ভালো লোক – আবার পিরানদেল্লো; নাট্যপ্রয়োগ প্রাচীনপন্থী

Posted by Kaahon Desk On January 24, 2020

বাংলা নাট্যজগতে সায়ক নাট্যগোষ্ঠী একটি জনপ্রিয় নাম। নির্দেশক মেঘনাদ ভট্টাচার্য ও  নাট্যকার চন্দন সেনের জুটি ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। এই যুগল বন্দীর নতুন সৃজন, সায়ক নাট্য গোষ্ঠীর নবতম প্রযোজনা- ‘ভালো লোক’। লুইজি পিরানদেল্লো অনুপ্রাণিত এই নাটকের অভিনয় হল গত ১৯শে জানুয়ারি ২০২০ তারিখে নিরঞ্জন সদন মঞ্চে। এই রিভিউ নাটকের ২০তম অভিনয় (২রা জানুয়ারি২০২০, মধুসূদন মঞ্চ) দেখে করা হয়েছে।

এই নাটকের পটভূমি ভাগীরথী নদীর কূলে অবস্থিত এক আধা মফস্বল এলাকা – মাঝেরচর। সেখানে সত্যচরণ ও ধুর্জটিনারায়ণ বাল্যবন্ধু, একই আদর্শবাদী রাজনৈতিক নেতার শিষ্য। পরবর্তীকালে ধূর্জটিনারায়ণ রাজনীতির আঙ্গিনায় সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছোয় এবং শহরে বসবাস শুরু করে। সত্যচরণ থেকে যায় মাঝেরচরে, আর সমাজসেবার কাজে নিজেকে নিয়োগ করে। সত্যচরণের সৎ, সজ্জন, পরপোকারী, সহানুভূতিশীল মনোভাবের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন সকলের আপনজন – ‘ভালো লোক’। দিনেদিনে বাল্যবন্ধু দুই রাজনৈতিক সতীর্থের মতাদর্শের ফারাকটা প্রকট হয়ে ওঠে। এই ভালো লোকের আপাত উজ্জ্বলজীবনের উল্টোপ্রান্তে একটা ছায়াবৃত দিকও আছে। ধূর্জটিনারায়ণের পরিকল্পনা মতো সেইদিকটা ক্রমশ প্রকাশিত হতে থাকে। সম্পর্কের টানাপোড়েন ও জটিলতার মধ্যে থেকে যে সত্য উন্মোচিত হয় তাতে যেন এক দুর্যোগ শুরু হয় সত্যচরণের ‘ভালো লোক’ সত্তার শক্ত ভিতে। সে উপলব্ধি করে আসলে সবসম্পর্কই শুধু মানুষের কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। বিদ্রোহ করে সত্যচরণের ‘বোধ’। এ বিদ্রোহ কি শুধু এতদিনের পরিচিত মুখোশে মোড়া হঠাৎ করে অপরিচিত হয়ে ওঠা মুখগুলোর প্রতি, নাকি নিজের ভেতরের নিরীহ, সরল, দুর্বল, আর গুটিয়ে থাকা মানুষটার বিরুদ্ধে?

Previous Kaahon Theatre Review:

ইউরোপের নাট্য ইতিহাসে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্রষ্টা লুইজি পিরানদেল্লো (১৮৬৭-১৯৩৬)। ‘Tutto per bane’ নামে তিনি একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ১৯০৬ সালে, এবং ১৯২০ সালে সেই উপন্যাসটিকে নাট্যরূপও দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই নাট্যরূপটির ইংরেজি অনুবাদ করেন হেনরী রীড, নাম দেন ‘All for the best’. এই ‘All for the best’ এর অনুপ্রেরণাতেই সাম্প্রতিক নাটকটি লেখা। এই রচনাটির মূল ভিত্তি হল আত্মানুসন্ধান। নিজেকে খোঁজার এই চেষ্টায় উঠে আসে এমন কিছু বিভ্রান্তি যাকে সত্য বলেই বিশ্বাস করা হয়। এমনই এক আপেক্ষিক সত্যের খোঁজ করে এই নাটক। নাট্যকার চন্দন সেন এই নাটকের মূল স্পিরিটটিতে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাংলা নাটক রচনা করেছেন, যা ভাষাগত ও বিষয়গতভাবে বাঙালি জীবন থেকে উঠে এসেছে। তবে নাটকটিতে পরিমিতি বোধ সব জায়গায় রক্ষিত হয়নি। যেমন তিনি বর্তমান ভারতীয় সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসাবে রাজনীতির সাথে শিল্পপতিদের ঘনিষ্ঠতা বা বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক বৃত্তে বিচরণকে একটি দৃশ্যের মাধ্যমে কিছুটা ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু এই দৃশ্যটির সঙ্গে মূলনাটকের কোন যোগসূত্র নেই, নাটককে এগিয়ে যেতে কোনরকম সহায়তা করে না, বরং বেশ আরোপিত মনে হয়। এই নাট্যকার-নির্দেশক জুটির নয়ের দশকের জনপ্রিয় নাটক ‘দায়বদ্ধ’-র সঙ্গে এই নাটকের আখ্যানগত এবং প্রয়োগগত বেশ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখযোগ্য যে ‘দায়বদ্ধ’ নাটকটি সায়ক নাট্যদলের সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রযোজনা।

