গত ২৫শে অক্টোবর পদাতিক লিটল থিয়েটারে অভিনীত হল ‘যাদবপুর মন্থন’ গোষ্ঠীর বাংলা নাটক ‘মোকাম্মেল এর অমিতাভ’। সাদিক হোসেনের ছোটগল্প অবলম্বনে নাটকটি তৈরি, নির্দেশনায় রাজীব বর্ধন। নাটকটির সময়সীমা আনুমানিক চল্লিশ মিনিট। তবে এই রিভিউ ৩১শে জুলাই সন্ধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহের অভিনয়ের নিরিখে লিখিত।
কাহিনীর সময়কাল মোটামুটিভাবে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক! প্রধান চরিত্র ‘মোকাম্মেল’ একজন নিম্নবিত্ত বাঙালি যুবক, আর তার ‘অমিতাভ’ হলেন- অবশ্যই বলিউড সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন! মোকাম্মেল অমিতাভের একজন গুণগ্রাহী, পর্দায় অমিতাভের নায়কোচিত কাণ্ডকারখানা তাকে স্বপ্ন দেখায়, তবে বাস্তব জীবনে সে একজন পরাজিত মানুষ! কাহিনীর ছকটা ভীষণ পরিচিত, কাছাকাছি গল্প নিয়ে অনেক নাটক বা সিনেমা হয়েছে। তবে নাটকটা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে অন্তত দুটো বিষয় অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, সাম্প্রতিক বাংলা নাটকে সমকাল, বা বিশেষ করে সমকালীন রাজনীতিকে এড়িয়ে যাবার একটা প্রবণতা আছে, এই নাটকটি সেইদিক থেকে ব্যতিক্রম। যদিও নাটকটি কোনও বিশেষ দলীয় রাজনীতির পক্ষে কথা বলে না, নাটকে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাগুলো আসে কাহিনীর অনুষঙ্গ হিসেবে; তবুও এটা বলতে পারা যায় যে, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম সরাসরি উল্লেখ করার ক্ষেত্রে এঁরা কোনওরকম আড়ষ্টতা দেখাননি!
Previous Kaahon Theatre Review:
যে প্রধান কারণে এই নাটকটা নিয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ তা’হল এই নাটকের প্রয়োগ কৌশল! সাদিকের গল্পটি উত্তমপুরুষে রচিত। তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহের মধ্যে অভিনয়ের স্পেসটার একদিকে টেবিল চেয়ারে বসে একজন লেখক বা সূত্রধার জাতীয় ব্যক্তি (যিনি নিজেকে বলেন ‘সূত্রধর’) গল্পটি পাঠ করতে থাকেন, অবশ্যই এক্সপ্রেশন দিয়ে দিয়ে; আর স্পেসের বাকি অংশে সেই গল্পেরই অভিনয় চলতে থাকে। গল্পের মধ্যে যেখানে সংলাপ আছে, সেখানে সূত্রধার থেমে যান, সংলাপ উচ্চারণ করেন আসল চরিত্রটি! সূত্রধার নিজেও যেহেতু গল্পের একটা চরিত্র (মোকাম্মেল এর বন্ধু), তাই তিনি মাঝে মাঝে নাটকের মধ্যে ঢুকে এসে নিজের চরিত্রে অভিনয় করেন, আবার তার মধ্যেই সূত্রধার হিসেবে ধারা বিবরণী চালিয়ে যান। পুরো নাটকটি এভাবেই অভিনীত হয়। নাটকের শেষে পরিচালক স্বয়ং এসে জানিয়ে যান যে মূলগল্পের প্রতিটি অক্ষর, মায় দাঁড়ি, কমা, সমস্ত কিছুই অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে, লেখকের অনুমতিক্রমে তারা দুটো বাক্যাংশ যোগ করেছেন মাত্র! অতএব, এহেন প্রয়োগকৌশল ব্যবহারের সিদ্ধান্তটা সচেতনভাবেই নেওয়া! অবশ্যই, নাট্য নির্মাণের দিকে থেকে এ এক অদ্ভুত প্রয়োগ কৌশল!! এই সিদ্ধান্তের পেছনে নির্মাতাদের আসল উদ্দেশ্য ঠিক কী ছিল সেটা পরিষ্কার নয়, তবে এটা হতে পারে যে নির্মাতারা হয়ত আসলে দর্শকদের একটা ‘গল্পপাঠের অনুভূতি’ দিতে চেয়েছেন! সাধারণত, পাঠক যখন একটা গল্প পড়েন, তখন তিনি মনের মধ্যে গল্পের একটা ভিস্যুয়াল রূপ দেখতে পান, এই নাটক দেখতে এলে তাকে আর গল্পটা কষ্ট করে পড়তে হবে না, সঙ্গে ভিস্যুয়ালটাও তিনি রেডিমেড পেয়ে যাবেন। এই কাহিনীর একটা কনভেনশনাল নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করতে গেলে সেটা অন্তত দু’ঘন্টায় গিয়ে দাঁড়াবে, এখানে পুরোটাই চল্লিশ মিনিটে শেষ! আপনি যদি ক্রীড়া অনুরাগী হন তা হলে আপনি হয়ত এরকম একটা অ্যানালজি দাঁড় করাতে পারেন- কনভেনশনাল নাটক যদি হয় পাঁচদিনের ধ্রুপদী টেস্ট ক্রিকেট, যেখানে খেলোয়াড়কে তার এবিলিটির চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হয়, তাহলে এই স্টাইলের নাটক যেন টি-টোয়েন্টি ম্যাচ, অবিশ্বাস্য দ্রুততা আর আনুষঙ্গিক বিনোদনের ডালি নিয়ে একটা প্যাকেজ! আজকের দ্রুতগতির যুগে যেখানে ধ্রুপদী সাহিত্য বা ধ্রুপদী নাট্যচর্চার লাক্সারি বহন করার সুযোগ ক্রমশ কমে আসছে, সেখানে এই ধরনের একটা ফর্ম্যাট হয়ত, নির্মাতা এবং দর্শক, উভয়েরই আনুকূল্য পেয়ে যেতে পারে!
কিন্তু এই ধরনের ফর্ম্যাটের কিছু অপূর্ণতা আছে যেগুলো হয়ত এড়িয়ে যাওয়া যায় না! একজন সাহিত্যিক গল্প লেখার সময় মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক কিছুই লেখেন যা তাঁর লেখার উৎকর্ষের কারণে, কোনরকম হোঁচট ছাড়াই, তরতর করে পড়ে যাওয়া যায়; কিন্তু সেটাই নাটকে বা সিনেমায় ভিস্যুয়ালি ‘অ্যাস ইট ইস’ প্রকাশ করতে গেলে অনেক সময় অস্বাভাবিক লাগে! তখন নাট্যভাষা বা চলচ্চিত্র ভাষায় সেই বিশেষ অনুভূতি বা ঘটনাকে কিছুটা পরিবর্তন করে প্রকাশ করতে হয়। এছাড়াও সাহিত্যে ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ অনেক কিছু বলা থাকে, যেগুলো পাঠক পড়ার সময় নিজের মতো করে, সময় নিয়ে নিয়ে, অনুধাবন করতে পারেন। নাট্যরূপ বা চলচ্চিত্ররূপে এই না-বলা কথাগুলোর করেস্পন্ডিং ভিস্যুয়াল না থাকলে, বা ‘করেস্পন্ডিং বিটুইন দ্য লাইনস’ না থাকলে, কার্যকারণ সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়! মঞ্চে একটা লিখিত গল্পকে গড়গড় করে পাঠ করে গেলে, আর লিখিত টেক্সট থেকে একটুও বিচ্যুত হব না, এরকম একটা রিলিজিয়াস স্টান্স নিয়ে রাখলে, এরকম নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে! এই নাটকেই যেমন- পাড়ায় কারোর ডাকনাম ঘটনাচক্রে অমিতাভ বচ্চন হয়ে গেলে সেটা তো তার কাছে গৌরবজনক হওয়ার কথা, কি করে সেটা টিটকিরি হয়ে যেতে পারে তা’ বোধগম্য হয়না! আশিস নন্দীর কাছে গিয়ে মোকাম্মেল যা বলে তাও আপাতদৃষ্টিতে বাহবাযোগ্য, অথচ তাকে অপমানিত হতে হয়! মোকাম্মেল তার বাবাকে একটা অশ্লীল কথা বলে, গফুর তা’ সারা পাড়া রাষ্ট্র করে দেয়; অথচ তার আগেই মোকাম্মেল এর বলা সংলাপে মনে হয় যেন তার বাবা, পাড়াতে আগে থাকতে ঐ শব্দটি দিয়েই পরিচিত! এই ধরণের বেশ কিছু ‘ব্যাখ্যার অভাব’ নাটকে থেকেই গেছে! একটা কনভেনশনাল নাট্যরূপ এই বিভ্রান্তিগুলো সহজেই দূর করতে পারত।
