বাংলা নাট্যমঞ্চের পুরোধা গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১১) একাধারে নট ও নাট্যকার, নাট্য প্রশিক্ষক এবং বাংলা পেশাদারী মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা। এবছর তাঁর জন্মের ১৭৫তম বর্ষ। সেই উপলক্ষ্যে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে ‘চাকদহ নাট্যজন’ গিরিশ ঘোষের ‘বিল্বমঙ্গল ঠাকুর’ নাটকটিকে তাদের নবতম প্রযোজনা হিসেবে দর্শকদের সামনে উপস্থিত করছে ‘বিল্বমঙ্গল কাব্য’ রূপে। নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় মূল নাটকটিকে সম্পাদনা, সংযোজনা ও কিছুটা পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘বিল্বমঙ্গল কাব্য’র মঞ্চরূপটি প্রস্তুত করেছেন, এবং নাটকটির নির্দেশনার দ্বায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। সম্প্রতি ২৮শে জানুয়ারি ২০২০ একাদেমী মঞ্চে অভিনীত হল নাটকটি।
Previous Kaahon Theatre Review:
গিরিশচন্দ্র এ নাটকের বিষয়বস্তু গ্রহণ করেছিলেন নাভাদাসজী রচিত ‘ভক্তমাল’ (দুই শতাধিক বৈষ্ণব ভক্তের সংক্ষিপ্ত জীবনীর সংকলন) গ্রন্থ থেকে। এটি একটি ভক্তিরসের নাটক। তাঁর রচিত অন্যান্য ভক্তিমূলক নাটকগুলির মতোই তিনি এ নাটকের ক্ষেত্রে মূলত গৌড়ীয় বৈষ্ণব আদর্শকেই অবলম্বন করে ভক্ত আর ভগবানের ভাবরূপকে মিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর অন্যান্য ভক্তিমূলক নাটকগুলির থেকে এটি কিছুটা হলেও স্বতন্ত্র কারণ তাঁর বেশিরভাগ ভক্তিমূলক নাটকের নায়ককে তিনি ভগবানের অবতার রূপে দেখিয়েছেন। এখানে বিল্বমঙ্গল রক্তমাংসের মানুষ, ঐকান্তিক ভক্তি ও সাধনার ফলে ভগবান লাভ করছেন। গিরিশ নিজে এ নাটককে ভক্তিরসের নাটক না বলে প্রেম ও বৈরাগ্যের নাটক আখ্যা দিয়েছেন। এ নাটকে প্রেম ও বৈরাগ্যের আপাত-বৈপরীত্য প্রকাশ পেলেও শেষ পর্যন্ত গিরিশচন্দ্রের মানবিক ও আধ্যাত্মিক ভাবমিশ্র প্রেম ও বৈরাগ্যের কথাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এবার আসা যাক বর্তমান প্রযোজনার কথায়। নাট্যকার ও নির্দেশক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় নাট্যকাহিনীকে মোটামুটি এক রেখে শুধুমাত্র পরিণতিটি পরিবর্তন করেছেন। বাস্তব বিমুখ ঈশ্বর অনুগামীভাব থেকে সরে এসে সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপনকে মান্যতা দিয়েছেন, অথচ মূলনাটকে উপস্থিত অলৌকিকতাকে (যেমন বিল্বমঙ্গলের ঈশ্বরদর্শন এবং তার ফলে দৃষ্টি ফিরে পাওয়া) বর্জন করেননি। নাটকের শেষপর্যায়ে এসে এই বাস্তবতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে যে ঈশ্বরপ্রীতির চেয়ে মানবপ্রেম অনেক বড়, অবশ্যই এটি গিরিশ যে বিশ্বাস থেকে নাটকটি রচনা করেছিলেন তার ঠিক বিপ্রতীক। মূলনাটকে দুটি স্পষ্ট ভাগ লক্ষ্য করা যায় যেখানে প্রথমাংশে, শুরু থেকে বিল্বমঙ্গলের চোখবিদ্ধ করা পর্যন্ত, কাহিনী বাস্তবজীবনের পথেই এগোয়, কিন্তু তৎপরবর্তী কাহিনী অলৌকিক যা ভাবলোকে উর্ত্তীন হয়। দুটি অংশের মধ্যে যে অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়, বর্তমান নাট্যকার যদি সেই অসামঞ্জস্য নিবারণ করে নাটকটিকে নতুন রূপ দিতেন, তাহলে এই নাট্য পরিণতি দর্শকদের কাছে আরো বাস্তবোচিত ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠত। তবে মনে রাখা প্রয়োজন বিল্বমঙ্গল ঠাকুর নাটকটি গিরিশচন্দ্র ভক্তিমূলক নাটক হিসাবেই রচনা করেছিলেন এবং এই ধরনের নাটকের একটি নির্দিষ্ট গঠন, চলন, ও পরিণতি থাকে।
