অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের লেডি রাণু মুখোপাধ্যায় মঞ্চে ২৪শে নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হল ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ প্রযোজিত ‘লক্ষ্মীর বাহন’ নাটকের অভিনয়। পরশুরামের লেখা ঐ একই নামের গল্প থেকে নাটকটি রচনা করেছেন অনিল সাহা, নির্দেশনায় কমল মান্না। উপদেষ্টার ভূমিকায় রয়েছেন থিয়েটার ওয়ার্কশপের কর্ণধার, বর্ষীয়ান অভিনেতা ও নির্দেশক অশোক মুখোপাধ্যায়। এই রিভিউ নাটকের প্রথম অভিনয় ৩১শে মার্চ, ২০১৯ তারিখে (অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস)-এর নিরিখে করা হয়েছে।
রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরাম (১৮৮০-১৯৬০) যে কেবলমাত্র বাংলা ভাষার সেরা রঙ্গব্যঙ্গ লেখক হিসাবে স্বীকৃত তাই নয়, তিনি নিজে যেহেতু একজন বিজ্ঞানসাধক ছিলেন, তাই তাঁর রচনাগুলি ভীষণ পরিমিত এবং নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসূচক। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য মূলতঃ সামাজিক রীতিনীতি ও আদবকায়দা, মূল্যবোধের অভাব, আর দুর্নীতি। তাঁর গল্পের পটভূমি প্রধানত বাস্তবানুগ, কিন্তু তার মধ্যেই আপাত সাধারণ কিছু বিচ্যুতিকে উপলক্ষ্য করে তিনি এক অতিরঞ্জিত সমান্তরাল দুনিয়া তৈরি করেন, এবং হাস্যরসের মাধ্যমে সেই বিচ্যুতিগুলিকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন। ‘লক্ষ্মীর বাহন’ গল্পের পটভূমি স্বাধীনতার সমসাময়িক বাংলাদেশের একটি শহর, চরিত্র হিসাবে রয়েছে যুযুধান দুই অসাধু ব্যবসায়ী, অর্থলোলুপ ভাই, ধার্মিক স্ত্রী, বখাটে সন্তান, আশ্রিত শ্যালক, এবং দুর্নীতিগ্রস্ত আইনরক্ষক। কাহিনীতে যে অবক্ষয় ও নৈতিক অধঃপতনের বর্ণনা রয়েছে তা’ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, তাই হয়ত নির্মাতারা এই গল্পটিকে বেছে নিয়েছেন। নাট্যরূপান্তরের ক্ষেত্রে অনিল সাহা মূল আখ্যানের চলনকেই অনুসরণ করেছেন – কাহিনীটি বর্ণিত হয় ফ্ল্যাশব্যাকে – সঙ্গে সূত্রধার হিসাবে সাহায্য করেন শ্যালক তারাপদ। তিনি দর্শকদের প্রথমেই জানিয়ে দেন যে পরশুরাম বলে গেছেন এই কাহিনী ‘পণ্ডিতজী’র জমানার, কিন্তু বর্তমান সময়ের কিছু ছাপ দর্শকরা পেলেও পেতে পারেন! আর এই ‘বর্তমান’এর ছাপ দর্শকদের পাইয়ে দেবার জন্য বখাটে সন্তান লখার চরিত্রটিকে করে দেওয়া হয় ইমারতী দ্রব্য সরবরাহের ‘সিণ্ডিকেট’এর সদস্য, সংলাপে শোনা যায় ‘পরিবর্তন’এর কথা, এছাড়া বর্তমান সময়ের একাধিক পরিচিত ব্যক্তির নামও শোনা যায়! বাকি নাটকের ঘটনাপ্রবাহ এবং চরিত্রদের পোশাক আশাক, সবই বিংশ শতকের মধ্যভাগের দিকেই ইঙ্গিত করে, শুধু লখার চরিত্রটির পোশাক, সাজসজ্জা, ও আদবকায়দা একেবারে সমসাময়িক (পোশাক পরিকল্পনাঃ অরুণ ব্যানার্জী)। পুরোনো কাহিনীর প্রাসঙ্গিকতা নাট্যনির্মাণের মধ্যে দিয়ে আপনিই উঠে আসবে এমনটাই প্রত্যাশিত, কিন্তু দর্শককে সেই প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করাতে যদি এইরকম সরাসরি প্রয়োগকৌশলের সাহায্য নেওয়া হয়, তবে তা’ কি নির্মাতাদের নিজেদের নাট্যভাবনার প্রতি আস্থার অভাবকেই সূচিত করেনা?
