অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের লেডি রাণু মুখোপাধ্যায় মঞ্চে ৩রা আগস্ট, ২০১৯ তারিখে অভিনীত হল নাট্যরঙ্গ গোষ্ঠীর প্রযোজনায় বাংলা নাটক ‘রিটার্ন টিকিট’। যদিও এই রিভিউ ঐ একই মঞ্চে ২৮শে মার্চ, ২০১৯-এর অভিনয়ের নিরিখে করা হয়েছে। নাটক রচনা ও সহনির্দেশনায় রজত মল্লিক, সম্পাদনা ও নির্দেশনায় স্বপন সেনগুপ্ত। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন বর্তমান বাংলা নাট্যজগতের কিংবদন্তীসম অভিনেতা গৌতম হালদার।
Previous Kaahon Theatre Review:
নাটকটি আবর্তিত হয় মনোরোগ চিকিৎসক ডঃ অণ্বেষক রায়কে ঘিরে! চারজোড়া রোগী তাদের মানসিক সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন, এবং ডাক্তার এক অভিনব, বা বলা যেতে পারে উদ্ভট, উপায়ে তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। সেই উপায়টিই হল ‘রিটার্ন টিকিট!’ লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে এই নাটকের নামের সঙ্গে একটি ছোট্ট ক্যাপসান জুড়ে দেওয়া আছে – ‘একটি অলীক নাট্য’, ইংরাজিতে ‘A fantasy Drama.’ নাটকটিতে সত্যিই কিছু ফ্যান্টাসির উপাদান আছে, এটা একধরণের অলীক স্বপ্ন ফেরি করে, আবার এই নাটকের মধ্যে দিয়ে কিছু সামাজিক অসঙ্গতি তুলে ধরারও একটা চেষ্টা আছে। তাই হয়ত নাটকটিকে একধরণের Fantasy of Manners বলা যেতে পারে যেখানে ফ্যান্টাসির উপাদানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে সমাজের রীতিনীতির বিশ্লেষণ। নাটকটি হাস্যরসাত্মকও বটে, অন্তত প্রথমাংশে মুহুর্মুহু কৌতুকপূর্ণ সংলাপ ও আচরণের ঠেলায় হাস্যসংবরণ করা বেশ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে! তাই অন্যদিক থেকে নাটকের ধারাটিকে Comedy of Manners বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রায় পুরো নাটকটিই অভিনীত হয় একটি অলীক স্পেসে, ঐ মনোরোগ চিকিৎসকের চেম্বারে, যেখানে স্থান-কাল খুব স্পষ্টত সংজ্ঞায়িত নয়, তবে আন্দাজ করে নেওয়া যায় যে পরিবেশটি শহুরে। দেবব্রত মাইতি কৃত মঞ্চসজ্জাতে ঐ ফ্যান্টাসি দুনিয়াটি তৈরি করার চেষ্টা পুরোমাত্রায় বর্তমান; তাকে পরিপূরণ করে ডোরবেলের ‘হরিবোল’ ধ্বনি, যা একইসঙ্গে কৌতুককর ও অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। টেবিলের ওপর রাখা রোবট আর অস্বাভাবিক বড় মোবাইল ফোনের ব্যবহারও সুচিন্তিত। মনোরোগী হিসাবে যারা আসেন তাদের সমস্যাগুলিতেও শহুরে ছাপ স্পষ্ট – অবিশ্বাস, সন্দেহ, অহঙ্কার, দ্বিধা, ভয়, সমাজবিমুখতা, ইত্যাদি। তবে নাট্যকার সমস্যাগুলির গভীর-বিশ্লেষণ বা কার্যকারণ খোঁজার রাস্তায় হাঁটেননি, মোটামুটিভাবে আলস্য ও কর্মহীনতাকেই সমস্যাগুলির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। টুকরো দৃশ্যে খুব দ্রুত এবং বেশ কার্যকরীভাবে তাদের সমস্যাগুলো দর্শকের কাছে পৌঁছে যায়। তবে ‘ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা’ এবং ‘প্রেমিক/প্রেমিকা’, এই দুইজোড়া রোগীর সমস্যার ধরণ প্রায় একইরকম, তুলনায় বাকিদের সমস্যাগুলি অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষ হলে শুরু হয় চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীদের কথোপকথন, আর সেটাই নাটকের সিংহভাগ জুড়ে! এই অংশটি অভিনয়নির্ভর আর এটিই নাটকের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় অংশ!
