গত ১৯শে নভেম্বর, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের রানু মুখোপাধ্যায় মঞ্চে অভিনীত হল বাংলা নাটক ‘শব চরিত্র কাল্পনিক’ (নাটকের নামে ‘শব’ শব্দটা মৃতদেহ অর্থে ব্যবহৃত)। পরশুরামের গল্প ‘মহেশের মহাযাত্রা’ নিয়ে নাটকটা লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী, নির্দেশনায় অনমিত্র খাঁ, প্রযোজনায় ‘বিডন স্ট্রিট শুভম রেপার্টারি’।
রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০) ওরফে পরশুরামের লেখা এই গল্পটা ভীষণই পরিচিত, আর অন্তত আশি বছরেরও আগে লেখা। এখনকার কোনো নাটকের দল যখন এইরকম একটা গল্পকে সিলেক্ট করেন, তখন অনেকগুলো গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেমন – গল্পটা বর্তমান সময়ে নিয়ে আসা হবে কিনা, কোনো নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করা হবে কিনা, কোনো নতুন ইন্টারপ্রিটেশন দেওয়ার চেষ্টা করা হবে কিনা – এই সব। নবীন নির্দেশক অনমিত্র খাঁ এবং ‘টিম শুভম’ এই সম্পর্কিত যে ক’টি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার সবই যে একশোভাগ উৎরে গেছে তা’ বলা যায় না, কিন্তু প্রতিটা সিদ্ধান্তের পেছনে যথেষ্ট চিন্তাভাবনার ছাপ খুঁজে পাওয়া গেছে, এবং এটাই এই নাটকটাকে বাজার চলতি আর পাঁচটা নাটকের চেয়ে অনেকটাই আলাদা করে দিয়েছে।
Previous Kaahon Theatre Review:
দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হরিনাথ কুণ্ডু ভূতে বিশ্বাস করেন, আর তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু অঙ্কশাস্ত্রে পণ্ডিত মহেশ মিত্র হলেন ঘোর অবিশ্বাসী – আর এই দুটো চরিত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়েই কাহিনী। পরশুরামের আসল গল্পটার শেষে মহেশ মারা যান, আর তার শেষ যাত্রার সঙ্গে ছুটতে থাকেন হরিনাথ। এই নাটকটা, শুরু হয় তার ঠিক পর থেকেই। ছুটতে ছুটতে চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় হরিনাথও মারা যান, আর সেই মৃত্যুর তদন্ত করতে আসে পুলিশ। তারপর সেই তদন্তের রেশ ধরে, টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাকের মধ্যে দিয়ে, প্রকাশ পায় আসল গল্পটা। সেই গল্পটা, কিছু সংযোজন বাদ রাখলে, মোটামুটিভাবে পরশুরামের আসল কাহিনীটাকেই ফলো করে। তফাৎ শুধু এখানেই যে গল্পটাকে পুরোনো সময় থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে বর্তমানে। তবে এই পরিবর্তনটা করতে গিয়ে এটা সবসময় মাথায় রাখা হয়েছে যে এখনকার মানুষ নিজের শিক্ষা বা যোগ্যতা অনুযায়ী কিভাবে কথা বলতে পারেন, বা কেমন আচরণ করতে পারেন। তাই এই চেঞ্জটা দর্শক হিসেবে আপনার কাছে যথেষ্টই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে। তবে নাটকের বিশেষ গঠনের প্রসঙ্গে আমরা আবার পরে ফিরে আসব।
আসা যাক আঙ্গিকের প্রশ্নে। পরশুরাম তার লেখায় সামান্য অতিরঞ্জন ব্যবহার করে এমন একটা সমান্তরাল দুনিয়া নির্মাণ করেন যেখানে তার চরিত্রদের অদ্ভুতুড়ে কার্যকলাপগুলো সুন্দরভাবে খাপ খেয়ে যায়। পরশুরামের সেই দুনিয়াটাকে মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে গেলে নির্মাণের সমস্ত পর্যায়ে – মঞ্চ, আলো, অভিনয় – সবকিছুতেই বাস্তবতার সীমার বাইরে গিয়ে ভাবার দরকার। এখানে ঠিক এই কাজটাই করা হয়েছে বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে। মনিভদ্র সাহুর মঞ্চভাবনা বাস্তবানুগ পথে হাঁটেনি; ব্যবহার করা হয়েছে রোস্ট্রাম, ব্লক, প্লাস্টিকের চেয়ার, আর কয়েকটা নোটেশন স্ট্যান্ড।