গ্রীকপুরাণে ক্রেউসার নাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। ক্রেউসা অফ এথেন্স তাদের মধ্যে অন্যতম। এই ক্রেউসা অফ এথেন্সকে নিয়ে ইউরিপিদিস “আয়ন” নামের এক নাটক রচনা করেছিলেন। সেই ক্রেউসা অফ এথেন্সকে নিয়েই ব্রাত্য বসু রচনা করেছেন তাঁর অরিজিনাল নাটক “রাণী ক্রেউসা”। ইউরিপিদিসের নাটকের সাথে বা অরিজিনাল ক্রেউসামিথের সাথে এই নাটকের খুব একটা মিল নেই।*
সম্প্রতি নাটকটির অভিনয় হল ২৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০তারিখে পানিহাটি লোকসংস্কৃতি ভবনে।
চেতনা প্রযোজিত, সুজন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত “রাণীক্রেউসা”র সফর বেশ সমকালীন এবং ক্রেউসার গল্পটা এই সময়ের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলার ছবিটা বর্ণনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। নাটকে এই ব্যাপারটা বেশ স্পষ্ট হয়ে যায় যে ধর্ম, দেবতা, রাজনীতি, কূটনীতি এবং অবভিয়াসলি রাষ্ট্রনীতি এগুলো সবই পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং একটা “বিগ গেমে” যে যার সুবিধে এবং সুযোগ মত এই সব এলিমেন্ট ম্যানিপুলেট করে ক্ষমতা পেতে বা প্রদর্শন করতে চাইছেন। ভালবাসার শক্তি টক্তি ওসব বাজে কথা, ঘৃণার শক্তি অনেক বেশী কারণ মানুষের মনে আবেগের আর কোন জায়গা নেই।
Previous Kaahon Theatre Review:
রানী ক্রেউসাকে শুরুতেই আমরা দেখতে পাই চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক দৈব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে বসে রয়েছেন। দেব আপল্লন ইচ্ছে এবং প্রয়োজন মত ম্যানিপুলেট করে চলেছেন রাষ্ট্র, রাজা, ক্ষমতা উত্তরসূরি প্রভৃতি। বারবার তাঁর “ইচ্ছে”র ধাক্কায় আন্দোলিত হতে ক্রেউসা নারাজ। ভাল হোক, মন্দ হোক দেবতার (সিস্টেমের) হাতের পুতুল সাজতে তাঁর আর ভাল লাগছে না। দেশে ইলেক্ট্রা নাটকের অভিনয় হচ্ছে জানিয়ে নাট্যকার আমাদের ইঙ্গিতে বলে দেন ঠিক আজকের সময়ের মতই সিস্টেমের বিরুদ্ধে গলা তোলার একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেছে। “সিস্টেম” (দেবতা) অমোঘ, অপার শক্তিশালী এবং সতত বর্তমান হওয়া সত্বেও ক্রেউসার চরিত্র তাঁর সামান্য নশ্বরতা নিয়েই তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়। এইটি করতে গিয়ে তাঁকে এমন একটি কাজ করতে হয় যা তৎকালীন সমাজের চোখে অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য। এখনকার সময়ের কথা ভাবতে গেলে সে অপরাধ এমন কিছু অপরাধ বলে নাও মনে হতে পারে, কিন্তু সিস্টেম তো নিজের সুবিধে মত এক এক সময়ে এক এক রকম অপরাধ দাগিয়ে দেয়। তাই না?
সেই অপরাধ কি সেটা বলব না। বলছি না নাটকের গল্প ও (পরের শো দ্রষ্টব্য)। তবে ভগবানের বিরুদ্ধাচারণে রাণীর এই সোচ্চার পদক্ষেপে জনগণ বরাবরের মতই দিশেহারা এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেসন বিপদগ্রস্ত বোধ করতে শুরু করে। বিচারসভা বসে এবং বিচারের নামে শুরু হয় দীর্ঘ এক প্রহসন। মানুষজন যত না ক্ষুব্ধ তাঁর থেকেও বেশী বিব্রত এবং ভয়ার্ত। যে সিস্টেমের প্রতি আস্থা থেকে তৈরি হয়েছে তাদের বেসিক সিকিওরিটি এবং জীবনের পারপাস সম্পর্কে ধারণা, যেই সিস্টেম তাদের আনকনশাসে ঢুকে রয়েছে, সেই সিস্টেমটি নড়ে গেলে তারা কি করবে তারা জানে না। এই ভয় তাদের ভাবনার শক্তিকে আরও ক্ষীণ করে তোলে। সামান্য ম্যানিপুলেশনেই আগের বক্তব্য থেকে সরে একেবারে অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক আজকের মত। তাই না? এই নাটক তাই গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রে জনগণের ভূমিকাকে আর একবার ভাবতে শেখায়। আর গণতন্ত্রের নামে যে ইললজিক এবং ক্ষমতার সুবিধার্থে তৈরি করা নিয়মের বেড়াজাল, আইডেন্টিফাই করতে শেখায় তাকেও। এই অবস্থায় ঠিক একটি এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট প্লে এর মতই দর্শকরূপী জনগণকেও অসহায় বোধ করানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছে। এই কনফ্লিক্টটি নাট্যকার দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন একটি কোর্টরুম দৃশ্যে। গ্লকাস এবং অ্যাজিপ্তাস যেখানে দুর্ধর্ষ এক লজিকাল-ইলজিকাল কনভারসেশনে এঙ্গেজড হন। গ্লকাসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শ্রী সুপ্রিয় দত্ত। একটি মাত্র দৃশ্যে তাঁর উপস্থিতি। তাও গোটা নাটকে অনস্বীকার্যভাবেই তিনিই সেরা।
