বাংলা থিয়েটারে দৃশ্যত এক রকমের বিভাজন তৈরি হয়েছে। পুরনো লোকেদের নাটক আর নতুন লোকেদের নাটক। এর মধ্যে অবশ্যই পুরনো মানে ব্যাকডেটেড এবং নতুন মানে মডার্ন স্মার্ট এরকম বলতে চাওয়া হয়নি। যারা বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় প্রবীণ তাঁদের তৈরি নাটক আর অভিজ্ঞতায় নবীনদের নাটক। নবীন থিয়েটার লার্নারদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা আজকাল কোন নাটক দেখতে গেলেই এই বিভাজনটা খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারে। এই বিভাজনটা ভালো থিয়েটার বা খারাপ থিয়েটারের নয়, এই বিভাজনটা থিয়েটারের ভাষার, তার প্রকাশের এবং সর্বোপরি তার বক্তব্যের। সত্যিই এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে এই বিভাজনটা দর্শকও বুঝেছেন এবং সেই কারণেই অনেক ক্ষেত্রে নাটকের দর্শকের মধ্যে এক ধরনের বিভাজনও তৈরি হয়েছে। অনেক নাটক দেখতে গেলেই দেখা যায় বেশী সংখ্যক দর্শক কম বয়স্ক। অনেক নাটকে দেখতে পাওয়া যায় যাঁরা এসেছেন বেশীরভাগই ষাটোর্ধ।
Previous Kaahon Theatre Review:
পাইকপারা আখরের নবতম প্রযোজনা রাংতার মুকুট দেখতে গিয়ে এরকমই একটা অভিজ্ঞতা হল। নাটকটির সম্প্রতি অভিনয় হল ১৬ই ডিসেম্বর তপন থিয়েটারে গঙ্গাযমুনা নাট্য উৎসবে। নাটকটি লিখেছেন এবং নির্দেশনা দিয়েছেন অসিত বসু। বাংলা থিয়েটারে অসিত বসু একজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু দর্শকাশনে বেশীরভাগই ষাটোর্ধদের দেখে বেশ অদ্ভুত লাগে। কিছু সংখ্যক দর্শকমাত্র তিরিশের (সম্ভবত চল্লিশেরও) নীচে ছিলেন। নাটকটা দেখতে দেখতেই এই বিভাজনটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় নাটকের প্রয়োগ, ভাষা, ডায়ালগ এবং ডিজাইন দেখে প্রৌঢ়রা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছেন এবং নবীনরা সেই উচ্ছ্বাস দেখে বেশ অস্বস্তি বোধ করছেন। ইনফ্যাক্ট, নাটকের যা বক্তব্য তা নিয়েও দুটি ছেলে মেয়েকে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেল, তাঁদের সাথে কথা বলে জানা গেল এই নাটকের বক্তব্য এবং তার প্রকাশ দুটোকেই তারা প্রাচীনপন্থী বলে মনে করছেন। রিভিউয়ার হিসেবে একটা নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না যে থিয়েটার লার্নার হিসেবে আমাদের বয়সও কম এবং আমরাও উপরোক্ত বক্তব্যের সঙ্গে সহমত।
নাটকটা একটা স্বপ্নের কথা বলে, রাংতার মুকুট পরে রাজা হওয়ার স্বপ্ন। দাবী করে তা একটি আধুনিক রূপকথা। কিন্তু নাটক দেখে এক সময়কাল ছাড়া কোন অর্থেই সেটাকে আধুনিক বলে মনে হয়না। নাটকের ভাষা এবং চরিত্রদের ভাষা বেশ পুরনো। ষাট-সত্তরের দশকের বাংলা সিনেমায় ভাষার ব্যবহারের সঙ্গে তার কিছু মিল আছে। নাটকের প্লট যেভাবে আনফোল্ড হয়, যেভাবে মঞ্চসজ্জা করা হয়েছে তাও বেশ পুরনো। সমাজের অরাজকতার কথা স্পষ্ট ভাবে বোঝানোর জন্য মঞ্চে পাবলো পিকাসোর বিখ্যাত তৈলচিত্র গোয়েরনিকা টানিয়ে রাখা হয়, বেশ কিছু কারেন্ট রাজনৈতিক সমস্যার উপস্থিতি যেমন ক্যাপিটালিজম এবং অলিগার্চির প্রভাবে তৈরি হওয়া সাধারণ মানুষের জীবন ধারনের সমস্যা এবং বাজারি অর্থনীতিতে রাজনৈতিক নেতাদের লাভের জন্য বিকিয়ে যাওয়া এবং তার প্রভাবে তৈরি