যে নাটকে গৌতম হালদার থাকেন, তার বিশেষ অভিনয়শৈলী দিয়ে সমস্ত মনোযোগ তিনিই টেনে নেন। গত তিনদশক ধরে তাকে আমরা মঞ্চে দেখে আসছি, তার অভিনীত সমস্ত চরিত্রেই থাকে অদ্ভুতরসের আধিক্য। যে নাটকের বিন্যাসে বা চরিত্রের গঠনে ঐ অদ্ভুত ব্যাপারটি থাকে, সেখানে গৌতমের অভিনয়শৈলী খুব ভালো খাপ খেয়ে যায়, এবং সৌভাগ্যবশত এটি সেরকমই একটি নাটক। গৌতমের পোশাক ও রূপসজ্জার মধ্যেও রয়েছে ঐ অদ্ভুতরসের ছোঁয়া (পোশাক পরিকল্পনা – রঞ্জনা দাস, রূপসজ্জা – মহম্মদ আলী, সঞ্জয় পাল)। ফ্যান্টাসি অফ ম্যানার্সের চলন অনুযায়ী, এই ধরণের চরিত্র ঠিক কী করছে সেটা ততটা গুরুত্ত্বপূর্ণ নয়, যতটা কিনা চরিত্রটি ঠিক কী বলছে! আর নিজের শরীরের সমস্ত অংশ ব্যবহার করে সংলাপকে দর্শকের মগজে পৌঁছে দিতে গৌতম সিদ্ধহস্ত, বাকি অভিনেতারাও তাকে যথেষ্ট সঙ্গত করেন। কৌতুকাভিনয়ের একটা মূল অস্ত্রই হল সময়জ্ঞান, আর এই সময়জ্ঞানের নিরিখে গৌতমের সঙ্গে রীতিমত পাল্লা দিয়ে যান প্রথম বন্ধু চরিত্রে সায়ন্তন রায়চৌধুরী এবং প্রেমিকা চরিত্রে দেবপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়। ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা চরিত্রে তিমির চক্রবর্তী ও বেবী হালদার, এবং রিসেপশনিস্ট অনুসন্ধিৎসা সেনের ভূমিকায় অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন। বাকিরা তুলনায় কিঞ্চিৎ ম্লান। টেক্সট এবং অভিনয়ের সুচারু সমন্বয়ে নাটকের প্রথমার্ধটি ভীষণই উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ার্ধে নাটকের এই ফ্যান্টাসির জগতটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বাস্তবের নিষ্ঠুর আঘাতে, নাট্যকার এবং পরিচালকের সেটাই উদ্দেশ্য ছিল। সাংবাদিক ও চিকিৎসকের প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যটি দেখলে বোঝা যায় যে পরিচালক এই ফ্যান্টাসি ও রিয়ালিটির ওভারল্যাপ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। এমনকি শেষ দৃশ্যে পর্দার পড়ার ঠিক আগে গৌতমের বিশেষ কার্যটিও সুচিন্তিত। কিন্তু এই অংশটিতে টিভি চ্যানেল দুটির নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতনতার প্রয়োজন ছিল। ‘ভেবেই আনন্দ’ এবং ‘১২ ঘন্টা’, এই নাম দুটি এতই ঈঙ্গিতবাহী, আর তার সঙ্গে দুই সাংবাদিকের আচরণ এতটাই মোটাদাগের যে সেটা অতি সাধারণ মানের মনোরঞ্জন বলে মনে হয়, এবং তা’ নাটকের বাকি অংশের সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এইধরণের নাটকের পরিবেশ তৈরিতে আলোকসজ্জা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু জয়ন্ত দাসের আলোকভাবনা আলাদা করে কোনও সাহায্য করে না। বরং একটিমাত্র বিশেষ সময়ে ব্যবহার করা হবে বলে একটি আলোকউৎস, সারা নাটক জুড়ে, মঞ্চের ঠিক মাঝবরাবর ঝুলতে থাকে, যা বেশ দৃষ্টিকটু। তবে শুভেন্দু মাইতির সঙ্গীত গৌতমের গলায় বেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
নাটকটির প্রথমাংশের গঠন বিশেষ আশাপ্রদ ছিল, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে নির্মাণে সূক্ষ্মতার অভাবে সেই গঠন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই নাট্যকার ও পরিচালকের প্রাণপাত চেষ্টা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত নাটকটি একটি উপভোগ্য কৌতুকনাট্যের সীমারেখা অতিক্রম করে দর্শককে কোনও বৃহত্তর বোধের জগতে নিয়ে যেতে পারেনা। নাট্যকার রজত মল্লিকের এটি প্রথম লেখা নাটক, আশা করব পরবর্তী নাটকে তিনি তার প্রতিভার প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার করবেন।