এই নাটক আরও দৃঢ়তার সঙ্গে এই আহ্বান প্রকাশ করতে পারবে!