খুবই ফ্লেক্সিবল মঞ্চ, এইরকম একটা নাটকের জন্য আরও বিশেষ করে উপযোগী, যেখানে প্রচুর আলাদা আলাদা জায়গায় ঘটনাগুলো ঘটে। এইরকম ডায়নামিক মঞ্চভাবনাকে যোগ্য সাপোর্ট দেয় শুভঙ্কর দে-র আলোকভাবনা। লাইটসোর্সগুলোকে আলাদা আলাদা ব্যবহার করে দৃশ্য পরিবর্তন, সময়ের পরিবর্তন – সবকিছুর পেছনেই পরিকল্পনা আর অনুশীলনের ছাপ ফুটে বেরোয়। অভিনয়ের ক্ষেত্রেও দেখতে পাবেন স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি পরিমান অঙ্গসঞ্চালন, সংলাপও কিছুটা টেনে টেনে বলা। সঙ্গে রয়েছে মাইমের ব্যবহার, যার পরিকল্পনা করেছেন শান্তিময় রায়। সব মিলিয়ে যে দুনিয়াটা তৈরি হয় সেটা বেশ কনসিসটেন্ট। প্রথম দৃশ্যেই চলন্ত গাড়ির ইলিউশন তৈরি করে নাটকের যে সুরটা বেঁধে দেওয়া হয়, সেটা শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে। আর নাট্য নির্মানের সমস্ত উপকরণগুলোর ট্রায়ামফ দেখা যায় ভূতের দৃশ্যগুলোতে। বাংলা নাট্যমঞ্চে এরকম কন্ট্রোলড ভূতের আবির্ভাব আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে লম্বানখের পেত্নি তো ভীষণই অভিনব, শেখ ইস্রাফিলের রূপসজ্জা যথেষ্ট প্রশংসার দাবিদার। তবে ট্র্যাডিশনাল বাঙালি ভূতেরা বেশি সংখ্যায় থাকলে ভালো লাগত। সৌমাল্য পাকড়াশীর পাশ্চাত্য ধর্মী সঙ্গীত নাটকের মুডের সঙ্গে মানানসই। নবেন্দু সেনগুপ্তর পোশাক পরিকল্পনাও যথাযথ, ধুতি-পাঞ্জাবিতে হরিনাথকে প্রাথমিকভাবে মেনে নিতে অসুবিধা হলেও পরে নাটকে প্রসঙ্গটা ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। কমবেশি সব অভিনেতাদের অ্যাকশন-রিঅ্যাকশনের মধ্যেই অনুশীলনলব্ধ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। মহেশ চরিত্রে সৌপর্ণ রায় আর হরিনাথ চরিত্রে স্বয়ং নির্দেশক পরস্পরকে চমৎকার কমপ্লিমেন্ট করেন। বিশেষ দৃশ্যে একাধিক মহেশের উপস্থিতি, মঞ্চে ঝুলন্ত ফাঁসির দড়ি, গবেষণার নোটে ভরা বিশাল ব্যাকড্রপ – নির্দেশকের উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচায়ক। কারেন্ট টাইম আর ফ্ল্যাশব্যাকের কুইক ওভার ল্যাপ দিয়ে দিয়ে নির্দেশক খুব দ্রুততার সঙ্গে নাটকটা বাঁধেন, অভিনেতারা যোগ্য সঙ্গত করেন, তাই দর্শক হিসেবে আপনি প্রতিমুহূর্তেই নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকবেন। সব মিলিয়ে একটা চমৎকার নাট্য নির্মাণ, এই গল্পটার সঙ্গে ভীষণ অ্যাপ্রোপ্রিয়েট।
নির্মাতারা এখানে বিশেষ সাহসিকতা দেখিয়েছেন কাহিনীর একটা নতুন ইন্টারপ্রিটেশন দেবার চেষ্টা করে। গল্পের ভূত এখানে শুধু ভূত নয়, বরং মানুষের অতীতের গ্লানি, যা তার বর্তমানকে গিলে খেতে চায়। আর এখানেই থেকে গেল এই নাটক নিয়ে একটা বড় আক্ষেপের জায়গা। এই নাটকের ভূত হয়ে উঠতে পারত একটা রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট, কোনো বিশেষ আদর্শ বা চিন্তাধারা – অবিশ্বাসীরা যেখানে পরিত্যক্ত, সামাজিক কারেক্টিভ প্রসেসের অন্তর্গত[১]। নাটকটা সেদিকে খানিকটা এগিয়েও যেন সাহস করে পুরোটা যেতে পারেনা। পেত্নি চরিত্রটা কিছুটা গভীরতায় যেতে পারলেও, ছাত্রের মৃত্যুর কারণ হিসেবে যে স্টোরিটা দাঁড় করানো হয়েছে সেটা ভীষণই অর্ডিনারি। তাই একটা বৃহত্তর সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে স্পর্শ করার সম্ভাবনা দেখিয়েও নাটকটা যেন লক্ষ্যে পৌঁছনোর আগেই দাঁড়িয়ে পড়ে। তবে এটা নেহাতই একটা সম্ভাবনার কথা, কী হলে কী হতে পারত সেই নিয়ে আলোচনা – নাটকটা যেটুকু অ্যাচিভ করেছে সেটা অনেক! প্রসঙ্গত, এই মুহূর্তে কলকাতা মঞ্চে চলছে পরশুরামের আরেকটা গল্প নিয়ে নাটক, লক্ষীর বাহন (কাহন থিয়েটার রিভিউ- লক্ষীর বাহন)। ঐ নাটকের গতানুগতিক মঞ্চায়নের সঙ্গে তুলনা করলেই এই নাটকের স্বাতন্ত্র্য খুব সহজে চোখে পড়বে!
