গত ৮ই নভেম্বর, গিরিশ মঞ্চে অভিনীত হল খিদিরপুর রংবেরং দলের প্রযোজনায় বাংলা নাটক ‘ডেডলাইন -The game is on‘। নাটক ও নির্দেশনা তন্ময় চন্দ্র।
এই নাটকের কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে একটি অপহরণ। বীরেন বর্মণ একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, স্ত্রী ও কন্যাসহ তার সুখী পরিবার, একদিন হঠাৎ করেই কিডন্যাপ হয়ে যায় তাদের শিশুকন্যাটি। কিডন্যাপাররা মুক্তিপণের টাকা রেডি করার জন্য ছ’ ঘন্টার সময়সীমা দেয়, আর তার থেকেই নাটকের নাম ‘ডেডলাইন‘। ঐ ডেডলাইন নাম এবং তার সঙ্গে একটা ইংরিজি ল্যাজ – দ্য গেম ইস অন – আপনার মনে হতে পারে যে নামটার মধ্যে একটা হিন্দি ছবি মার্কা গন্ধ রয়েছে, আর নাটকটা দেখার পরে তো নিশ্চিত হয়েই যাবেন যে এটা একটা অতি সাধারণ হিন্দি সিনেমার ততোধিক খারাপ অনুকরণ! তবে বিজ্ঞাপনে প্রকাশ, নাটকটা নাকি আমেরিকান লেখক Greg Iles এর 24 Hours নভেলের ওপর ভিত্তি করে লেখা! কিন্তু সেই গল্পটা তো আসলে একটা বেস্টসেলিং থ্রিলার, নাকমুখ গুঁজে পড়ে ফেলার মত একটা বই! তাহলে সেটা এরকম খাজা, ভ্যাদভ্যাদে, মরালিস্টিক, আর বোরিং একটা টেক্সটে চেঞ্জ হয়ে গেল কি করে? এর পেছনে একটা রহস্য আছে। তবে এই রহস্য ভেদ করতে আপনার ফেলুদা বা মিতিন মাসি হবার কোনো প্রয়োজন নেই, একটু চোখ কান খোলা রাখলেই চলবে – কারণ সাম্প্রতিক বাংলা থিয়েটারে এই প্রবণতাটা বেশ খোলাখুলিই চোখে পড়ছে!
Previous Kaahon Theatre Review:
গ্রেগ আইলসের এই বইটা প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। তারপরে ২০০২ সালে এই গল্পটা নিয়ে হলিউডে তৈরি হয় Trapped বলে একটা ইংরিজি সিনেমা। গল্পের বেশ কিছু জায়গা চেঞ্জ করা হয়, যেমন সিনেমায় বেশি নাটকীয়তা আনতে ডায়াবেটিসের জায়গায় আসে হাঁপানি রোগ! গল্পে আরেকটি ফ্যামিলির কথা ছিল, যারা এই কিডন্যাপারদের পূর্ব শিকার – আরো বেশি ফোকাসড হবার তাগিদে পুরো সাবপ্লটটি ছবিতে বাদ ! তবে গল্পের নড়বড়ে জায়গাগুলো ছবিতে মেকআপ করা হয়নি – আর কিছু চিলিং মোমেন্ট থাকলেও, এরোপ্লেন নিয়ে স্টান্ট, গাড়িতে গাড়িতে ধাক্কা, এক্সপ্লোশন, বন্দুকবাজি, আর যৌনতার ককটেল – সবকিছু নিয়ে তৈরি হয়েছিল বেশ সাধারণ মানের একটা ছবি! আর এই ছবিটাকে ফলো করেই ২০০৬ সালে বলিউডে তৈরি হয় হিন্দি ছবি ‘ডেডলাইন: সির্ফ ২৪ ঘন্টে’। কিছু দৃশ্য তো হুবহু কপি করা; তবে আসলে তো এটা একটা হিন্দি ছবি, তাই সাংসারিক কিছু দৃশ্যের অবতারণা না করলেই নয়, আর শেষে গিয়ে একটা মরালিস্টিক টুইস্টের অ্যাডিশন। অবশ্য অ্যাডিশন না বলে এক্সটেনশন বলা ভালো, কারণ ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে ইংরিজি ছবিটাতেও ছিল। তবে হিন্দি ছবিতে কিডন্যাপারকে ব্লো-জব দিতে যাচ্ছেন একজন গৃহবধূ, এটা দেখানো নির্মাতাদের পক্ষে বাড়াবাড়ি হয়ে যেত, তাই যৌনতার অনুষঙ্গ পুরোটাই বাদ! শেষের ধুমধাড়াক্কা ব্যাপারগুলোও বাদ, বদলে একটা সোশ্যাল মেসেজ যোগ করার দুর্বল চেষ্টা! সব মিলিয়ে আরও একটা নড়বড়ে এবং খারাপ ছবি, তার সঙ্গে ফ্লপও।
