কয়েক হাজার বছরের সুপ্রাচীন বাংলা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার মধ্যে পালাগান অন্যতম। পালাগান মূলত আখ্যানমূলক এবং এর কাহিনী আঞ্চলিক ঘটনা বা কিংবদন্তীকে ঘিরে গড়ে ওঠে। এরমধ্যে একটিমাত্র গল্পই থাকে, কোনো শাখাগল্প বা বিষয় এর শরীরকে অহেতুক স্ফীত করে না। একটি গল্প থাকে বলেই দর্শক-শ্রোতার অন্যদিকে মন দেবার সুযোগ থাকে না, ফলে কাহিনীটি দ্রুতবেগে পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। পালাগান সম্পর্কে এই অবতারণার কারণ হল ‘চাকদহ নাট্যজন’ তাদের ‘ভানু সুন্দরীর পালা’ প্রযোজনাটি এই পালাগানের আঙ্গিকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন। এটি রচনা এবং নির্দেশনা করেছেন বাংলাদেশের তরুণ ও প্রতিভাবান পালাকার, অভিনেতা, ও নির্দেশক সায়িক সিদ্দিকী। উইলিয়াম শেকসপিয়রের ‘রোমিও-জুলিয়েট’ এর ছায়া অবলম্বনে এর আখ্যানটি গড়ে উঠেছে একেবারে দেশজ পটভূমিকায় এবং কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায়। গত ২৬শে অক্টোবর এই নাট্য প্রযোজনাটির গিরিশ মঞ্চে উপস্থাপিত হল যদিও এই রিভিউটি ২২শে সেপ্টেম্বর মিনার্ভা থিয়েটারের অভিনয়ের বিচারে লিখিত।
Previous Kaahon Theatre Review:
সায়িক সিদ্দিকী, বাংলাদেশের এই গুণী শিল্পীর সাংস্কৃতিক প্রতিভার ছটা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে পড়েছে। তার রচিত ও নির্দেশিত বেশ কয়েকটি পালা দেশ ও বিদেশে প্রশংসার সাথে পরিবেশিত হয়েছে এবং আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে। তার রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পালা হল ‘রূপচান সুন্দরীর পালা’, ‘খোয়াব জানের পালা’, ‘জয়তুন বিবির পালা’, ‘ভানু সুন্দরীর পালা’, ‘কইন্যা শশীর পালা’ প্রভৃতি। সায়িক বাংলার ঐতিহ্যবাহী পালাগানকে নতুন করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা করে চলেছেন। এই বঙ্গেও পালাগানের প্রতি নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের আকর্ষণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই আঙ্গিকে নাট্য উপস্থাপনা বাংলা নাট্যমঞ্চে নতুন নয় অতীতে বেশ কিছু নাটক জনপ্রিয়তার সাথে মঞ্চস্থ হয়েছে। এখনও হয়ে চলেছে। যেমন চাকদহ নাট্যজন ছাড়াও বাঁকুড়ার একটি দল সায়িক সিদ্দিকীরই অন্য একটি পালা বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়মিত অভিনয় করে চলেছে। সায়িক সিদ্দিকীর কাজের বিশেষত্ব হল তিনি যেকোনো ঘটনা, লোককাহিনী, গল্প বা কিংবদন্তীকে আধুনিক সময় ও সমাজের সাথে যুক্ত করে পরিবেশন করেন। তার পালাগুলিতে একটি নির্দিষ্ট বার্তা থাকে এবং তা কখনো হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা।
‘আসর জুড়ে রসের ভানু পাল তুলিয়া যায় / আইসো গো মা সরস্বতী আমার বন্দনায়’… এই বন্দনা গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘ভানু সুন্দরীর পালা’। এখানে শেক্সপিয়রের রোমিও- জুলিয়েটকে সম্পূর্ণ লোকজ আঙ্গিকে ভানুমতি ও চন্দ্রকুমার রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। চন্দ্র ও ভানুর প্রেম। উভয় পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদের জন্য বিবাহে বাধা। গোপনে বিবাহ এবং নানা ঘটনার পর শেষে চন্দ্র ও ভানুর আত্মহননের মধ্য দিয়ে বিয়োগান্তক পরিণতিতে পালা শেষ হয়।পালাকারের নাট্যবয়ানের রীতি অনুযায়ী এই নাটকের কুশীলবরা অভিনয় করেছেন। দলের একঝাঁক তরুণ তরুণীর প্রাণবন্ত অভিনয় এ নাটকের সম্পদ। সঙ্গীত ও নৃত্যের সুসমন্বয় এক সুন্দর ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে। গ্রাম্য জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও আধুনিকতার প্রসঙ্গ চমৎকারভাবে হাস্যরসের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগের সময় অভিনেতাদের তাৎক্ষণিক অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই অভিনয় ধারায় দেখা যায় অভিনেতারা চরিত্র নির্মাণ করছেন, চরিত্র পরিবর্তন করছেন, এবং তা বারবার ভাঙচুর করছেন – ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয় লাগে। আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণের ক্ষেত্রে দু’এক জন একটু ভিন্ন হয়ে পড়েন, এ ব্যাপারে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন।এই নাটকের মূল আধার হল গান। গানগুলি একদিকে যেমন নাটকের ঘটনা বর্ণনা করে তেমনই আবার নাট্য চলনেও এক সুন্দর ছন্দ আনে। গান নাট্যের এক প্রধান চরিত্র হয়ে সমগ্র প্রযোজনাটিকে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখে। হারমোনিয়াম,বাঁশি, তবলা, আর ঢোলের ব্যবহারে গানের সুর মূর্ত হয়ে ওঠে এবং নাটকের আবহটিও সমান দক্ষতার সাথে তৈরি হয়, সঙ্গে ভোকাল হারমনি চমৎকার সঙ্গত করে। পালার আসরের আভাস দিতে মঞ্চকে নিরাভরণ রেখে শুধু দুদিকে দুটি রঙিন কাগজের শিকল টানানো হয়েছে। যদিও এই ধরনের নাটকে আলোর ব্যবহার তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় তবুও চমকহীন ভাবে রঙিন আলোর চমৎকার ব্যবহারে নাট্যের কাঙ্খিত পরিবেশ গড়ে ওঠে। অভিনেতাদের সাজ-পোশাকও নাটকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বর্তমান সময়ে নাট্য উপস্থাপনার ঢঙে যখন ক্রমেই জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, নতুন নতুন আঙ্গিকের প্রয়োগ চলছে, প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার ও কোরিওগ্রাফির প্রবল অত্যাচারে নাটক যখন ক্রমেই সার্কাস আর অ্যাক্রোবেটিকসের প্রদর্শনক্ষেত্র হয়ে উঠছে তখন সহজ এবং সরলভাবে চাকদহ নাট্যজনের ‘ভানু সুন্দরীর পালা’ র উপস্থাপনা প্রশংসাযোগ্য ও প্রয়োজনীয়ও বটে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিকে এই নাট্য প্রযোজনা দর্শকদের মধ্যে এক বিশেষ উৎসাহের সঞ্চার করেছে যা বাংলা নাট্যজগতের পক্ষে ভালো দিক।