আবৃত্ত – যাত্রা ও মেগা সিরিয়ালের মাঝে বাংলা থিয়েটার

Posted by Kaahon Desk On October 24, 2019

বাংলা লোকসংস্কৃতির প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী বিনোদন মাধ্যমগুলির মধ্যে ‘যাত্রাপালা’ অন্যতম। বহু প্রাচীনকাল থেকেই যাত্রা গ্রামীণ জনসাধারণের চিত্ত বিনোদনের পাশাপাশি লোকজীবনের গঠন, বিকাশ, ও মানসিক চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ফলত এই মাধ্যমটির গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা ছিল প্রশ্নাতীত। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক থেকে সামাজিক পালার ভীষণ রমরমা ! ক্ল্যারিওনেট, কর্নেট, ফ্লুটের সমবেত কনসার্ট তৈরি করত এক বিশেষ মোহময় পরিবেশ। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় জমাতেন রাতভর যাত্রার আসরে তাদের প্রিয় শিল্পীদের অভিনয় দেখার জন্য। অন্যান্য বিনোদন মাাধ্যমের প্রভাবে যাত্রা আজ তার কৌলীন্য হারিয়েছে, ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে এক বিলুপ্তপ্রায় শিল্পে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে যাত্রা হিসেবে বাজারে যা প্রচলিত আছে তা শুধুই সস্তা মনোরঞ্জনের প্যাকেজ মাত্র, যাত্রার মূল উপাদান তাতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই! যাত্রা নিয়ে এই অবতারণার কারণ হল নান্দীপটের নবতম প্রযোজনা ‘আবৃত্ত’ নাটকটি গড়ে উঠেছে একদা যাত্রার সঙ্গে যুক্ত চারজন মানুষের পরস্পরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই নিয়ে। নাটকটির রচয়িতা তীর্থঙ্কর চন্দ এবং নির্দেশনা করেছেন প্রকাশ ভট্টাচার্য। গত ১৭ই অক্টোবর গিরিশ মঞ্চে অভিনীত হল নাটকটি।

Previous Kaahon Theatre Review:

বর্তমান বিরামহীন প্রবাহমান সময়ে আমরা সবাই ছুটে চলেছি অর্থ আর খ্যাতির পিছনে।নিজেদের ভালোমন্দের গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর সমাজের দিকে লক্ষ্য করার সময় কোথায়! আমাদের ঐতিহ্যবাহী পুরোনো সাংস্কৃতিক লোকমাধ্যমগুলি ক্রমশ তার কৌলীন্যও গুরুত্ব হারাচ্ছে, তার জায়গায় স্থান করে নিয়ে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মনোরঞ্জনের নতুন নতুন মাধ্যম। নতুনকে সর্বদা স্বাগত জানানো উচিত, তবে পুরোনোকে ভুলে গিয়ে বা অস্বীকার করে নয়। যাত্রা পালার মতো ঐতিহ্যসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ধারা আজ তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে এবং দূরদর্শন ধারাবাহিকের মতো মনোরঞ্জনের আপাত লঘু মাধ্যম সেই জায়গা দখল করে মানুষের মনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একদা যাত্রার জনপ্রিয় শিল্পী বা একনিষ্ঠ কর্মী যারা আজ ভীষণ দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে, আমরা তাদের কথা মনে রেখেছি কি?

একদা জনপ্রিয় যাত্রা শিল্পী তারক পাল এখন শুধুই অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে বর্তমানে কঠোর বাস্তবতার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছেন। মেয়ে রাজলক্ষ্মী, উমাশশী, আর কার্তিক যাত্রাকে ভালোবেসে তার আদর্শকে বুকে নিয়ে হাজার অভাবকে অতিক্রম করে বেঁচে আছে। কারণ যাত্রার স্পন্দন প্রতিনিয়ত এদের রক্তে প্রবাহমান। কার্তিক মেগা সিরিয়ালের পরিচালক স্বপন মুখোপাধ্যায়কে প্রস্তাব দেয়, তারক পালের জীবন নিয়ে কাজ করার জন্য, যা অবহেলিত যাত্রা শিল্পের তথ্যচিত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কার্তিক এর মাধ্যমে তারক পাল তথা যাত্রাশিল্পের কথা মানুষের কাছে তুলে ধরতে চায় তেমনই আবার এর থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে অল্পকিছুদিনের জন্য হলেও অনটনের সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে চায়। কাজ করতে এসে স্বপন বাবু সন্ধান পান রাজলক্ষ্মীর অসাধারণ গানের গলার। তার এই প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে ধারাবাহিক বা নিয়ে বাণিজ্যিক সাফল্যের অঙ্ক কষা শুরু হয়ে যায়। বিশাল অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেওয়া হয় রাজলক্ষ্মীকে। গৌন হয়ে যায় তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজটি। স্বপনবাবুর আচরণে তারক পাল ও যাত্রা শিল্পের প্রতি এক তাচ্ছিল্যের ভাব লক্ষ্য করা যায় যা কার্তিক বা অন্যদের চোখ এড়ায় না। শুটিংয়ের মাঝে রাজলক্ষ্মীর প্রতিবাদী সত্ত্বা বিদ্রোহ করে ওঠে। প্রলোভনকে হেলায় তুচ্ছ করে সে ঘোষণা করে আত্মসম্মান খুইয়ে সে কোনো আপোষ করবে না।