নির্দেশক সহজ ও সরল রৈখিকভাবে নাট্যরূপকে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন, মানবিক সম্পর্কের জটিল, সংকটপূর্ণ অবস্থার অনুভূতিটুকু বজায় রেখেছেন, যা এ নাটকের মূলভিত্তি। কয়েকটি দৃশ্যান্তরের দীর্ঘসূত্রতা নাট্যগতিকে ব্যাহত করে। সত্যচরণ চরিত্রটি মেঘনাদ ভট্টাচার্যর টিপ্যিকাল হাঁটাচলা আর অভিব্যক্তির আরো একটি প্রকাশ, যদিও সেটি চরিত্রের সাথে মোটামুটি মানিয়ে যায়। তবে সংলাপ শুরু থেকেই কিছুটা উচ্চকিত হওয়ায় চরিত্রের বহুমাত্রিক স্তরগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। নাটকটি যে আবেগের স্তর থেকে গড়ে ওঠে তাতে মেলোড্রামার প্রভূত সুযোগ থেকে যায়, সেই ছোঁয়া থেকে নাটকটিকে বাঁচাবার একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা গেলেও,নাটকের মাঝামাঝি থেকে মেঘনাদের অভিনয়ে মেলোড্রামার প্রকাশ ঘটে এবং তা নাটকের শেষপর্যন্ত বজায় থাকে। সামান্য উচ্চকিত স্বরে সংলাপ বলবার প্রবণতা বাকি অভিনেতাদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। ব্যতিক্রম হিসেবে কল্পা চরিত্রে কথাকলি আর প্রভা চরিত্রে রুণা মুখার্জির নাম উল্লেখ করা যায়। কথাকলি তার স্বাভাবিক ও সাবলীল অভিনয় দিয়ে কল্পাচরিত্রের শান্ত আথচ দৃঢ়, বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটি বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। রুণা মুখার্জি অল্প উপস্থিতিতেও প্রভা চরিত্রটিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। এ দু’জনের অভিনয় ধারার পাশে বাকিদের অভিনয় ধারা কিছুটা প্রাচীনপন্থীই মনে হয়েছে।

Atho Hirimba Kotha– A timely, good, honest and entertaining theatreমঞ্চ সজ্জায় (সৌমিক-পিয়ালী) সাধারণ আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো বসবার ঘর আমাদের খুবই পরিচিত। পশ্চাৎপটে নৌকার পালের আদল যেমন নদীর চরের আভাস দেয় তেমনই তার ধূসর রঙ ও গঠন জটিল মনস্তত্ত্বের প্রতীক হিসেবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সহজ সরল আলোক পরিকল্পনা নাটকের বিভিন্ন মুডকে প্রকাশ করতে বিশেষ সহযোগিতা করে। আলোর সঠিক ব্যবহারে কয়েকটি মনে রাখার মতো নাট্যমুহূর্ত তৈরি হয়েছে। অবশ্য আলোক প্রক্ষেপণের দু’একটি ত্রুটি ও চোখে পড়েছে। সঙ্গীত (গৌতম ঘোষ) সঠিকভাবে নাটকের চাহিদা পূরণ করছে। নাটকের শেষদৃশ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুচিন্তিত প্রয়োগ দর্শকদের মনে যে বিশেষ অনুভূতির জন্ম দেয় তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়।

সবমিলিয়ে বলা যায়, এই নাটকে নির্দেশক তার প্রয়োগকৌশলের মাধ্যমে যেভাবে নাট্যটি উপস্থাপন করেছেন তা প্রাচীনপন্থী আর বহু ব্যবহারে জীর্ণ। পিরানদেল্লোর নাটকগুলি বহুদেশে বহুভাষায় অভিনীত হয়েছে। তবুও বাংলার নাট‍্যজগতে পিরানদেল্লো বলতে এখনো যেন ‘Six Characters in Search of an Author’ই বোঝায় (বর্তমানে কলকাতার অন্য একটি দল এই নাটকটি মঞ্চস্থ করছে)। সায়ক যেমন ইতিপূর্বে শেচদ্রিণ, তলস্তয়, ব্রেখট, সামারসেট মম, প্রভৃতিকে কলকাতার মঞ্চে উপস্থিত করেছে, সেই পথ ধরেই এবার নিয়ে এলো পিরানদেল্লোকে তাঁর কম পরিচিত একটি রচনার মাধ্যমে – এটিই এই প্রযোজনা থেকে প্রধান প্রাপ্তি!

Pradip Datta
A post-graduation diploma holder of the Department of Media Studies, University of Calcutta, he has been a theatre activist in Bengal for the last twenty five years. He is a freelance journalist by profession. Besides theatre, his passion includes recitation, audio plays and many more.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us