১৪ই মার্চ থিয়েটার শাইন আয়োজিত ডানকুনি থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের অঙ্গ হিসাবে উত্তরপাড়া গণভবন মঞ্চে পরিবেশিত হল ‘বারাসত কাল্পিক’ প্রযোজিত বাংলা নাটক ‘পাতার বাঁশি’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘তালনবমী’ অবলম্বনে নাটকটা লিখেছেন মুকুন্দ চক্রবর্তী, নির্দেশনা দেবব্রত ব্যানার্জী।
Previous Kaahon Theatre Review:
‘তালনবমী’ বিভূতিভূষণের একটা বহু পঠিত গল্প, প্রাক স্বাধীনতা যুগে গ্রামবাংলার এক প্রান্তিক পরিবারের দুই শিশুর আশা, আকাঙ্খা, ও হতাশায় ভরা জীবনের কাহিনী। নাট্যকার গল্পটাকে অনেক পরিবর্ধন করেছেন। এমনকি নাটকের শুরুটা দেখলে বোঝাও সম্ভব নয় যে এটা আসলে ‘তালনবমী’র এডাপ্টেশন, প্রধান চরিত্রদের নামগুলোও আলাদা! তবে পুরো নাটকটা দেখলে বোঝা যায় যে, নাট্যকার যে অংশগুলো সংযোজন করেছেন তার বেশ কিছুটা কিন্তু মূল গল্পে সাবটেক্সট হিসেবে ছিল। সেটা হল বঞ্চনার সাবটেক্সট, এক্সপ্লয়টেশনের সাবটেক্সট। নাট্যকার সেগুলোকেই কাহিনীর আকারে এক্সপ্লিসিটলি তুলে ধরেছেন যেন। স্পষ্টতই, এইরকম একটা গল্পকে শুধুমাত্র ক্লাসিক হিসেবে শেলফে সাজিয়ে না রেখে এরা যে গল্পটাকে একটা সমসাময়িক রূপ দিতে চেয়েছেন, নতুনভাবে ইন্টারপ্রেট করতে চেয়েছেন – এটা যথেষ্ট প্রশংসাযোগ্য। হ্যাঁ, শিশুটির হতাশার যে ইলাবোরেট দৃশ্যটি দিয়ে মূল গল্পটা শেষ হয়, নাটকে সেই দৃশ্যটাকে সেভাবে পাওয়া যায় না, কিন্তু তাই বলে নাটকে বিভূতিভূষণীয় রোমান্টিকতার অভাব ঘটেছে বলেও মনে হয় না, নাট্যকার পুষিয়ে দিয়েছেন দুইভাই কেলো আর ভুলোর মধ্যে পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, ও নির্ভরতার সম্পর্ক জড়িয়ে একের পর এক দৃশ্য বুনে। মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক নির্ভরতার প্রসঙ্গটাও নাটকের মধ্যে রাখা হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই দুই ভাই তাদের প্রতি বঞ্চনাকে চুপচাপ মেনে নেয় না, তারা বরং এই বঞ্চনার অবসানের স্বপ্ন দেখে। তাদের বাবার রেখে যাওয়া পাতার বাঁশিটাই যেন হয়ে ওঠে তাদের প্রতিবাদের স্বর। তবে নাটকের সবকিছুই যে সমানভাবে উতরেছে, এমনও নয়! কেলো, ভুলো ও তাদের বাবা যে উদার, সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখে তার প্রকাশভঙ্গি কিছুটা হলেও সেই সত্তর-আশির দশকের, বা বলা যায় ‘উদার অর্থনীতি-পূর্ব’ যুগের। ভুলোর সাবালক অবস্থার অংশে একেবারে বর্তমান সময়ের কিছু প্রসঙ্গ আনা হয়েছে বটে (‘দেশদ্রোহিতা’, ইত্যাদি), কিন্তু সংলাপের অগভীরতার কারণে তেমন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি! স্কুলমাস্টারের দৃশ্যটা যেন সাধারণ বাংলা সিনেমার থেকে ধার করা! পথের পাঁচালির অনুকরণে তৈরি যাত্রাপালার অংশটাও দীর্ঘায়িত, মূলনাটকের সঙ্গে সেভাবে সংপৃক্ত নয়! তালের বড়া খাবার অদম্য ইচ্ছায় ভুলো সাপের কামড়ের ভয় অগ্রাহ্য করেও জঙ্গল থেকে তাল কুড়িয়ে আনে, কিন্তু যেভাবে সেই তালটা প্রায় বিনা বাক্যব্যয়ে পুরোহিতকে দিয়ে দেয়, সেটার কিছু জাস্টিফিকেশনের প্রয়োজন ছিল! এই ব্যবহারের পিছনে তার বাবা/দাদার দেওয়া সাম্যবাদী আদর্শের শিক্ষা কাজ করে ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে তার মানসিক দ্বিধাটাও প্রকাশ পেলে সেটা হয়ত আরও স্বাভাবিক হত। তবে এসব সত্ত্বেও, নাটকের পুরো সময়টা জুড়ে, মোটের ওপর টেক্সটটির বিশ্বাসযোগ্যতা বহাল থাকে।