নির্দেশক নাট্য নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে না হেঁটে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মূলবিষয়কে সহজ সরলভাবে দর্শকদের কাছে উপস্থিত করেছেন। নাটকে যাত্রা এবং মেগাসিরিয়ালের মধ্যে একটা স্পষ্ট বিভাজন রেখা টানা রয়েছে যার মাধ্যমে দুই জগতের মধ্যে অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের ফারাকটা ও ফুটে উঠেছে। মঞ্চ সজ্জাতেও (সন্দীপ সুমন ভট্টাচার্য) ভাঙ্গা চোরা পুরোনো বাড়ির পাশে বহুতলের আদল, দুটি মাধ্যমের প্রতীক হিসেবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নাট্যকার তীর্থঙ্কর চন্দ ও নির্দেশক প্রকাশ ভট্টাচার্যের যুগলবন্দিতে যাত্রা শিল্পের গৌরব, অতীত ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য, ও তার আবেগ বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবার একটি প্রয়াস নান্দীপটের এই নাটক ‘আবৃত্ত’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে যাত্রার নানা উপাদান যেমন সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন তেমনই তাঁর লেখায় যাত্রার গুণাগুণও বৈশিষ্ট্য বার বার উঠে এসেছে।স্বাধীনতা আন্দোলনে যাত্রার (স্বদেশী যাত্রা ) উল্লেখযোগ্য অবদানের কথা ভুলে গেলে চলবে না। অতীত ও বর্তমানের অনেক নাট্যব্যক্তিত্ব তাদের কাজে এই মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন যা থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে এই মাধ্যমের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।

তারক পালের স্মৃতিরোমন্থন এবং কার্তিক ও রাজলক্ষ্মীর দুটি দীর্ঘ মনোলগের মাধ্যমে তাদের জীবনও যাত্রার অতীতকে তুলে ধরা হয়েছে। রাজলক্ষ্মীর মনোলগের অংশটি সঞ্জিতা তার বাচিক ও শারীরিক অভিনয় এবং নাচ ও গানের সুন্দর সংমিশ্রণে সাবলীল ভঙ্গিমায় প্রকাশ করেছেন ফলে বিষয়টি দর্শকদের কাছে যেমন উপভোগ্য হয়ে উঠেছে সাথে সাথে তাদের মনেও একটি বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। কার্তিক চরিত্রে অভিজিৎ সরকার তার অভিনয় ক্ষমতার দ্বারা চরিত্রটি সঠিকভাবে প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছেন। তার অভিনয়ে মাঝে মাঝে বর্তমান সময়ের এক বিশিষ্ট অভিনেতার ছায়া লক্ষ্য করা যায়, এই প্রভাব থেকে বের হতে পারলে তার নিজেস্বতায় এই চরিত্রটি আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। রাজলক্ষ্মীর মনোলগের বিপরীতে কার্তিকের মনোলগের দৃশ্যটি কিছুটা ম্লান লাগে, বৈচিত্র্যের অভাবে তথ্য পরিবেশনের দায় বলে মনে হয়। অংশটি কিছুটা দীর্ঘ লাগে, দুটি পৃথক অংশে ভাগ করে পরিবেশন করতে পারলে ভালো হত বলে মনে হয়। নাটকের বিষয়বস্তু যেহেতু যাত্রা তাই খুব সচেতনভাবেই অভিনয়ের সুরটা একটু উচ্চকিত করা হয়েছে। ফলে তারক পালের (বিপ্লব নাহা বিশ্বাস) যাত্রার অভিনয় অংশগুলি আলাদা করে কোনো ব্যাঞ্জনার সৃষ্টি করতে পারেনা। তবে একটা অন্যদিকও আছে, তার জীবনটা যে যাত্রা ময় হয়ে রয়েছে তা সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

Jera – Imitation of foreign movie on stage; lacks the credibility factorআলো (ত্রিগুণা শঙ্কর) ও আবহে (স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়) যাত্রার এক বিশেষ স্মৃতিমেদুরতা পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ সময় লো লাইটের ব্যবহার যাত্রার জৌলুসহীনতাকে প্রকাশ করেছে ফলে নাটকের মুডটি সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। যাত্রার দৃশ্য অভিনয়ের সময় আলোর ব্যবহার সঠিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। আবহে যাত্রার অনুভূতি থাকায় নাটকের মূল ভাবটির সাথে মিশে গিয়ে তাকে সঠিক দিশায় চালিত করতে সাহায্য করেছে।

নাট্যকার তীর্থঙ্কর চন্দের নাটকে মানুষের জীবন সংগ্রাম ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দেখতে পাই। এ নাটকেও তিনি সেই কথাই তুলে ধরেছেন যা থেকে যাত্রা শিল্পের প্রতি তার আবেগ ও দায়বদ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে। নির্দেশক প্রকাশ ভট্টাচার্য ও নান্দীপট দল এই নাটকটি মঞ্চস্থ করে অধুনা অবহেলিত যাত্রা শিল্পের প্রতি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও তা নিয়ে ভাবনার জায়গা তৈরির চেষ্টা করেছে। তবে এই কাজ মানুষের মনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে তা সময়ই বলবে। এই নাট্য প্রয়াসের জন্য নাট্যকার, নির্দেশক, ও নাট্যদলকে সাধুবাদ জানাতেই হবে।

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us