গ্রীক পুরাণের বিখ্যাত নারী চরিত্র কলচিস দেশের রাজকন্যা মেদেয়া।
বিখ্যাত নারী চরিত্র কলচিস দেশের রাজকন্যা মেদেয়া।
কলচিস দেশের রাজকন্যা মেদেয়া।
কন্যা মেদেয়া।
মেদেয়া।
এতগুলো বিশেষণে ভূষিত হওয়ার জন্য বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে মেদেয়া’কে। তবে গ্রীক পুরাণের নারী চরিত্র হিসেবে চলা শুরু করে শেষ পর্যন্ত নিজের নামেই (বদনামেই?) নিজের পরিচয় হয়ে উঠতে পারে মেদেয়া। যদিও মেদেয়া-মিথ বিভিন্ন সময়ের সামাজিক মরালিটি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তাও মেদেয়া সর্বত্রই নিজ গুণে টিকে গেছে নিজের ঔদ্ধত্ব আর দুর্ভাগ্য জাহির করতে করতে। তাই মেদেয়ার মত একটা টেক্সট নিয়ে কাজ করা একই সঙ্গে বেশ প্রাসঙ্গিক আর বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রাসঙ্গিক কারণ মেয়েদের নিয়ে ঘটে চলা রাজনীতি বহুবছর আগে থেকে সেই যে শুরু হয়েছিল, তাকে শেষ করা যায়নি আজও। ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এই রাজনীতি এত কমপ্লেক্স আর মাল্টি-লেয়ার্ড যে সেটা দু-তিন ঘণ্টা সময়ের বাঁধনে ফুটিয়ে তোলা বেশ দুরূহ। সবসময়ই কোন একটা লেয়ারের প্রাধান্য পেয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে, তার থেকে তৈরি হয় একটা নির্দিষ্ট ইন্টারপ্রিটেশন, আর তারপরই মেদেয়া তার দেশকাল সীমানা ছাপানো প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে হয়ে যায় শুধুমাত্র সেই সময়টির বন্দী, তাকে দাগিয়ে দেওয়া হয় কোন একটি নির্দিষ্ট রঙে। মেদেয়ার মত চরিত্রদের বন্দী করে ফেলার এই প্রবণতা সমাজের বহুকালের।
এইরকমই এক একবিংশ শতাব্দী বন্দী মেদেয়ার মঞ্চায়ন হল রঙ্গপটের প্রযোজনায়, তপনজ্যোতি দাসের নির্দেশনায় “মেদেয়া” নাটকে। ইউরিপিদিসের মূল নাটক “মেদেয়া” থেকে রতন কুমার দাস এই টেক্সটটির রূপান্তর করেছেন। সম্ভবত নাটকটিকে দীর্ঘায়িত না করতে চেয়েই বিপুল পরিমাণ এডিট করা হয়েছে এবং সেই কারণে নাটকের জার্নি মাঝে মাঝেই ধাক্কা খেয়েছে। ইউরিপিদিসের মেদেয়ায় মেদেয়া’কে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গিয়েছিল যা তাকে নিষ্ঠুর নারীচরিত্রদের আলোচনায় লেডি ম্যাকবেথ এর আশেপাশেই জায়গা করে দিয়েছে। নিজের ভাইকে হত্যা করা, নিজের জাতিকে বিট্রে করা এবং সমাজ সংসারের চোখে যা অভাবনীয় এবং অমার্জনীয়, সেই সন্তান হত্যার মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মেদেয়া। অগত্যা সমাজ তাকে দাগিয়ে দিয়েছিল “সন্তানহত্যাকারী নিষ্ঠুর মেদেয়া রূপে।” তারপরে কখনও জাদুকরী মেদেয়া, কখনও ফেমিনিস্ট মেদেয়া, কখনও উদ্বাস্তু মেদেয়া, কখনও পরিচয়হীন মেদেয়া… এইসব বিভিন্ন খেতাব জুটে গেছে তার। সর্বদাই মেদেয়াকে সামনে রেখে সমাজের রূপখানি ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তাই মেদেয়ার আর “মেদেয়া-মেদেয়া” হয়ে ওঠা হয়নি।
Previous Kaahon Theatre Review:
২০১৯ সালে ভারতবর্ষে এবং সারা পৃথিবীতে ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনার কনটেক্সটে মেদেয়ার উদ্বাস্তু, পরিচয়হীন রূপটি প্রাসঙ্গিক – একথা অনস্বীকার্য। (মেদেয়া মিথটা পড়ে না থাকলে একবার পড়ুন)। কিন্তু মেদেয়াকে এই একটা মাত্র রঙে রাঙিয়ে দেওয়া মোটেই তার প্রতি জাস্টিস করা নয় এবং এই সময়ে দাঁড়িয়ে জনগণ আর রাষ্ট্রের জটিল সম্পর্ককেও সঠিকভাবে তুলে ধরা হয় না। এখন কিন্তু একজন মেদেয়াকে দেশছাড়া করতে বিপুল পরিমাণ নাগরিককে আনকনশাসলি ম্যানিপুলেট করে সমর্থন তৈরি করার দরকার পড়ে। একজন মেদেয়াও ক্ষমতা থাকলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্যরকমভাবে প্রতিশোধ নেন।
