মিনার্ভা রেপার্টোরির নাটক মানেই পারফর্মারদের এনার্জি আর পরিশ্রম দেখে রক্ত গরম হয়ে ওঠা। বছর বছর নতুন পারফর্মার এলেও এই এনার্জি আর পরিশ্রমের প্রকাশে ভাঁটা পড়ে না। উল্টে বোঝা যায় তারা কি দারুণ একটা ফিজিক্যাল ও ভোকাল ট্রেনিং এর মধ্যে দিয়ে যান। নাটক/নাট্য হিসেবে যেমনই হোক, মুম্বাই নাইটস, নাসিকা পুরাণ, কাঁকড়া, খড়ির গণ্ডী কিন্তু পারফর্মেন্স দিয়ে জমিয়ে রেখেছিল দর্শকদের। “পাঁচ কড়ির গপ্পো” সেই অভিনেতাদের নিজেদের তৈরি নাটক। নাটক বাছা থেকে শুরু করে নির্দেশনা সমস্তই নিজেরা করেছেন এই তরুণ তুর্কীরা। তাই এই নাটকের কাছে শুরু থেকেই এক্সপেকটেশন ছিল অনেকটাই বেশী। শোনা গেছে প্রত্যেক অভিনেতাকেই রেপার্টোরির পাঠ্যক্রমে একটি করে ডিরেক্টোরিয়াল কাজ প্রেজেন্ট করতে হয়েছিল, তার থেকে সেরা ৫টি বেছে নিয়েই এই পাঁচ কড়ির গপ্পো। সেরার সেরা। তাই এক্সপেকটেশন আরও বেশী। মিনার্ভা রেপার্টোরির প্রেস রিলিজের বক্তব্য অনুযায়ী – “পাঁচকড়ির গপ্পো থিয়েটারের সরল আঙ্গিকে ধরতে যাওয়া পাঁচটি পটভূমি বা অবজ্ঞাত অবস্থা কিম্বা পাঁচটি লগ্ন বা ক্ষণকাল।“ নাটকের বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে সমাজের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন শ্রেণী, বিভিন্ন রাজনীতি এবং দর্শন।
প্রথম নাটক “ইসে মত কহো” (নির্দেশনা – বুদ্ধদেব, রচনা – শানু) তে আমরা দেখি দুর্নীতি পরাক্রান্ত এই আচ্ছন্ন সামাজিক অবস্থায় ইসমত চুগতাই এর মত বলিষ্ঠ, আপোষহীন, লড়াকু মানসিকতার ছুঁড়ে দেওয়া কিছু অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। দুর্নীতি পরাক্রমশীল,দুর্নীতি নেশার দ্রব্য। মিডিয়া সেখানে ক্রমশ গুলিয়ে দিতে চাইছে চেতনা, লুটে নিতে চাইছে সেই ‘কন’-‘ফিউস্ড’ কফি বিক্রির লাভ। সেই কফির ফ্লেভার আমরা সবাই চিনি। সকাল বিকেল ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, খবরের কাগজ আর নিউস চ্যানেলে খাই। খেয়ে খেয়ে মুখ তেঁতো আর গা গুলিয়ে উঠেছে। ইসমতের প্রশ্নগুলো সেই কফির স্বাদ পেরিয়ে আস্বাদন করতে বলে সেই নোনতা জলকে যা আমাদের চোখ অনেক দিন ধরেই পাঠিয়ে আসছিল, আমরা আস্বাদন করতে ভুলে গেছিলাম। এই কান্না আকুতির বা প্রার্থনার নয়, এই কান্না জ্বলে ওঠার ইন্ধন, শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়ানোর সাপোর্ট।
Previous Kaahon Theatre Review:
তারপরের নাটক “সরল অঙ্ক” (নির্দেশনা -তথাগত) আমাদের নিয়ে এসে ফেলে একেবারে পার্সোনাল স্পেসে। মোহিত চট্যোপাধ্যায়ের লেখনী গুণ এই নাটকের ভিত শুরু থেকেই শক্ত করে দেয়। এই নাটক মূলত চিনতে শেখায় জীবনের অঙ্ক। একটি সমস্যা, তার প্রতি তৈরি হওয়া ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীই কিভাবে পাল্টে দিতে পারে সমস্যাটিকে – হাসির মোড়কে পার্সোনাল-এর সঙ্গে তৈরি হয় পলিটিকাল-এর যোগ।