নির্দেশক দেবব্রত নাটকটাকে বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদ হিসেবেই দাঁড় করিয়েছেন। কিছু বিশেষ মুহূর্তে পাতার বাঁশি বাজিয়ে দেওয়াটা সেই প্রতিবাদেরই সোচ্চার প্রকাশ। প্রতিবাদের পার্ট হিসেবে মঞ্চে একাধিকবার মলমূত্র ত্যাগের দৃশ্যও এসেছে। মঞ্চভাবনার ক্ষেত্রে নীল কৌশিক ভীষণ মিনিমালিস্ট অ্যাপ্রোচ নিয়েছেন, প্রায় নিরাভরণ মঞ্চটি নাটকের থীমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, দর্শক মনে একটা শূন্যতার বোধ তৈরি করে দেয়। সামান্য কয়েকটা লাঠির মতো জিনিসকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে তিনি যেভাবে নানারকম পরিবেশ তৈরি করেছেন তা’ বেশ চমক সৃষ্টিকারী, একইসঙ্গে ভীষণ উপযোগী, আর দৃষ্টিনন্দন। মঞ্চের প্রতিটা অংশকে ব্যবহার করে দৃশ্যপরিকল্পনাগুলো করা হয়েছে। এই পরিকল্পনাগুলোকে যথাযথ সঙ্গত করেছে বরুণ করের আলো, তারা ভর্তি আকাশের দৃশ্যটা তো বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য (প্রক্ষেপণে প্রীতম চক্রবর্তী)। শুভদীপ গুহর সঙ্গীতও নাটকের মুডকে কমপ্লিমেন্ট করে। সমস্ত প্রয়োগের মধ্যেই বিভূতিভূষণের নান্দনিকতাকে ক্যাপচার করার একটা চেষ্টা চোখে পড়ে।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে দুই ভাই কেলো আর ভুলোর চরিত্রে যথাক্রমে অজয় চক্রবর্তী আর সুজয় বিশ্বাস দুজনেই তাদের চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন, বিশেষ করে কেলো চরিত্রে অজয়। সিনিয়র ভুলো চরিত্রে অনিরুদ্ধ একটু বেশিই আবেগপ্রবণ, তার বিপরীতে ডাক্তার চরিত্রাভিনেতা আবার বেশ দুর্বল, ফলে ওই দৃশ্যগুলোতে দর্শক অনিরুদ্ধর মূল বক্তব্যে মনোনিবেশ করার চেয়ে ‘আহা কি দারুণ অভিনয়’ বলে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাকিমা চরিত্রে পূবালী গাঙ্গুলী প্রায় বাংলা সিরিয়ালকে মনে করিয়ে দেন (প্রসঙ্গত, নাটকে যে দুনিয়াটা তৈরি করা হয়েছে তাতে মহিলাদের প্রায় কোনো ভূমিকাই নেই)। বাকি চরিত্ররা সকলেই মোটামুটি একটা স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে অভিনয় করেন। সবমিলিয়ে পাতার বাঁশি একটা যথেষ্ট উপভোগ্য নাটক হয়ে ওঠে, এবং নাটক শেষের পরেও দর্শকের মনে নাট্যঅভিজ্ঞতার রেশ রেখে যায়!
অতি সম্প্রতি যে কয়েকটি নবীন নাট্যদলের কাজের মধ্যে নিষ্ঠা ও একাগ্রতা খুব বেশি করে চোখে পড়ছে তাদের মধ্যে ‘বারাসত কাল্পিক’ অন্যতম। সরকারি গ্রান্টে বলীয়ান, জাঁকজমক স্বর্বস্ব, কলকাতাকেন্দ্রিক, বাংলা থিয়েটারের সমান্তরালে আরো যে একদল নবীন শিল্পী মফঃস্বল দাপিয়ে বেড়ান, পাদপ্রদীপের দাবি তাদেরও জোরালো। প্রিয় বাংলা নাট্যমোদী দর্শকবৃন্দের কাছে আবেদন, দয়া করে এইদলগুলির কাজের সঙ্গে পরিচিত হন, সামান্য সুযোগেই দেখে নেওয়ার চেষ্টা করুন এদের নাটকগুলো। বাংলা নাটকে নতুন চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সমর্থনকল্পে বারাসত কাল্পিকের মতো দলগুলোর উৎসাহবর্ধন খুবই জরুরি।