এই কথাটা ভুলে যাওয়া ঠিক নয় যে সমস্ত কিছু ছাপিয়ে মেদেয়া কিন্তু ছিলেন একজন আধুনিক তথা উত্তর-আধুনিক মানসিকতার মানুষ যা তার নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা এবং ইন্ডিভিজুয়াল অটোনিমি সম্পর্কে সচেতন থাকার মধ্যে ভীষণভাবে প্রকাশিত হয়। এইসময়ে দাঁড়িয়ে তার চরিত্রের এইদিকটি উঠে আসা ভীষণ দরকার ছিল। তার বদলে এই নাটকে তিনি হয়ে গেলেন শুধুমাত্র দুর্ভাগ্যের কাছে পরাজিত, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসহায়, বদলা নিতে চাওয়া রাজনৈতিক একটি প্লয়, যার কখনই কোন নিজস্ব পরিচয় নেই। এতটা সরল নয় মেদেয়ার সমীকরণ। সুযোগ ছিল নাট্যকারের… সুযোগ ছিল…
আগেই বলেছি অপর্যাপ্ত এডিটিং এর কারণে নাটকের গতি বেশ ধাক্কা খেয়েছে মাঝে মধ্যেই, বিশেষত শুরুর দিকে জেসনের (জেসন কে? উফফ… বলছি তো মেদেয়া মিথটা পড়ে নিতে) সাথে মেদেয়ার পরিচয় এবং প্রেমের দৃশ্যগুলি একেবারেই বিল্ড-আপ হওয়ার সময় পায়না। ওই সিনের ডায়লগগুলি মূলত ইনফরমেশন দেওয়ার জন্যই রাখা হয়েছে, নাটকে তা বিশেষ কিছু যোগ করতে পারে না। সৌমিক-পিয়ালির মঞ্চনির্মাণ বরাবরই একের মধ্যে বহুর আভাস দেয়, এই নাটকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত কোরাসের ব্যবহার মাঝে মধ্যেই মঞ্চ এবং মঞ্চ সংলগ্ন জায়গাগুলোকে ভিড়াকীর্ণ করেছে, যদিও গ্রীক নাটকে কোরাসের উপস্থিতি প্রায় বাধ্যতামূলক। দ্রোণ আচার্যের আবহ এবং সুদীপ সান্যালের আলো নাটকে বেশ কিছু বিশিষ্ট মুহূর্ত তৈরি করতে পেরেছে (যদিও এই দুই প্রতিষ্ঠিতর কাছ থেকে আমাদের এক্সপেকটেশন অনেক অনেক বেশী)।
এরসঙ্গে অবশ্যই মেনশন করতে হবে ধ্বনি-প্রক্ষেপক অনিন্দ্য নন্দী এবং আলোক প্রক্ষেপক (বিভিন্ন শো’তে বিভিন্ন) এরকথা। কারণ এঁদের পরিমিতি বোধই প্রত্যেকটি শো’এর আবহ এবং আলোক সঞ্চালনাকে যথাযথ করে তুলছে। পোশাক এবং অঙ্গবিন্যাস করেছেন নিলয় সেনগুপ্ত এবং মূকাভিনয় ডিজাইন করেছেন শুভেন্দু মুখোপাধ্যায়। এই নাটকে কোরাস (মনতোষ মুখার্জি, অর্ঘ্য রায়, মন্দিরা চক্রবর্তী, সুনয়না ভৌমিক, পান্না মণ্ডল, স্বাগতা দাস, মৃত্তিকা নস্কর, সুশ্যামল সাঁপুই, শক্তিদেও অন্যেরা) বেশ সংঘবদ্ধ ভাবে কাজ করেছে, কিন্তু আরও অনেক অনুশীলনে হয়ত তাঁরা একক চরিত্র হয়ে উঠতে পারবেন।
মেদেয়া চরিত্রে সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়, জেসন, ক্রেয়ন এবং ইজিয়াস চরিত্রে সুমন সাহা এবং মেদেয়ার সঙ্গিনী অ্যাটেন্ডেন্টের ভূমিকায় সুকৃতি লহরী বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। এঁরা সকলেই দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নাটকে দারুণ অভিনয় করে আসছেন তা আপনাদের সকলেরই জানা। এই নাটকে তাঁদের চরিত্রগুলোতে আরও বেশ কিছু শেড জুড়তে পারলে হয়ত এঁদের অভিনয় প্রতিভার প্রতি আরও অনেকটা জাস্টিস করা হত। দর্শকের কাছেও তা হয়ে উঠতে পারত একটি “এক্সপেরিয়েন্স” ।
শেষ পর্যন্ত যে কথা বারবার বলি সেকথা বারবার বলা। রিভিউ পড়ে নাটক দেখার সিদ্ধান্ত নেবেন না। আগে নাটক দেখতে যান এবং তারপরে আমাদের জানান আমাদের রিভিউয়ের এর সাথে আপনার মত মিলল কিনা। থিয়েটারকে ভালবাসলে থিয়েটার নিয়ে চর্চা এবং আলোচনার মধ্যে থাকুন। থিয়েটার দেখুন, থিয়েটার দেখান। সর্বোপরি থিয়েটারের সঙ্গে থাকুন, কাহনের সঙ্গে থাকুন।
পুনশ্চ ১ – একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেদেয়া এবং জেসনের সন্তানদের মাতৃপরিচয় কেন বড় হয়ে উঠল সেটা আর একটু এক্সপ্লোর করা যেত।
পুনশ্চ ২ – নাটকের পরে নাটকটা কি নিয়ে সেটা মঞ্চ থেকে না বলে না দিলে দর্শক হিসেবে নিজেকে আর “ঈকটু” গুরুত্বপূর্ণ এবং সহমর্মী মনে হত।