আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বলুন তো থিয়েটারের সঙ্গে সিনেমার কি পার্থক্য? তাহলে সবচেয়ে আগে যে উত্তরটা আপনি দেবেন, সম্ভবত তা হল থিয়েটার একটা লাইভ মিডিয়াম।চোখের সামনে দেখতে পাই কিছু মানুষ হেঁটে চলে একটা কিছু করছে। আসলে মঞ্চের উপরে তৈরি হওয়া অভিনেতা ও কলাকুশলীদের মিলিত এনার্জি দর্শকাসন পর্যন্ত এসে পৌঁছোয়।সেইজন্য একটা ভালো নাটক দেখতে বসলে দর্শকদের ও ইমোশনাল অ্যারাউসাল হয় এবং পুরো নাটকটা একটা এক্সপেরিয়েন্স হয়ে ওঠে। সিনেমার ক্ষেত্রে সেটাও এমন একটা এক্সপেরিয়েন্স দিতে পারে। কিন্তু তার ভাষা হয় আলাদা। কারণ সেই মাধ্যমটা আলাদা।প্রত্যেকটা ফর্মের মধ্যেই মানুষকে নাড়িয়ে দেওয়ার মত ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর প্রকাশ বিশেষ ভাবে মাধ্যম নির্ভর। প্রত্যেকটা মাধ্যমের ভাষা, প্রয়োগ, ইলিউশন তৈরি করার ধরণ যেহেতু বিভিন্ন রকমের তাই একটা ফর্মের ভাষায় অন্য ফর্মে কাজ করতে চাইলে তা করতে হয় অত্যন্ত সতর্ক ভাবে।
Previous Kaahon Theatre Review:
এই আলোচনা করছি কারণ বাংলা থিয়েটারে এক ধরণের চল শুরু হয়েছে থিয়েটারকে সিনেম্যাটিক করে তোলার। তবে সেটা খারাপ না ভালো সেই আলোচনা করবার জন্য এই লেখা নয়। কথা হচ্ছে যখন সেটা করা হচ্ছে তখন সেটা প্রয়োজনীয় কিনা। প্রয়োজন ব্যাপারটা যথেষ্ট সাব্জেক্টিভ হলেও নাটক দেখে মোটামুটি বুঝতে পারা যায় সেটা নাটকের ক্ষেত্রে কতখানি অপরিহার্য ছিল। যেমন অনেক সিনেমাও চূড়ান্ত নাটকীয় ভাবে তৈরি করা হয় বিশেষ কোন প্রয়োজন মেটাতে। (উদাহরণঃ টুয়েলভ অ্যাংরি মেন)। দুর্ভাগ্যের বিষয় এখন বেশীর ভাগ বাংলা নাটকে (এমনকি বিখ্যাত নির্দেশকদের নাটকেও) যে ধরণের সিনেম্যাটিক এমপ্লয়মেন্ট দেখতে পাওয়া যায় তার প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে দর্শকদের সিনেম্যাটিক এন্টারটেইনমেন্ট এক্সপিরিয়েন্স করানো। কিন্তু বিষয় হল থিয়েটার যদি সিনেমার এক্সপিরিয়েন্স দেওয়ার চেষ্টা করে তা কখনোই সিনেমায় দেওয়া সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্সের কাছাকাছি পৌঁছতে পারবেনা। ফলতঃ একটা থিয়েটার তার নাটকীয় এলিমেন্ট গুলো ব্যবহার করে যতটা শক্তিশালী হতে পারত, সিনেম্যাটিক হতে গিয়ে সেটা থেকে যাচ্ছে মাঝপথে একটা জগা-খিচুড়ি অবস্থায়। দর্শকও একটা থিয়েটার থেকে এমন কিছু পাচ্ছেন না যেটা শুধুমাত্র থিয়েটার থেকেই পাওয়া সম্ভব।
নাট্যজন নামক তুলনায় নতুন একটি নাট্যদলের নতুন প্রযোজনা ‘আমার শহর’। ব্রাত্য বসুর ছায়ায় লালিত পালিত এই দলের কর্ণধার শুভজিৎ বিশ্বাস। এই নাটকটির লেখক নির্দেশক ও তিনিই। এই নাটকটা এই রকমই প্রয়োজন ছাড়া চূড়ান্ত সিনেম্যাটিক হয়ে ওঠার একটা প্রচেষ্টা।শুরুতে অ্যানিমেটেড টাইটেল ক্রেডিট সহযোগে টাইটেল সং ছাড়াও গোটা নাটকে আলো, শব্দ, মঞ্চ-ব্যবহার, সিন ডিভিশন এবং সিনোগ্রাফি খুবই সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। নির্দেশক যেন ঠিকই করে রেখে ছিলেন মঞ্চের উপরে একটু সিনেমা করা যাক। যদিও তাঁদের মুখ্য উপদেষ্টা মঞ্চের উপর সিনেম্যাটিক ভাষা তৈরি করতে বিশেষ পছন্দই করেন, কিন্তু তাঁর প্রয়োগের মধ্যে একধরণের তৈরি করে নেওয়া ‘প্রয়োজনীয়তা’ লক্ষ্য করা যায় (সম্ভবত তাঁর জ্ঞান, শিক্ষা এবং বিস্তর অভিজ্ঞতার কারণে)। এই ‘প্রয়োজনীয়তা’-র ব্যাপারটা এই নাটকে পাওয়া গেল না। একদল নতুন থিয়েটার লাভারের কাছ থেকে আর একটু থিয়েট্রিকাল কাজ আশা করাটা হয়ত খুব বেশী কিছু চাওয়া নয়।
তবে একটা বিষয়ে এই নাটকটিকে সাধুবাদ না দিলেই নয়। অমুক লেখকের তমুক লেখা থেকে ইন্সপায়ার্ডের বাজারে এই নাটকটা একটা অরিজিনাল নাটক। নাটকের বিষয়বস্তু আমাদের শহরে নিত্য ঘটে চলা রাজনৈতিক বিড়ম্বনা, জনগণের সমস্যা, নেতাদের সেই সমস্যায় কর্ণপাত না করা এবং একজন সাধারণ যুবার সেই সমস্যার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। দলের বেশীর ভাগ অভিনেতাই এই নাটকে অভিনয় করার জন্য প্রথমবার মঞ্চে উঠেছেন। তাঁরা যতটা পেরেছেন করার চেষ্টা করেছেন। মুখ্য দুই ভূমিকায় অয়ন দত্ত ও প্রান্তিক চৌধুরী যথেষ্ট সাবলিল অভিনয় করার চেষ্টা করে গেছেন। সর্বোপরি হয়ত নতুন দল বলেই এদের পরিবেশনার মধ্যে এক ধরণের কাজ করার ইচ্ছে দেখতে পাওয়া গেছে। যা বিখ্যাত নাটকের দলগুলোর মধ্যে একেবারেই দেখতে পাওয়া যায় না। এরকম নতুন নতুন ঠিক ভুল, খারাপ ভালো, কাঁচাপাকা কাজ বাংলা থিয়েটার অনেক বেশী ডিসার্ভ করে, অত্যন্ত পাকা, অ্যারোগেন্ট, দিশাহীন এবং বিখ্যাত কাজগুলির তুলনায়। দর্শক হিসেবে আমাদের সকলের কর্তব্য এই রকম নতুন প্রচেষ্টার পাশে থাকা, তাঁদের কাজ দেখে খারাপ ভালো যা লাগল সেই মতামত তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এরকম চেষ্টাগুলোর মধ্যে দিয়েই হয়ত বাংলা থিয়েটার আবার সবুজ সতেজ হয়ে উঠবে।