হওয়া সাধারণ মানুষের ক্ষতি – এসব দেখে বোঝা যায় নাটকটাকে এই সময়ে জোর করে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে। যদিও তার সমাধানের রাস্তা খুঁজতে গিয়ে নাট্যকার নির্দেশক অসিত বসু আবার হয়ে উঠেছেন প্রাচীনপন্থী। কিন্তু মঞ্চে আজকের অরাজকতাটা ঠিক আজকের মত করে প্রকাশিত হয়না। সব সমস্যাকেই খুব লিনিয়ার করে দেখানো হয় এবং তার সলিউশন হিসেবে দেখানো হয় মানুষ যদি সাহস করে স্বপ্ন দেখতে পারে তাহলেই এসব সমস্যা একদিন মিটে যাবে। ( সাহস করে স্বপ্ন দেখে গেলেই একদিন সাম্যবাদ আসবে টাইপের…)
কিন্তু তাতেই কি সব সমস্যা মেটে? মিটেছে কোনদিন? সাহস করে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে নাটকের অন্যতম একটি প্রধান চরিত্র হরিপদ কেরানীর জীবন সংশয় ঘটে, মাথায় তীব্র চোট পেয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন তিনি মহারানা প্রতাপ… তাঁর প্রজাদের জন্য লড়াই করাই তাঁর কর্তব্য, কিন্তু তাঁর এই ভারসাম্যহীনতা তাঁর পরিবারকে কিভাবে বিপাকে ফেলে? কিভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায় তাঁর পরবর্তী জীবন… এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে নির্দেশক নিরুত্তর থাকেন। স্বপ্ন দেখলেই হবে? তার দাম কে দেবে?
নাটকের অভিনয়ের ধরন বেশ পুরনো, খুব একটা সাইকোঅ্যানালিটিকাল বা বায়োমেকানিক্স (যা তুলনায় আধুনিক প্রসেস) এর উপর জোর দিয়ে তৈরি করা নয় তবে সকলেই একই পদ্ধতিতে অভিনয় করেছেন বলে এক ধরনের ব্যালেন্স তৈরি হয়। অভিনেতা হিসেবে তথাগত চৌধুরী, অভিজিৎ সরকার, সুদক্ষিণা চৌধুরী এবং সর্বোপরি অসিত বসু, সকলেই ভালো অভিনয় করেছেন। আলো মোটামুটি সব জায়গায় আলোকিত করার জন্যই খালি ব্যবহার করা হয়েছে, কেবলমাত্র একটা জায়গায় অ্যাক্টর্স রাইট থেকে অ্যাক্টর্স লেফটে ডায়াগোনাল একটি আলোর ব্যবহার (সম্ভবত পিসি) বেশ ভালো লাগে। মুরারি রায়চৌধুরীর মিউজিক ডিজাইন পরিমিত এবং ডি এল রায়ের রানা প্রতাপ সিংহ নাটকের গান “ধাও ধাও সমর ক্ষেত্রে”র ব্যবহার এখনও কানে লেগে আছে।
কিন্তু শেষ অবধি বলতেই হয়, বাংলা থিয়েটারের নতুন প্রজন্মের (লার্নার এবং দর্শক উভয়েরই) ভিজুয়াল এবং কালচারাল এক্সপিরিয়েন্স এখন আর শুধু বাংলা বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। মাথায় রাখতে হবে তারা ব্ল্যাক মীরর, হাউস অফ কার্ডস্’এর মত সিরিজ, দ্য লাইভস অফ আদার্স বা দ্য ফেভারিটের মত সিনেমা দেখে ফেলেছে। তারা কমপ্লেক্সিটির কথা জানে, তারা জানে ভায়লেন্সের কথা। তারা বুঝতে শিখেছে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে কোন ইকুয়েশনই আর লিনিয়ার নয়, কোন অরাজকতাই আর আগের মত নেই, কোন সমস্যার সমাধানই এক লাইনে বলা যায় না। তবে আগেও যেত কি? পুরনোর মধ্যে খারাপ কিছু নেই, কিন্তু নতুনের সাথে সাথে নিজেকে ইভল্ভ করতে না পারলে তা হয়ে যাবে ব্যাকডেটেড। অথচ পুরনোই একমাত্র আমাদের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত করার ক্ষমতা রাখে। তাই যারা বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় অনেক প্রবীণ, তাঁদের হয়ত আর একটু বেশী দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ।