থিসিস নাটক ব্যাপারটা নতুন নয়; অ্যালেকজান্ডার ডুমা(ছোট), হেনরিক ইবসেন, জর্জ বার্নাড শ’র বেশির ভাগ নাটক এই গোত্রের নাটক। থিসিস নাটকের বৈশিষ্ট হলো তা উচ্চেঃস্বরে ও প্রকটিতভাবে স্রষ্টার ভাবাদর্শ সমূহ প্রকাশ করে, মূলত প্রধান চরিত্র যে হয়ে ওঠে নাট্যকারের মুখপাত্র তার সুদীর্ঘ ভাষণ-সদৃশ সংলাপের মাধ্যমে। গত বছরের একটি পূজা বার্ষিকীতে যখন ব্রাত্য বসুরবাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী আমি প্রথম পড়ি, তিনি থিসিস নাটকের মত একটি নাটক লিখেছেন দেখে অবাক হই, শুধু এই কারনেই নয় যে এ ধরনের নাটক আজকাল একবারেই অপ্রচলিত হয়ে গেছে, এ জন্যেও যে এটা বোঝা দায় যে যিনি অশালীন লেখেন ১৯৯৬ সালে এবং রুদ্ধসঙ্গীত লেখেন ২০০৯ সালে তিনি কেন ২০১৬/১৭’তে এসে লিখবেনবাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী ! নাটকের ফর্ম ও টেকনিকের নিরিখে বলতে গেলে, আমাদের কলকাতার মিনি বাস কন্ডাক্টারদের অনবদ্য শব্দবন্ধে, এ তো পেছন দিকে এগিয়ে যাওয়া।
নিভা আর্টস এবং সংসৃতি’র যৌথ প্রয়াসে সওদাগরের নৌকা দর্শককে একটি ভরাট ও তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতা উপহার দিল : https://t.co/yyXRPSWvKD#film pic.twitter.com/XJf8okgcEx
— kaahon (@kaahonwall) March 12, 2017
অন্য আরেকটা ব্যাপার যা আমার অস্বস্তির কারন হয়েছিল তা হলো টেক্সটটি সেই ভয়ঙ্কর ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত মনে হয়েছিল, যার প্রকোপে আজ বহুলাংশে বাংলা সিনেমা ও টেলিভিশন সিরিয়াল ভীষনভাবে ব্যাধিগ্রস্ত – ‘অবৈধ’ যৌনতার মশলা মাখানো সম্পর্কের জট নিয়ে আবিষ্ট থাকা।নেওয়া যাক নম্রতা চরিত্রটিকে। তিনি একজন কর্পোরেট জগতের মহিলাযিনি তার কার্যসিদ্ধির চেষ্টায় তার যৌন আবেদনই ব্যবহার করেন। নম্রতা উপাখ্যান নাটকের মেদ বাড়ায়, একটা অপ্রয়োজনীয় যৌন সুড়সুড়ির অনুষঙ্গ হাজির করে, অনেকটা যেমন সিনেমায় ভ্যাম্প চরিত্র দিয়ে করা হয়। এটা নিছকই সমাপতন নয় যে মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে আলো, মঞ্চ বিন্যাস ও আবহের ব্যবহার এমনভাবে করা হয়েছে যাতে নাট্যটি পায় টেলিভিশন সিরিয়ালের চেহারা ও মেজাজ।
নাটকটি তার কেন্দ্রীয় বিষয় – উদ্যোগপতি ও ব্যবসায়িক উদ্যোগ – নিয়েও যথেষ্ট দ্বিধাবিভক্ত মনে হয়েছিল। (এই বিষয়ে আমি পরে ফিরে আসব) তবুও আমি উৎসাহী ছিলাম নাটকটির মঞ্চ প্রযোজনা দেখতে, কারন এটা হয়ে থাকে যে ছাপার অক্ষরে যে নাটক খুব কার্যকারী মনে হয় না, সময়ে সময়ে সে নাটক লাইভ পারফর্মেন্সের জাদুর ছোঁয়ায় মঞ্চে আশ্চর্যভাবে প্রাণ পায়। কিন্তু, ৫’ই মার্চ মোহিত মৈত্র মঞ্চে এই নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন দেখে আমার আশঙ্কাই সত্যি হলো – ইন্দ্ররঙ্গের উদ্যোগপতি ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তীর প্রয়াস থেকে অন্তত আমি কোন লভ্যাংশ ঘরে তুলতে পারলাম না।
নাটক থিয়েটার হয়ে ওঠে মূলত অভিনয় গুণে; দুর্ভাগ্যবশত, অভিনয় এই নাটককে রক্ষা করতে পারে নি। অভিনয় বিভাগে নাট্যকারের মুখপাত্র চরিত্র, আর্য দত্ত’র ভূমিকায় অবতীর্ণ সুমিত রায়কে সর্বাধিক দ্বায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে। তার অভিনয় দেখে মনে হয়েছে তিনি একটা অসম লড়াই করছেন তার মাপের চেয়ে অনেকটাই বড় একটা ভূমিকায় নিজেকে মানানসই করে তুলতে। চরিত্রটা কি লেখা হয়েছিল অন্য কোন অভিনেতাকে মাথায় রেখে? শুরুতে নিজের উপস্থিতি ও চলন ব্যবহার করে ঋতা দত্ত চক্রবর্তী একজন ব্যবসানিষ্ঠ মহিলা হিসেবে দেবলীনা দত্ত’র চরিত্রটা দিব্যি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু যে দৃশ্যে দেবলীনা জানতে পারে যে তার মেয়ে তার (দেবলীনার) বিশ্বস্ত কর্মচারী ও প্রেমিকের সাথে গোপনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে, সেই দৃশ্য ঋতা নির্মাণ করেন চিৎকৃতভাবে; চরিত্রের রাগ, যন্ত্রণা, অপরাধবোধ, উদ্বেগ মেশানো বহুমাত্রিক অনুভুতি সেই চিৎকারে ধরা দেয় না। সঞ্জীব সরকার, রুনা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্তরা বন্দ্যোপাধ্যায় যথাক্রমে সাগর দাবরিওয়াল, আর্য’র মা ও নম্রতা যোশী’র ভূমিকায় মোটের ওপর সন্তোষজনকভাবে কিছুটা একমাত্রিক ওই চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তোলেন। (চরিত্রনির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন – যদি তাকে আর্য’র একধরনের প্রতিমুখ উপস্থিতি হয়ে থাকতেই হয়, তাহলে আর্য’র মাকে মারা যেতে হয় কেন? তার মৃত্যু কি তাৎপর্য দেয় টেক্সটকে?) রায়তী বসু প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন অভিনেতা;প্রাপ্তবয়স্কতার দোরগোড়ায় অবস্থিত কম বয়সী একটি মেয়ে (জিনিয়া), খানিকটা বিচলিত অথচ আত্মপ্রত্যয়ী – এই চরিত্রটিকে রায়তী যেভাবে উপস্থাপনা করেন তা বেশ আকর্ষণীয়। যদি এমনটা মনে হয়ে থাকে যে বেশির ভাগ অভিনেতাই (বিশেষত সুমিত, সঞ্জীব ও ঋতা) তাদের চরিত্রে প্রত্যয়ের সাথে প্রবিষ্ট হতে পারেন নি, তাহলে তার দায়ের একটা অংশ নাট্যকারকেও নিতে হবে, চরিত্রগুলোকে পরিপূর্ণভাবেসৃষ্টি না করার জন্য। কেবল একটি উদাহরণ – আর্য, যাকে কিনা সর্বদাতাড়না করেবিরাট পুঁজিপতি হওয়ার স্বপ্ন, তার হৃদয় একদিন তামিল নাডুর গ্রামের গরীব মানুষজনের নিদারুন কষ্ট দেখে পরিবর্তিত হয়ে পড়ে; তার চরিত্রায়নে এমন উপাদান কখনই রাখা হয় না, যার ওপর ভিত্তি করে তার এই আমূল পরিবর্তনের গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য হয়।
যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, এই নাটকের প্রধান সমস্যা হচ্ছে উদ্যোগপতি ও ব্যবসায়িক উদ্যোগ, যা কিনা এই নাটকের মূল বিষয়, তা নিয়ে নাট্যকারের ধারনাগুলো স্বচ্ছভাবে শেষ অব্দি ভেবে নিয়ে যাওয়ার অভাব। ব্রাত্য বসুর সফল নাটকগুলো বহন করে বিচক্ষণ, তীক্ষ্ণ, সুচিন্তিত ভাবনার স্পষ্ট চিহ্ন – বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীব্রাত্য বসুকে তার সেরা ফর্মে পায় না। শুরুতে উদ্যোগচিহ্নিত হলো কর্পোরেট সংস্থার অসংকুচিত বৃদ্ধির দ্বারা বিপুল অর্থ সম্পদ উৎপাদন করা হিসেবে, কিন্তু মাঝপথে এসে হাজির করা হলো ‘ঠিকঠাক উদ্যোগপতির’ একটা ধারনা এবং সব যেন ঘোলাটে হয়ে গেল। সেই ‘ঠিকঠাক উদ্যোগপতির’ ওপর ন্যস্ত হলো সমাজের গরীব-বিত্তবান বিভাজন মুছে দেওয়ার দায়িত্ব। সমাজতান্ত্রিক পুঁজিপতির এই কল্পনা সুকুমার রায়ের হাসজারুর মতই উদ্ভট;বাস্তব হচ্ছে, বর্তমানের বিশ্বায়িত মুক্ত বাজার অর্থনীতির মধ্যে কাজ করা চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা মূলক ব্যবসার দুনিয়ায় ঠিকঠাক উদ্যোগপতির সে’ই – তা আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক – যে, নিয়ম মাফিক সি এস আর- এর জন্য অর্থ বরাদ্দ রেখে, নিজের সংস্থার জন্য নিয়ে আসবে সবচেয়ে বেশি মুনাফা। প্রবল ও প্রসারিত উদ্যোগের ফলে তৈরী অর্থ সম্পদ কিভাবে করের আওতায় এনে তাকে সমাজে বন্টন করা হবে বৈষম্য দূরীকরনের লক্ষ্যে (যাতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আসাম্য কমে, কমে নাগরিক সুবিধে ও বিভিন্ন ধরনের রিসোর্স নাগাল পাওয়ার আসাম্য) তা সরকারের কাজ।নাটকের মাঝামাঝি, ব্রাত্য বসু সহসা উঠে পড়ে লাগেন আর্যকে ‘ভালো ছেলে’ বানিয়ে ফেলতে – নৈতিক চেতনা বর্জিত ব্যবসামুখী মায়ের কবল থকে উদ্ধার করে আর্যকে সঁপে দেওয়া হয় মেয়ের কোলে, (এর জন্য কোনরকম আনুভুতিক যুক্তির কাঠামো তৈরী না করেই), যে মেয়ে ব্যবসা, উদ্যোগ ও সার্বিকভাবে পুঁজির থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। থিসিস সম্বলিত একটি নাটককে মেরে ফেলার একটি সার্থক রাস্তা হচ্ছে নাটকের কোন একটা জায়গায় এসে থিসিসকে পরিত্যাগ করা।
বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীএকজন বাঙালি উদ্যোগপতির (যার কাজকর্মের যুক্তি আমরা সবসময় বুঝে উঠতে পারি না) অসন্তোষজনক গল্প হয়েইথাকে, তা কখনই হয়ে ওঠে না এমন একটা পাঠ যা জাতিগতভাবে বাঙালির ব্যবসা বিমুখতার কারন বিশ্লেষণ করার প্রয়াস করে। এমন যে হতেই হবে তা কিন্তু নয়। ২০১৪ সালে নিউ জার্সির একটি দল, ই সি টি এ, একটি নাটক মঞ্চস্থ করে কলকাতায় –শঙ্কর ঘোষাল ছিলেন নির্দেশক, আর একমাত্র অভিনেতা ছিলেন সুদীপ্ত ভৌমিক। অধ্যাপক আনন্দ লাল টেলিগ্রাফ কাগজে এই নাটকের রিভিউ করতে গিয়ে বলেন, “শঙ্কর ঘোষালের নির্দেশনায় সুদীপ্ত ভৌমিক আমাদের মনোযোগ ধরে রাখেন ৯০ মিনিট ধরে প্রায় কোন প্রপের সাহায্য ছাড়াই…”; আমার দুর্ভাগ্য আমি এই রিভিউয়ে এরকম কিছু লিখতে পারলাম না। ২০১৪’র ওই নাটকটার নাম কি ছিল? বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী।
দীপঙ্কর সেন