‘আধে আধুরে’ প্রখ্যাত হিন্দি সাহিত্যক মোহন রাকেশের বহুচর্চিত নাটক এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটকও বটে। এ নাটকে তিনি জীবনের বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে বসবাসকারী সংকটপূর্ণ মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকৃত ছবি তুলে ধরেছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিদিনের জীবন যাপন ক্রমশ গতানুগতিক হতে হতে এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। অধিকার, কর্তব্য, দায়িত্ব, এই সবের ভারে সংসারে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যখন অনুভূতির সূক্ষ্মবোধ হারিয়ে যায়, তখন সকলেই নিজেকে নিঃসঙ্গ অনুভব করে। নিজের অবস্থার জন্য একে অপরকে দায়ী করে। না পাওয়া অপূর্ণ মন সর্বদা একটা পূর্ণতা খুঁজে চলে। এই পূর্ণতার খোঁজ প্রত্যেকে নিজের মতো করে চালিয়ে যায়। মনস্তত্ত্বের এই জটিল অনুসন্ধান আছে এই নাটকে। নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটি বহুভাষায় রূপান্তরিত ও প্রদর্শিত হয়ে চলেছে এবং বলা বাহুল্য সফলতার সঙ্গে। নাটকটির বাংলা অনুবাদ করেছিলেন যৌথভাবে প্রতিভা অগ্রবাল ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্গানুবাদটির নামকরণ করা হয় ‘আধা আধুরে’। সেই ‘আধা আধুরে’ কে বাংলা রঙ্গমঞ্চে দর্শকদের কাছে নিয়ে এলো ‘শোহন’ নাট্যদল, নির্দেশনা অনীষ ঘোষ। গত ১৬ জুলাই আকাদেমি মঞ্চে হল এই নাটকের মঞ্চায়ন। যদিও এই রিভিউ ২রা জুন গিরিশ মঞ্চে নাটকের তৃতীয় মঞ্চায়নের নিরিখে করা হয়েছে।
Previous Kaahon Theatre Review:
এই নাটকের শুরুতে নামহীন এক চরিত্রের মুখে শোনা যায় যে সে নিশ্চিত করে নিজের সম্পর্কে যেমন কিছু বলতে পারবে না তেমন এই নাটক সম্পর্কে ও নিশ্চিত কিছু বলতে পারবে না। এই বক্তব্য ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক জীবনের অনিশ্চয়তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে যা এই নাটকের চরিত্র ও ঘটনার মধ্যে প্রতিফলন হয়। মহেন্দ্রনাথ ব্যবসায় অসফল হয়ে বহুদিন ঘরে বসে আছে। তার স্ত্রী চাকরি করে একা পাঁচজনের সংসার চালায়। পরিস্থিতি ও নিজেদের স্বভাবের জন্য একে অপরকে ঘৃণা করে, তবুও সামাজিক কারণে সহজে ছেড়ে যেতে পারে না। সাবিত্রীর চোখে মহেন্দ্রনাথ অলস, ব্যক্তিত্বহীন, তার ছায়ায় বেঁচে থাকা একজন মানুষ, তাই সে তাকে কোনো সম্মান করতে পারে না। সে জীবনযাপনের জন্য এমন জীবনসঙ্গী আশা করেনি। মহেন্দ্রনাথ ও সাবিত্রীর মতো পরিবারের বাকি সদস্যদের মধ্যেও পারস্পরিক বিরোধ লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেকে তারা নিজেদের অবস্থার জন্য একে অপরকে দায়ী করে। ছেলে শিক্ষিত বেকার। সাবিত্রীর সুপারিশে দু’এক জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা হলেও কোথাও সে টিঁকে থাকতে পারে না, চাকরি ছেড়ে দেয়। মহেন্দ্রনাথের মতো সে বেকার বাড়িতে বসে থাকে এবং সিনেমার নায়িকাদের ছবি কেটে জমিয়ে রাখে। বড় মেয়ে বিন্নী সাবিত্রীর পূর্ব প্রেমিকের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে। কিন্তু সে সুখী হতে পারে না, বর্তমানে বাড়িতে ফিরে আসে। ছোট মেয়ে কিন্নী জেদি, একগুঁয়ে, এবং কারোর কথা শুনতে চায় না। অপরিণত বয়সেই যৌন সম্পর্ক নিয়ে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে। মহেন্দ্রনাথ ও সাবিত্রীর সম্পর্কের তিক্ত অভিজ্ঞতা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলছে। এই নাটকে আমরা দেখতে পেলাম যে পরিবারে স্ত্রী পুরুষের (পিতামাতা) সম্পর্কে বদল এলে তা কিভাবে পরিবারের ভিত্তির উপর এবং অন্যান্য সম্পর্কের উপর প্রভাব বিস্তার করে। সাবিত্রী দৈনন্দিন একঘেয়ে গতানুগতিক জীবনযাপনের ক্লান্তবোধ করে। স্বামী, সন্তান, বা পরিবারের থেকে সে কোনরকম পরিপূর্ণতা খুজে পায় না। দিন যাপনের অপূর্ণতাকে সরিয়ে পূর্ণতা খোঁজে বহির্জগতে। তার জীবনে আসা পুরুষ রায়চৌধুরী, হিমাংশু, বা জগদ্বন্ধুর মধ্যে সে খুঁজে পেতে চায় পূর্ণতার অর্থ। কিন্তু সেই পূর্ণতা অধরাই থেকে যায়। আসলে এদের উপরের মুখোশটা শুধু আলাদা আলাদা ভেতরের মুখটা একই। সে মুখ যেন মহেন্দ্রনাথেরই। এ নাটক বর্তমান মধ্যবিত্ত পরিবারের সমস্যা ও তার ফলে উদ্ভুত অসংগতির ছবি তুলে ধরেছে। এই সমস্যার কারণ হিসেবে দেখা যায় বর্তমান ভোগবাদী সমাজের সীমাহীন চাহিদা যা সম্পূর্ণ করা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়, সেই কারণে একটি অপূর্ণতা সর্বদা থেকে যায়। অন্যদিকে প্রত্যেকে নিজ নিজ অহংকারের ফলে নিজেদের দোষ বা খামতি দেখতে চায় না, একে অপরের দিকে আঙুল তোলে, ফলে পরিবারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
