থিয়েটার যে একটা কম্পোসিট আর্ট সেটা নাটক করতে করতে যতটা না বোঝা যায় তার থেকে অনেক বেশী বোঝা যায় নাটক দেখতে গিয়ে। মঞ্চের উপরে যখন নাটক করি তখন আমরা সব্বাই আমাদের ১০০ শতাংশ দিই, যারা অভিনয় করছি, যারা টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছি, তারা কেউ কখনও এরকম ভেবে কাজ করি না যে আজকে আমি আমার সেরাটা দেব না। কিন্তু তার কতটা মিলেমিশে দর্শকের কাছে পৌঁছচ্ছে সেটা কিন্তু একটা বেশ বড় ফ্যাক্টর। আর এই ফ্যাক্টারটাকে খুব সুচারুভাবে হ্যান্ডেল করার দায়িত্ব হল ডিরেক্টার মশাই-এর। এর আগেও বহু নাটকের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি আলাদা আলাদা ভাবে এই সমস্ত এলিমেন্টগুলো বেশ ভালো করে হ্যান্ডেল করা। কিন্তু সবটা মিলিয়ে রান্নাটা ঠিক জমলো না।
এইসব বকবক করছি কারণ মনটা বেশ ভারাক্রান্ত। একটা নাটক সদ্য দেখে এসেছি যার বক্তব্যটা খুব ভালো, কিন্তু এক্সিকিউশান একেবারে কলেজের নাটকের মত। দ্বিগুণ দুঃখ পাচ্ছি কারণ এইদলের আগের নাটক ‘মল্লভূমি’ দেখে বেশ ইম্প্রেসড হয়েছিলাম।
কল্যাণী মুখোশ দলের নাটক – ‘তর্কে বহুদূর’। রচনা ও নির্দেশনা অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নাটকের কনফ্লিক্টটা চিরাচরিত এবং সমকালীন – বিজ্ঞান এবং কুসংস্কারের। দৈনন্দিন জীবনের কো-ইন্সিডেন্স কিভাবে আমাদের ভাগ্য, শুভ-অশুভ, তুকতাক এসবে বিশ্বাস করতে শেখায় আর কিভাবে মানুষ কিছু বুজরুকের খপ্পরে পড়ে শক্তি, সাহস, মানসিক স্থিতি সব বিসর্জন দিয়ে ফেলে – এই গল্প তার। আমাদের চারপাশে তাকালে এমন অনেককেই আমরা খুঁজে পাব যারা এসবে বিশ্বাস করেন, এমন অনেকে আছেন যারা আগে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু কোন বিশেষ ঘটনার পর থেকে এমন কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছেন আবার এমন অনেককে দেখি যারা অন্যের এই কুসংস্কার নিয়ে ঠাট্টা (প্রকারান্তরে অপমান) করতে ছাড়েন না।এই নাটক সেই বিজ্ঞান আর কুসংস্কারের সংঘাতের কথা বলে।
Previous Kaahon Theatre Review:
এই নাটকের কনফ্লিক্ট কিন্তু উঠে আসে এমন একটা জায়গা থেকে যা সমাজ জীবন এবং কালচারের অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত। শিক্ষিত সমাজ, কর্মে বিশ্বাসী সমাজ, কার্যকারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী সমাজের তো এরকম হওয়ার কথা ছিল না? তাও কেন এত গুরুজি – মাতাজি – তন্ত্র সিদ্ধবাবা – গুরমিত রাম রহিম সিং ইনসানদের প্রতিপত্তি? এটাও আসলে একটা পলিটিক্যাল ট্র্যাপ। ইউরোপে ১৯ শতকে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইসেশনের হোতারা, বা আমেরিকায় ২০শতকের ক্যাপিটালিজমের হোতারা (এবং অবশ্যই এখানে আমাদের সরকার বাবুও) দাবী করেছিলেন (এবং করেন) যে তাঁরা যা যা প্ল্যান করছেন তা কার্যকরী হলে প্রত্যেকটা মানুষের পেটে খাবারের জোগান হবে, সব স্তরের মানুষের স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং বেড়ে যাবে, প্রত্যেকটা মানুষের হাতে কাজ থাকবে। কিন্তু আদতে যখন সে সবকিছুই হয় না এবং স্পষ্ট হয়ে যায় যে কোনদিনই হবে না তখন তাঁরা মানুষকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিথ্যে বোঝাতে থাকেন যে সরকার তোমাদের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়ছে, দেশের মাটি সুজলা সুফলা, দেশের মানুষ সত্যও নিষ্ঠার পথে অগ্রগামী, সকলের পেটে খাবার, পকেটে বিভিন্ন জিনিস কেনার মত পয়সা রয়েছে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, দেশের প্রত্যেকটা লোক সুখে আছে। যাঁরা সুখে নেই, তাঁরা নিশ্চয়ই ঠিকমত খাটছেন না বা তাঁদের ভাগ্য সহায় নেই। পপুলার কালচারেও এই ভাবনার প্রকাশ ভুরি ভুরি। এরকম অযৌক্তিক কথা যখন বারবার বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করে মানুষের সাবকনশাশকে তখন মানুষ বাধ্য হয় কু-সংস্কারে বিশ্বাস করতে।