Previous Kaahon Theatre Review:
পরশুরাম যখন চরিত্রদের মুচুকুন্দ রায় বা কৃপারাম কচালু জাতীয় অপ্রচলিত নাম দেন, বা তাদের মধ্যে বিবাদের কেন্দ্রে রাখেন একটি প্যাঁচাকে, তার মধ্যে দিয়েই কিন্তু কাহিনীর নিজস্ব সমান্তরাল জগতটা নির্মিত হতে থাকে। এই জগতকে মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে তুলে ধরাটা বেশ কষ্টসাধ্য – তার জন্য মঞ্চসজ্জা, আলো, আবহ, ও সর্বোপরি অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ আঙ্গিকের প্রয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই নাটকটি নাট্যনির্মাণের কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষ চিন্তাভাবনার স্বাক্ষর রাখতে ব্যর্থ। একমাত্র নীল কৌশিকের মঞ্চভাবনায় তবুও কিছুটা বিমূর্ত ভাবনার ছাপ আছে, পশ্চাদপটে প্যাঁচার অবয়ব এবং তিন বাঁদরের প্রয়োগ যথাযথ, কিন্তু নাটকের সামগ্রিক উত্তরণের জন্য তা’ যথেষ্ট ছিলনা। এমনকি ঐ পশ্চাদপটটিকে বাদ রাখলে মঞ্চের বাকি অংশের নির্মাণ যথেষ্ট গতানুগতিক। দীপঙ্কর দে’র আলো এবং অনিন্দ্য নন্দী’র শব্দপ্রয়োগ, দুই-এর কোনোটাই সাধারণত্বের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনা। অভিনয়ের ক্ষেত্রে ভৃত্য অনাথ চরিত্রে জগবন্ধু চক্রবর্তী এবং তারাপদ চরিত্রে নীলাভ চট্টোপাধ্যায়কে সপ্রতিভ লাগে। ক্ষৌরকারের চরিত্রটিকে খুঁড়িয়ে হাঁটানো হয়, যেটি একটি অতি সাধারণ কৌতুককর টেকনিক, কিন্তু মঞ্চ থেকে প্রস্থানের সময় তিনি ধীরে ধীরে সোজা হয়ে যান। সবচেয়ে হতাশ করেন মুচুকুন্দ রায়ের চরিত্রে আশিস মুখোপাধ্যায়, তাকে পুরো নাটক জুড়েই ক্লান্ত আর অবসন্ন লাগে, যা তার চরিত্রটির সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। আর একটা বড় সময় জুড়ে তিনি মঞ্চের উপর সোফায় উপবিষ্ট অবস্থায় থেকেই সংলাপ বলতে থাকেন, যা নাটকটিকে দৃশ্যত স্থবির করে দেয়। লখা চরিত্রে জন মুখোপাধ্যায় আর কৃপারাম কচালু চরিত্রে কৃষ্ণগতি চট্টোপাধ্যায়, দুজনেই বেশ কিছু স্টিরিওটাইপ মেনে অভিনয় করে যান। সবমিলিয়ে, নাটকটি সত্তর আশির দশকের পাড়ার ক্লাবে অভিনীত গড়পড়তা নাটকের থেকে খুব একটা এগিয়ে থাকতে পারেনা!
পরশুরামের একটি গল্পকে কোনো নাট্যগোষ্ঠী অভিনয়ের জন্য নির্বাচন করবেন কেন? কাহিনীর প্রাসঙ্গিকতার জন্য? তাহলে এমন নাট্যনির্মাণ করতে হবে কেন যেখানে প্রাসঙ্গিকতাটি মুখে বলে দর্শকদের জানিয়ে দিতে হবে? আর হতে পারে যে ঐ কাহিনীর কোনও নতুন ব্যাখ্যা বা নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করাটাই উদ্দেশ্য! কিন্তু পুরো নাটকটিতে এমন কোনো প্রচেষ্টাই চোখে পড়ল না! তবে কি নাটকটি নির্বাচন করা হয়েছে শুধুমাত্র পরশুরামের নাম আর কাহিনীর কৌতুকরসের কথা ভেবেই? ভাবলে অবাক লাগে, এই থিয়েটার ওয়ার্কশপ দলটিই একদা দর্শকদের উপহার দিয়েছিলেন চাক ভাঙা মধু, আলিবাবা, বা বেলা অবেলার গল্প-র মতো নাটক! নতুন প্রজন্মের হাতে দলটি আবার তার হৃতগরিমা পুনরুদ্ধার করুক, এই আশাই করি।