এই নাটকের আরেকটি বিশেষত্ব হল এটি ইন্টিমেট বা অন্তরঙ্গ থিয়েটার হিসেবে পরিবেশিত, যদিও নাটকের কাহিনী, বক্তব্য, বা প্রয়োগকৌশল, কোনটিই এমন নয় যা কিনা কেবলমাত্র অন্তরঙ্গ স্পেসের জন্যই বিশেষভাবে উপযোগী। তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে লম্বালম্বিভাবে প্রায় অর্ধেক জায়গা জুড়ে এই নাটকের বিস্তৃতি, বাকি অর্ধেক বরাদ্দ ছিল দর্শকদের জন্য! চেয়ার টেবিল, চৌকি, কাঠের ফ্রেম, অন্যান্য আসবাবপত্র, দড়িতে টাঙানো জামাকাপড়- সব সুদ্ধু নিয়ে আয়োজন কিন্তু প্রসেনিয়ামের থেকে খুব আলাদা কিছু নয়! তার ওপর রয়েছে অমিতাভ বচ্চনের বিভিন্ন সিনেমার প্রোজেকশন, ফাঁকা দেওয়ালের অভাবে যেটা মেলে রাখা কাপড় জামার ওপরেই ফেলতে হয়েছে! দেখে শুনে মনে হয়, নাটকটি এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে করে প্রসেনিয়াম আর ইন্টিমেট, দুই ধরণের স্পেসেই, যেমন প্রয়োজন তেমনভাবে মানিয়ে নিয়ে অভিনয় করা সম্ভব! তবুও ইন্টিমেট স্পেসে কিছুটা জোর করেই ফিট করানো হয়েছে বলে মনে হয় – নাট্যগৃহে লম্বালম্বিভাবে অভিনয় করায়, সম্পূর্ণ স্পেসটা দর্শকের দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকে না, তাই দুইপ্রান্তে যখন একইসঙ্গে অভিনয় চলতে থাকে, তখন বারেবারে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে হয়! অভিনয়ে অবশ্য সকলেই যথেষ্ট সাবলীল, মোকাম্মেল ছাড়া বাকি সকলেই একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেন।
তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে সেদিন এই নাটক উপভোগ করতে প্রচুর দর্শক হাজির ছিলেন, যাদের একটা বড় অংশই যুব, এবং কোনও না কোনও নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত। প্রায় সকলেই এই নাটককে প্রবল উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মানুষের সময় কমে আসছে, তার সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দর্শক রুচিও। এই প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি সেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের অ্যানালজিতে। ক্লাসিক্যাল টেস্টম্যাচের একনিষ্ঠ দর্শক টি-টোয়েন্টি প্রসঙ্গে নাক সিঁটকোতে পারেন, কিন্তু এটা হয়ত তিনিও মানবেন যে টি-টোয়েন্টিতেও একজন লোক বল করেন, আর আরেকজন ব্যাট- আর অন্তত ঠিক সেটুকু সময়ের জন্য হলেও সেটা ক্রিকেটই, অন্য কিছু নয়! ‘মোকাম্মেল এর অমিতাভ’ নাটকটিও যেন সেরকম, অভিনয় যেটুকু হচ্ছে সেটুকু অবশ্যই ক্লাসিকাল, কিন্তু দ্রুত শেষ করার তাগিদে নাট্যরূপান্তর এড়িয়ে গিয়ে ‘ভয়েসওভার’ রাখা হয়েছে, কাহিনী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে একটা বেশ ফ্যামিলিয়ার ট্রোপ, আর সেটা পরিবেশন করা হয়েছে নিরাপদ রাজনীতি আর পপুলার কালচারের চাটনি সহযোগে। বেশ একটা নতুন ফর্ম্যাট, আর দর্শক উপভোগ্যও বটে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এই ফর্ম্যাটে আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে, আর উন্নত-নাসা সমালোচকরাও একে একটা শিল্পসম্মত ফর্ম্যাট বলে ভাবতে বাধ্য হবেন- আপাতত কিছুটা ভ্রুকুঞ্চন থেকেই যাচ্ছে!