এই নাট্যের মূল আধার এর অভিনয়। অনির্বাণ চক্রবর্তী বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন অভিনেতা। তিনি সংলাপ উচ্চারণ, অভিব্যক্তি, চলাফেরা, ইত্যাদি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পাদন করেন আর তাতে অভিনীত চরিত্রটি এমন জীবন্ত হয়ে ওঠে যা দর্শকদের মনে ছাপ রেখে যায়। যেকোন ধরনের চরিত্রেই তিনি নিজেকে ঢেলে দিয়ে সহজে সেই চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন, তাই তিনি একজন স্বয়ং সম্পূর্ণ অভিনেতা। এ নাটকে তার অভিনয় অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছে। তিনি প্রারম্ভিক চরিত্রটি সহ মহেন্দ্রনাথ, রায়চৌধুরী, হিমাংশু, ও জগবন্ধু, মোট পাঁচটি ভিন্নচরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং প্রতিটি চরিত্রের ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা করে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। যেমন মহেন্দ্রনাথ চরিত্রে খবরের কাগজ নিয়ে দোমড়ানো, বা চেয়ার তুলে মেঝেতে ঠোকা, বা ফাইল খোঁজার নামে শব্দ করে আছড়ে ফেলা, প্রভৃতির মাধ্যমে মনে জমে থাকা ক্ষোভের অসহায় প্রকাশ সুন্দর ফুটে ওঠে। আবার রায়চৌধুরী চরিত্রের অতিরিক্ত কথা বলা এবং হাবভাবের মধ্যে একদিকে যেমন ক্ষমতার দম্ভ অপরদিকে তার কামুক প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটেছে। বাচন ভঙ্গি ও অভিব্যক্তির সামান্য তারতম্য ঘটিয়ে হিমাংশু ও জগবন্ধু চরিত্রদুটিকে সুন্দরভাবে ভিন্নরূপে উপস্থাপন করেছেন। সাবিত্রী চরিত্রে সুমনা মুখার্জি দারুণভাবে অনির্বাণ চক্রবর্তীকে সঙ্গত করেছেন। সংসারের চাপে পড়ে নিজের আশা আকাঙ্খা জলাঞ্জলি দেওয়া নারীর অভিমানী, খিটখিটে মেজাজটা অভিনয়ে সুন্দর ফুটে উঠেছে। হিমাংশুর সাথে অভিনয়ের দৃশ্যে তার মনের কথা বলতে না পারার দ্বন্দ্ব সুন্দর ব্যক্ত হয়েছে। চরিত্রের এই দুটি স্তর স্পষ্ট ও পৃথকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এর পাশাপাশি বিন্নী চরিত্রে মধুমিতা দামের অভিনয় বেশ প্রশংসার যোগ্য, বিশেষ করে শেষভাগে তার নীরব অসহায় অভিব্যক্তি অনেক দিন মনে থাকবে।
নাটকের মঞ্চও একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে। মঞ্চ জুড়ে অগোছালো ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র যেন সংহতিহীন, অসম্পূর্ণ এক পরিবারের ছবি। আলো (সৌমেন চক্রবর্তী) ও আবহ (গৌতম ঘোষ) এই প্রযোজনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছ। যেমন সাবিত্রী যখন হিমাংশুর সঙ্গে দেখা করতে যাবার প্রস্তুতি নেয় তখন তার স্বপ্নব্যক্ত করতে তার মুখে পড়া নীলরঙের আলোর ক্রমশ বৃদ্ধি বিশেষ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। বিন্নী যখন তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলে তখন তার উপর পরা লালরঙের আলো তার ভেতরের যন্ত্রণাকে ঈঙ্গিত পূর্ণভাবে প্রকাশ করে। ছোট ছোট শব্দের ব্যবহার বেশ অর্থবহ হয়ে ওঠে। মহেন্দ্রনাথের বইপত্র ছুঁড়ে ফেলা, বা চেয়ারের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার শব্দ, কিংবা সাবিত্রীর তরকারি কাটার শব্দের তীব্রতা বৃদ্ধি মনের অন্তর্দ্বন্দ্বকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছে।
মোহন রাকেশ গত ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন ‘আধে আধুরে’ লিখেছিলেন তখনকার মধ্যবিত্ত পরিবারের আশা আকাঙ্খা, সমস্যা, অসংহতি, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ছবি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন। আজও এই নাটকের বিষয়বস্তু সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাই এ নাটক হয়ে উঠেছে কালজয়ী। এ শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত চেতনার নাটক নয়, এ নাটক হয়ে উঠেছে সাধারণ জীবনের নাটক। এ নাটক সর্বকালেই মানুষের মনে ছাপ ফেলতে পারবে। এমন নাটক বাংলা রঙ্গমঞ্চকে উপহার দেবার জন্য ‘শোহন’ নাট্যদলকে ধন্যবাদ।