ফোকফর্মে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে পরের নাটক “দেবীচণ্ডী ও কালকেতু” (নির্দেশনা -তাপসী, রচনা – অনির্বাণ)। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এক দেবীর নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করার লড়াই। প্রচলিত কালকেতুর গল্পকে অক্ষুণ্ণ রেখেই কবিকঙ্কণ মুকুন্দ দাস এর কাব্য অবলম্বনে এই নাটকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে গ্রামবাংলার জীবনযাত্রা।
বাদল সরকারের “ভুল রাস্তা” (নির্দেশনা – দেবযানী) তারপর আবার আমাদের টেনে নিয়ে যায় পার্সোনাল থেকে পলিটিকালে। গল্পে গানে অ্যানালাইজ করার চেষ্টা করে শোষকগোষ্ঠী আর শোষিতের সম্পর্ক। স্বপ্ন দেখায় এমন এক দেশের যেখানে জীবনবোধ তৈরি হবে প্রকৃতি আর মানবিকতার মিশেলে।
শেষ নাটকটি নবারুণ ভট্টাচার্যের কাহিনী অবলম্বনে “লড়াই” (নির্দেশনা -প্রদীপ)। একটি যৌন পল্লীতে ঘটে চলা রোজকার লড়াইয়ের ছোট্ট একটু অংশ। আশা, আকাঙ্ক্ষা, মৃত্যুর পরোয়ানা, হিংসা আর কঠোর বাস্তবের মিশেলে এ যেন একটু কাঁচা জীবনের আস্বাদন। সব কটি নাটকই প্রাসঙ্গিক, তারুণ্যের উদ্যমেতৎপর,অভিনেতারাও দারুণ এক একজন পারফর্মার। কিন্তু…
কোথাও একটা তারুণ্যের, নতুন মানসিকতার সমকালীন হতে পারায় ম্যাচিওরিটির খামতি রয়ে গেছে। আলো, পোশাক, মঞ্চ ব্যবহার, অভিনয় ও সর্বোপরি নির্দেশনা এবং নাটকের নাট্যে রূপান্তর – সবই ভীষণ ওল্ড স্কুল। টেক্সটগুলোও বেশীরভাগই পুরনো। নির্দেশকরা কেউ নতুন কিছু লিখলেন না কেন? ভুল বুঝবেন না, ওল্ড স্কুল’কে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক বলছি না। বলতে চাইছি এই জেনারেশনের কাছ থেকে ওল্ড স্কুলের থেকে শিক্ষা নিয়েই একটা মস্ত ডিপারচার এক্সপেক্ট করছি। আজকের নাট্য শুধুই আগের নাট্যভাবনা বা প্রকরণকে নতজানু হয়ে অনুকরণ করে গেলে সামগ্রিকভাবে নাট্যচর্চা এগোবে কি করে? ইতিহাস কিন্তু গুরুর বিপরীতে শিষ্যের মার্জিত বিরুদ্ধাচরণেই বারবার অগ্রসর হয়েছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে যথেষ্ট শারীরিক এবং বাচিক প্র্যাকটিসের সঙ্গে কোথাও ব্রেনস্টর্মিং এর অভাব রয়ে যাচ্ছে না তো? হাতের সামনে মঞ্চ আলো মিউজিক এবং সমস্ত উপকরণ থাকা সত্বেও এক্সপেরিমেন্ট কেন হচ্ছে না? বলতে বাধা নেই রাজ্যের অন্যান্য নাট্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় মিনার্ভারে পার্টোরির শিক্ষার্থীরা কিন্তু (যোগ্য হিসেবেই) অনেকটাই প্রিভিলেজড। বাইরে যাঁরা ক্রমাগত জীবনপাত করে যাচ্ছেন শুধু থিয়েটারটুকু চালিয়ে যাবেন বলে তাদের অনেকের কিন্তু শুধু যোগ্যতাটুকুই সম্বল। প্রথম থেকে শেষ সব নাটকই যতটা সম্ভব অভিনয় নির্ভর। মঞ্চ ব্যবহার, সিনোগ্রাফি, আলো এবং মিউজিকের ব্যবহার, মাল্টিলেয়ার মিনিং তৈরি করার চেষ্টা – এসবের অভাব বেশ হতাশ করে, যদিও এক নাটক থেকে অন্য নাটকে যাওয়ার সময় মঞ্চের ব্যবহার বেশ অভিনব।