নাটকের টেক্সটে এই গভীরতর জায়গাটি ছুঁয়ে যাওয়া হবে আশা করেছিলাম। কারণ সমস্যার উৎস কোথায় না জানলে সেটা মানুষের কাছে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বা দুশ্চিন্তা করার মত বলে মনে হয় না। এটা এমন একটা সূক্ষ্ম সমস্যা যেটার প্রভাব দেখা যায় বিশাল বড় হয়ে অথচ এই নাটকের বিষয়বস্তু ততটা সিরিয়াস ভাবে দর্শকের কাছে এসে পৌঁছয় না। এই জীবন যাপনেরই অঙ্গ অন্ধবিশ্বাসে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা থেকে শুরু করে অন্যদেশের লোক আমার খাবারে ভাগ বসাচ্ছে ভেবে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া সমর্থন করা। এত জরুরী কথা বলার ছিল… তাও নাটকটা এক বিজ্ঞানী ছেলে এবং তার একদা কমিউনিস্ট অধুনা ভক্ত (ভক্ত্ নয়) বাবার মতের অমিল হওয়া গার্হস্থ্য সমস্যা হয়েই থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে নাট্যকার এবং নির্দেশককে আরও একটা কথা না বলে পারা যাচ্ছে না- বিষয় বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সাথে বিজ্ঞান মনস্ক হওয়ার বিশেষ সম্পর্ক নেই। অসংখ্য ডাক্তারের হাতে তাবিজ কবচ মাদুলি দেখতে পাই, অসংখ্য অ-বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষককে দেখি যুক্তিতে এবং কেবলমাত্র যুক্তিতেই বিশ্বাস করতে।অসীমা (মূল চরিত্রের মা) চরিত্রকে অঙ্কের গ্র্যাজুয়েট না বানালেও চলত। এটাও একরকমের সংস্কারকে ইন্ডালজ করা নয় কি?
এতক্ষণে সকলেই মোটামুটি বুঝে গেছেন নাটকটা কি নিয়ে করা। বাকি জিনিসগুলো নিয়ে কথা বলি? কিইবা কথা বলি… বাকি এলিমেন্টগুলো নিয়ে যথেষ্ট যত্ন সহকারে, প্রফেশানাল স্টেজে করার মত করে ভাবা বা প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয়নি। অভিনয় সকলেরই বেশ খারাপ, তার থেকে ও বড় কথা কোন অভিনেতাই অভিনয়ের ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন বলে মনে হয়নি, তার সঙ্গে বারবার ডায়লগের খেই হারিয়ে ফেলা, চরিত্রগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা না করা…দর্শকের চোখকে বড্ড কষ্ট দিয়েছে। বাবা মা যে ছেলের থেকে বয়সে ছোট তা খুব স্পষ্ট করেই বোঝা যাচ্ছিল। এমন নাটকের ক্ষেত্রে যেখানে বক্তব্যটাই আসল, সেখানে চরিত্রায়নের সময় না থাকলে মেক বিলিভের সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। আসলে অভিনেতারাই কমিউনিকেশনের বাধা হয়ে দাঁড়ালে সেটা দর্শকের কাছে বেশ কষ্টকর একটা ব্যাপার হয়ে ওঠে। নাটকের ঘটনাবলী যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে তাও খুব অবিশ্বাসযোগ্য এবং অনেকাংশে সিরিয়ালোচিত। মঞ্চ সজ্জা, আলো এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানো হয়নি।মিউজিকের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত নাটকটা কলেজ ফেস্টে করা একটা নাটকের মত হয়ে গেছে যেখানে নির্দেশক বিষয়বস্তুটা বেশ জোরালো ভেবেছেন কিন্তু নাটকটাকে নাটক করে তোলার জন্য খুব একটা সময় দিতে পারেননি।