রূপতাপস নাট্য দলের নবতম প্রযোজনা ‘স্থানাঙ্ক’-র তৃতীয় অভিনয় অনুষ্ঠিত হল মধুসূদন মঞ্চে গত ৩রা মার্চ। নাটকটি লিখেছেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায় এবং নির্দেশনা করেছেন কৌশিক ঘোষ।
নীল, জ্যোতি, আর অনু তিন বন্ধু যারা যৌবনে বামপন্থী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজ বিপ্লবের দ্বারা গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখত। এই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেবার মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিল থিয়েটারকে। পরিবর্তিত সময়ে জ্যোতি ও অনু পৌঁছে যায় সমাজের উচ্চস্তরে। জ্যোতি এখন একজন স্বনামধন্য নাট্যকার আর টেলিভিশন ধারাবাহিকের লেখক। স্কুল শিক্ষিকা অনু এখন জ্যোতির স্ত্রী। অপরদিকে নীল তার আদর্শের পথে অবিচল থাকে, তার স্থান হয় জেলে। বহুদিন পর জেল থেকে বেরিয়ে আকস্মিকভাবে এই না-পাল্টানো নীল, মুখোমুখি হয় পাল্টে যাওয়া জ্যোতির। অবশ্যম্ভাবীভাবেই শুরু হয় আদর্শগত দ্বন্দ্ব। আসলে বিশ্বাস বা আদর্শের বদল ঘটে না, বদল ঘটে মানুষের — সেই মানুষ সুবিধা মতো তার স্থান বদল করে বা করতে বাধ্য হয়, আর স্থান বদলের যুক্তি সাজিয়ে নেয় যে যার নিজের মতো করে! আর যে স্থান বদল না করে আবিচল থাকে সে হয়ে ওঠে সমাজের চোখে ব্যতিক্রম, অন্যরকম। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল এটা নির্ধারণ হবে কিভাবে? একজন শিল্পী তার শিল্পের মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করবে না কি বলবে বৃহত্তর সমাজের কথা? এই সব প্রশ্নের সামনে দর্শকদের দাঁড় করিয়ে দেয় এই নাটক।
Previous Kaahon Theatre Review:
খুব সহজ সরল ভাবে নাট্য উপস্থাপনের ফলে নাটকের শুরু থেকেই দর্শকরা সহজেই নাটকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। শুধুমাত্র সংলাপের মাধ্যমে স্মৃতিচারণ এবং কিছু ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যের দ্বারাই নাটকটি বুনন করা হয়েছে। শুধুমাত্র আলো ও চরিত্রের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যগুলি তৈরি করা হয়েছে এবং দ্রুত তার সাথে বর্তমান সময়ে ফিরে এসেছে, নাট্যগতিতে কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়েই। এই ধরনের ভাবনার মধ্যে একটা স্মার্টনেস লক্ষ্য করা গেছে। রাজনৈতিক আদর্শের দ্বন্দ্ব ও আত্মবিশ্লেষণই যেহেতু নাটকের মূল উপজীব্য তাই সাধারণ রাজনৈতিক নাটকের থেকে এই নাটক কিছুটা ভিন্ন। নাটকের সময়কাল নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা না হলেও নানা রেফারেন্স থেকে বোঝা যায় এটি বর্তমান সময়, আর সেখানেই তৈরি হয় সংশয়। একজন বামপন্থী রাজনৈতিক বন্দী (অন্তত গত শতাব্দীর সাতের দশকে তাকে বন্দী করা হয়েছিল) কী কারণে এত দীর্ঘ সময় জেলে বন্দী ছিলেন তার পরিস্কার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
মূলত সংলাপ নির্ভর এ নাটকের মূল চালিকাশক্তি অভিনয়। নাটকের তিনটি চরিত্র জ্যোতি, অনু, ও নীল; অভিনয় করেছেন যথাক্রমে কৌশিক ঘোষ, শিপ্রা মুখোপাধ্যায়, এবং অশোক মজুমদার। এই তিনজনের অভিনয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া লক্ষ্য করা যায় যা নাটককে সাবলীলভাবে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। তাদের অভিনয়ের পেশাদারিত্ব পরস্পরকে কমপ্লিমেন্ট করে। স্মার্ট উচ্চারণ, সঠিক অভিব্যক্তি, ও মঞ্চের সম্পূর্ণ অভিনয় স্পেসের ব্যবহার চরিত্রগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চভাবনায় বাস্তবতার পাশাপাশি প্রতীকের ব্যবহার দেখা যায়। নাট্যকারের (জ্যোতি) ডয়িংরুমে একদিকে বুকশেলফ এবং মঞ্চের অন্যদিকে বিশালাকার বই ও পেন এমনকি চেয়ারের পেছনের অংশটিও পেনের নিবের আদলে তৈরি করা হয়েছে। ঘরের কম আলোকিত অংশে কার্লমার্কসের সাদাকালো ছবির ব্যবহার বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ত্রিগুণা শংকর এর আলো বিশেষ কয়েকটি মূহুর্ত সৃষ্টি করে বটে, তবে নাটকের মূলভাবের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে উঠতে পারে না। একাধিক রঙিন আলোর উৎসের ব্যবহার সবসময় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এই নাটকে পল্লব কীর্তনিয়াকে আবার পাওয়া গেল। তার আবহ ও গানের ব্যবহার নাটককে সমৃদ্ধ করেছে। আবহে ব্যবহারের পাশাপাশি নৈঃশব্দ্যকেও সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
রূপতাপস দলটি বয়সে নবীন হলেও, তাঁদের পূর্ববর্তী প্রযোজনাগুলির বিষয় নির্বাচনে যে বিশেষ ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা গেছে তা’ দর্শকদের সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে ভাবনার অবকাশ সৃষ্টি করেছে। এ নাটকেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। চারপাশের হতাশা, বিভ্রান্তি, বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি সময়ের আয়নার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। নাটকের দ্বন্দ্ব সহজেই দর্শকদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, আর সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকেই উত্তর খুঁজে নেবার চেষ্টা করে তাঁরা। পরিশেষে রূপতাপস নাট্যদলের কাছে একটিই প্রত্যাশা, ভবিষৎতে তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস থেকে স্থানচ্যুত হবেন না।