এই দৃশ্যটা এত মন দিয়ে লেখা হয়েছে যে এরকম একটা সন্দেহ তৈরি হতে পারে, হয়ত এই দৃশ্যটাই নাট্যকার আগে ভেবেছিলেন। তারপর তার আশেপাশে প্লট তৈরি করার জন্য রচিত হয়েছে বাকি নাটক। সত্যি, নাটকের বাকি সিন গুলোর বাঁধুনি এতটা পোক্ত নয়। কিছু কিছু দৃশ্য একটু জোর করে চাপানো মনে হয় কারণ একই প্রশ্ন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে দাগিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা রয়েছে। বিশেষত শেষ দৃশ্যে কর্ণ কুন্তি সংবাদের ইনক্লুশন ছাড়াই দর্শকের কাছে কনফ্লিক্টটা যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল এবং কর্ণকুন্তী সংবাদের কথাই মনে করাচ্ছিল। তা যদি স্পষ্ট ভাবে না বলে দেওয়া হত, তাহলে হয়ত মুহূর্তটা আর একটু গভীরতা পেত। মীরজাফর নাটকেও নাট্যকার এই রকম অনেক সমসাময়িক অ্যালিউশন ব্যবহার করেছিলেন। এ কি নাটকটাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে সমকালীন করে তোলার চেষ্টা? নাকি বিভিন্ন কমিউনিকেশন এর মধ্যে দিয়ে একই থিমকে বারবার বলে দেওয়ার চেষ্টা সেই নিয়েও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। সুপার ন্যাচেরাল এলিমেন্টদেরদের ডায়লগও বেশ জটিল এবং বাকি অংশের ডায়লগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয় না। হয়ত অই অংশগুলো বাদ দিলেও সময় এবং জীবনবোধ তার সমস্ত জটিলতা এবং ফ্যালাসি নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হত। এতসব বারংবার দাগিয়ে দেওয়া নাটকের গতি এবং সূক্ষ্মতা নষ্ট করে দেয়। দর্শকের উপর একটু ভরসা করে দেখুন না…
চরিত্রে বিভিন্ন রকম শেড থাকার কারণে ক্রেউসার চরিত্রে নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়ের থেকে আশা ছিল অনেক বেশী। আওন চরিত্রে ঋষভ বসু বরং একটা ফ্রেশ এয়ার নিয়ে আশার চেষ্টা করেন। বাকি চরিত্ররা যথাযথ অভিনয় করেন কিন্তু নাট্যকার যেন সব চরিত্রের প্রতি সমান ভাবে মনোনিবেশ করেননি। এই নাটকে বহুদিন পরে ভীষণ যথোপযুক্ত মিউজিকের ব্যবহার দেখতে পাওয়া গেল। পরিমিত কিন্তু প্রয়োজনীয়। এই সূক্ষ্ম কাজটি করেছেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার এক্সিকিউশনটা সামলেছেন অনিন্দ্য নন্দী। রিভিউ এর দৈর্ঘ্য আর বাড়ানো সম্ভব নয়, তাই ক্লাব করে বলতে হচ্ছে- বাকি এলিমেন্ট গুলোর ব্যবহার ঠিকঠাক কিন্তু সবগুলোই আরও ভাল হতে পারত।
নাটকটির মধ্যে একটা আধুনিক এবং দুর্দান্ত নাট্য হয়ে ওঠার সমস্ত উপকরণ থাকা সত্বেও শেষপর্যন্ত তা যেন একটু পরিমিতি বোধ-এর অভাবে মোটা দাগের হয়ে গেল। রিভিউ পড়ে নাটককে বিচার করতে বসবেন না প্লিজ। দেখতে যান এবং জানান আমাদের এই বোঝার সাথে আপনার মত মিলল কিনা। পরিশেষে এইটুকুই বলার যাঁরা শিক্ষক, যাঁরা অভিজ্ঞ তাঁদের কাছে আমাদের এক্সপেকটেশন অনেক বেশী। তাঁদের কাছেই শিখতে চাওয়া এবং সেই শেখা থেকেই ডিপার্ট করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। তাঁরা যেন তাঁদের এই দায়িত্বটুকুর কথা মাথায় রাখেন।
*প্রসঙ্গত, গ্রীকপুরাণের আর এক মিথমেদেয়াকে নিয়েও এই মুহূর্তে বাংলার মঞ্চে একটি উপস্থাপনা চলছে, যার টেক্সটটা ইউরিপিদিসের নাটকের অনুবাদ থেকে বিপুল পরিমাণ এডিট করে তৈরি করা এবং টেক্সট হিসেবে ততটা উপভোগ্য নয়। (মেদেয়া-র কাহন রিভিউ)।
এই রিভিউ ২২শে নভেম্বর ২০১৯এর শো এর ভিত্তিতে করা।