মূলনাটকে মৃতদেহকে কাঠের গুঁড়ি ভেবে তা ধরে নদী পার হওয়া এবং সাপকে দড়ি মনে করে প্রাচীর আরোহণ চিন্তামণির প্রতি বিল্বমঙ্গলের তীব্র প্রণয় সুন্দরভাবে সূচিত করেছে। এই দৃশ্যটি সংলাপের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছিল, বর্তমান নাটকে দৃশ্যটি মঞ্চে উপস্থাপন করা হয়েছে। গিরিশ উত্তাল নদীকে কালসর্পের ন্যায় ভয়ঙ্কর রূপে বর্ণনা করেছিলেন। এখানে নদীতে সর্পের উপস্থিতি বিস্ময় জাগায়, তারপর বিল্বমঙ্গল সেই সাপকে মেরে তার সাহায্যে কিভাবে প্রাচীর লঙ্ঘন করেন তা আরো বিস্ময়ের। মূলনাটকে সাপ ধরে প্রাচীরে ওঠার সাপেক্ষে একটি যুক্তি দেওয়া ছিল (প্রচলিত আছে যে সাপ যদি গর্তে মুখ ঢোকায় তবে তার লেজ ধরে টেনে বের করবার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয় না)। এছাড়া যে মৃতদেহকে কাঠ ভেবে নদী পার করা হয় সেটি বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসার পিছনে ও শুধু নাটকীয়তা তৈরি ছাড়া অন্য কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ নাটকে বিল্বমঙ্গলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই সময়ের কিংবদন্তিসম অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। তিনি দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার সাথে নিজস্ব অভিনয়ের মান বজায় রেখে চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করবার চেষ্টা করেছেন। তবুও মাঝে মাঝে তারই পূর্ব অভিনীত কিছু বিশিষ্ট মানুষের চরিত্রে অভিনয়ের ঝলক বিল্বমঙ্গলের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। বহুনাটকের অসংখ্য চরিত্রে তার অভিনয় দেখার ফলে দর্শক মনে এরূপ অনুভূতি সৃষ্টি হয়। বহুমুখী অভিনয় ক্ষমতারও তো একটি সীমা থাকে!
নাটকে পাগলিনী চরিত্রটির গুরুত্ব অসীম। পাগলিনীর মধ্যে দিয়ে গিরিশচন্দ্র নাটকের কেন্দ্রীয় তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন, পরাতত্ত্ববাদকে আধ্যাত্মিক সমন্বয়বাদে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া নায়িকার চরম বিপর্যয়ের সময় তাদের আধ্যাত্মিক পথে মুক্তির উপায়ের পথপ্রর্দশক হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি দর্শকদের মনে আনন্দদানের জন্য সঙ্গীত পরিবেশনের উদ্দেশ্যে চরিত্রটি সৃষ্টি করা। পাগলিনীর চরিত্রের গানগুলি নাট্যধারাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়। বর্তমান নাটকে উক্ত চরিত্রে সঞ্জিতার সুঅভিনয় ও গান চরিত্রটিকে সুন্দরভাবে মেলে ধরে নাটকের মূলভাবটি সঠিকভাবে ব্যক্ত করতে সাহায্য করেছে। তার বাচিক ও শারীরিক অভিনয় উভয়ই বেশ ভালো লাগে। দু’একজন ছাড়া অন্যান্য চরিত্রের অভিনতারা মোটামুটি একটা স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে সাধক চরিত্রে সুমন পাল এবং চিন্তামণির চরিত্রে শৈলী দত্তের অভিনয় আলাদা করে চোখে পড়ে।
মনোজ প্রসাদের আলোক পরিকল্পনায় দৃশ্যগত ও পরিবেশগতভাবে নাটকের মুডটি সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নাটকের সঙ্গীত (শুভদীপ গুহ) বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মূলনাটকের গানগুলির সুর একই রাখা হয়েছে এবং অন্য যে গান ব্যবহার করা হয়েছে তা নাটকের মূল সুরের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। আবহ নাট্যগতিকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। নীল কৌশিকের মঞ্চ কাহিনীর সময়কালকে ধরবার চেষ্টা করেছে। দুটি দৃশ্যপট ও সামান্য কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে সুন্দরভাবে দৃশ্যান্তর করা হয়েছে। সময়কাল ও চরিত্রের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী বাস্তবোচিত করে পোশাক পরিকল্পনা (সুপর্ণা হালদার) করা হয়েছে। তবে বিল্বমঙ্গল গৃহত্যাগ করে যখন বৈরাগী হয়ে পথে পথে ঈশ্বর সাধনায় রত তখন তার পরিধানে চকচকে পরিস্কার পোশাক বিশ্বাসযোগ্য লাগে না।
চাকদহ নাট্যজন বয়সে অত্যন্ত নবীন একটি দল। গিরিশ ঘোঘের ‘বিল্বমঙ্গল ঠাকুর’ নাটককে নতুন ভাবনায় নতুনভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থিত করেছে। প্রযোজনাটি নিয়ে মনে কিছু প্রশ্ন উঠেছে বটে তবুও তাদের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমকে সাধুবাদ জানাই। ভবিষ্যতে আরো ভালো কাজের আশা রইল।