“ইসে মত কহো”তে যে প্রশ্নগুলো উঠে আসে তা বাস্তবিক এবং প্রাসঙ্গিক হলেও যথেষ্ট গভীর নয়। প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক হলেও প্রশ্নগুলো করা কেন দরকারী, কেন এইসব পলিটিকাল বিষয় জোর করে পার্সোনাল হয়ে যায় তার কোন ইঙ্গিত নির্দেশক রাখেননি। ফলত রক্তগরম করা উপভোগ্য ডায়লগে নাটকটা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। “সরলঅঙ্ক” নাটকেও যথেষ্ট সম্ভবনা ছিল মনোরঞ্জনকে গভীরতর করে তোলার। লোকনাট্যের ঢঙে করা দেবীচণ্ডী ও কালকেতু নাটকের শেষে প্রচলিত এবং কমার্শিয়ালি বহুল ব্যবহৃত “আইগিরি নন্দিনী” গানের ট্র্যাকটি কেন ব্যবহার করা হল? তারা নিজেরাই দক্ষ গাইয়ে, তারাই গাইতে পারতেন! “ভুলরাস্তা”-র পারফর্মেন্স ভাল হলেও কেন পাওয়া গেল না এন্টারটেইনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে ধাক্কা দেওয়ার তাগিদ? “লড়াই”-তেও লড়াই কেন সীমাবদ্ধ থাকল শুধুমাত্র পার্সোনাল’এর মধ্যে? কেন পেট্রিয়ার্কির প্রশ্নগুলো নিয়ে আরও নাড়াচাড়া করা হল না? সেইরকম অল্টারনেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি কেন দেখতে পাওয়া গেল না নাটকগুলিতে যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্বেও? এসব প্রশ্ন করতেই হচ্ছে। প্রসঙ্গত আরেক তরুণ নাট্যদল ‘সমূহ’ তাদের নাটক “অথ হিড়িম্বা কথা”-তে কিন্তু যথেষ্ট তাগিদ এবং জোরের সঙ্গে পার্সোনাল, পাবলিক, পলিটিকাল প্রশ্নগুলো তুলে ধরেছে (অথ হিড়িম্বা কথা নাটকের রিভিউ)। তারা সকলে পারফর্মার হিসেবে মিনার্ভারে পার্টোরির অভিনেতাদের মত এতটা পোক্ত না হলেও, নিজেদের কথা বলতে চাওয়ার তাগিদ কিন্তু দেখবার মত। কিছু একটা বলতে চাওয়ার অন্তরতম তাগিদ… খুব দরকারি নয় কি, বলুন?
মিনার্ভা রেপার্টরি টিম হিসেবেই নিজেদের প্রেজেন্ট করতে চেয়েছে এই কাজে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টে সহযোগিতা করেছে। তাদের দলগত নাট্যচর্চার ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে সকলের নাম একসাথে উল্লেখ করা হল। নাটকটির সাম্প্রতিক অভিনয় হয়ে গেল গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে গিরিশ মঞ্চে। এই রিভিউ ১২ই নভেম্বর ২০১৯ এর শো এর ভিত্তিতে করা।
মিনার্ভা রেপার্টোরি টিমঃ
অভিনয়ে
অনির্বাণ, অরিমিতা, অনন্যা, কৌশিক, বুদ্ধদেব,
তথাগত, তন্ময়, দীপান্বিতা, দেবযানী,
নিবেদিতা,পৃথ্বীরাজ, প্রদীপ, শান্তনু, শিপ্রা, শুভম,
সায়ন্তী, সুলগ্না, সুপর্ণা, স্বাগতম
নেপথ্যে
মঞ্চ: কৌশিক, তন্ময়, পৃথ্বীরাজ, শান্তনু,
আলো :অনির্বাণ, দীপান্বিতা, শুভম, স্বাগতম
মঞ্চ উপকরণ: অরিমিতা, দেবযানী, নিবেদিতা, সুলগ্না
পোশাক: তথাগত, প্রদীপ, শিপ্রা, সুপর্ণা
আবহ প্রক্ষেপণ: বুদ্ধদেব, তথাগত, নিবেদিতা, প্রদীপ
বাদ্যযন্ত্রে: তথাগত, পৃথ্বীরাজ, প্রদীপ
রূপসজ্জা: অনন্যা
নির্দেশনা
বুদ্ধদেব, তথাগত, তাপসী, দেবযানী, প্রদীপ
সামগ্রিক পরিকল্পনা
পার্থসারথি সরকার
সহযোগিতায়
মিনার্ভা কর্মীবৃন্দ
বিশেষ কৃতজ্ঞতা
মিনার্ভা পরিচালন কমিটি