ফিরে আসা যাক নাটকের গঠনের প্রসঙ্গে। একটা পরিচিত গল্পকে একটু অন্যভাবে প্রকাশের তাগিদে এইরকম উল্টো করে শুরু করার ট্রিকটা বহু ব্যবহৃত – কিন্তু এতে করে নাটকটাকে মূলকাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কহীন বেশ কিছু দৃশ্যের ব্যাগেজ বইতে হয়। এখানে যেমন পুলিশি তদন্ত রিলেটেড দৃশ্যগুলো, যেগুলো নাটকের বেশ কিছুটা সময় খেয়ে বসে থাকে। তার বেশিরভাগটাই আবার সাধারণ মানের কমেডি, যেখানে সংলাপ আর আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে দর্শক হাসানোর চেষ্টা করা হয়। উল্টোদিকে পরশুরামের হাস্যরস কিন্তু কিছুটা বিদগ্ধ শ্রেণীর; কখনোই হোহো করে হেসে গড়িয়ে পড়ার মতো নয়। তাই মূল গল্পের নাট্যরূপ অংশের সঙ্গে পুলিশিতদন্ত অংশের গুণগতমানের একটা তফাৎ কিন্তু চোখে পড়ে। মনে করা যেতে পারে যে এই তফাৎ ইচ্ছাকৃত – কিন্তু সেক্ষেত্রে মহেশের মৃত্যুর পরে হরিনাথ ও ভৃত্য পরশের সাক্ষাতের দৃশ্যটা? পরশ চরিত্রে সুদীপ ধাড়া অসাধারণ, ঐ সংযোজিত দৃশ্যটায় তার অভিনয়ে আপনার হাসি পাবেই, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঐ ধরনের হাস্যরস মূল গল্পের শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। প্রযোজনাটা আরও দুঃসাহসিক হতে পারত যদি ঐ তদন্তের অংশ বাদ দিয়ে গল্পটাকে সোজা করেই বলা হত, তাহলে মহেশ আর তার অতীতের ভূতেদের মধ্যে অংশটা আরও বেশি করে এক্সপ্লোর করার সময় সুযোগ পাওয়া যেত।
এই নাটকটি দু’ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিনীত হয়ে চলেছে, এটি ছিল ১৬তম শো। কিন্তু অতি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেল যে প্রেক্ষাগৃহের অধিকাংশ আসনই খালি। বাংলা নাটকের মননশীল দর্শকেরা কোথায় গেলেন? গ্রিক নাটকের অক্ষম অনুবাদ, বিদেশী সিনেমার টুকলি, জনপ্রিয় অভিনেতাদের লম্ফঝম্প, নিরাপদ রাজনৈতিক বুলি সর্বস্ব নাটকতো অনেকই দেখলেন, এক ঝাঁক তরুণ যুবক যুবতীর উৎসাহ, উদ্দীপনা, আর উদ্ভাবনায় ভরা এই প্রযোজনাটিও একবার দেখুন না! হয়ত দেখবেন, বাংলা নাটকের ভবিষ্যৎ নিয়ে আবার আশান্বিত হচ্ছেন!
[১] কাছাকাছি ধরণের ট্রিটমেন্ট দেখা গেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’তে, নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘হারবার্ট’ উপন্যাসে, বা অনুরাগ কাশ্যপ পরিচালিত ‘নোস্মোকিং’ ছবিতে।