নাটকের কথা ছেড়ে সিনেমার কথা এত বেশি করে বলতে হল তার কারণ – এই যে ‘ডেডলাইন – দ্য গেম ইস অন’ নাটকটা, সেটা অন্তত নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে, ঐ ‘ডেডলাইন: সির্ফ ২৪ ঘন্টে’ বলে হিন্দি সিনেমাটার কপি! সিন টু সিন, ডায়লগ টু ডায়লগ, কপি!!!! এমনকি বীরেন, কবির – চরিত্রদের এই নামগুলো পর্যন্ত এক! অথচ কি অনায়াসেই না বিজ্ঞাপনে লিখে দেওয়া হচ্ছে ‘Based on Greg Isle’s novel 24Hours’!! আসলে তো এটা একটা অ্যাডাপ্টেশনের কপির কপি!!! কেন এই প্রতারণা?? ‘হিন্দি ছবি থেকে টুকেছি’ – এটা বলতে লজ্জা? নাকি ‘ইংরিজি গল্প থেকে অ্যাডাপ্ট করেছি’ বললে দর্শকরা বেশি সমীহ করবেন? দর্শককেই বা এতটা আন্ডারএস্টিমেট কেন করা হচ্ছে? আজকের এই সস্তা ইন্টারনেটের যুগে খুব সহজেই তো দর্শক আসল ব্যাপারটা বুঝে ফেলতে পারেন! তাহলে কি এটা একধরণের টেকেন ফর গ্রান্টেড মনোভাব? ‘দর্শকের কোনো চয়েস নেই, যা দেখাবো তাই দেখবে’ – এই রকম? সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছেনা! কিন্তু চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে কিরকমের অসৎ প্রবণতা গ্রাস করছে বাংলার নাট্যজগৎকে! এই মুহূর্তে কলকাতার মঞ্চে চলছে আরও একটি বাংলা নাটক ‘বাজিমাৎ’, সেখানেও একটি হিন্দি ছবি থেকে হুবহু টুকে দাবি করা হচ্ছে সেটা ইংলিশ নভেলের অ্যাডাপ্টেশন! পরিত্রাণের উপায়? কোনোভাবে একটা সচেতন দর্শকসমাজ তৈরি করতে পারা, যারা কিনা নির্মাতাদের এরকম ওপরচালাকি করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করবেন।
আচ্ছা না হয় মেনেই নেওয়া গেল নাটকটা আসলে একটা হিন্দি ছবি অনুপ্রাণিত! হিন্দি ছবি মানেই কি খারাপ? ছবির বক্তব্যটা কেউ পছন্দ করতেই পারেন। তিনি ভাবতেই পারেন যে এই ছবির কাহিনী অনুসরণ করে একটা ভালো নাট্য নির্মাণ সম্ভব! কিন্তু তিনি কি অনুবাদের কাজটা মাইন্ডলেসলি করবেন? হিন্দি ছবিটার কাহিনীর ফাঁকফোকর গুলো ভরাট করার চেষ্টা করবেন না? একটা বিদেশী গল্পের ভারতীয় করণের সমস্যাগুলো অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করবেন না? একটা বাড়ি থেকে কাউকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া, তারপর সেই বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা, বা গাড়ি করে সেই বাড়ি থেকে বারবার বাইরে যাতায়াত করা – এগুলো আমেরিকার কোনো কান্ট্রিসাইডের নির্জন এলাকার বাড়িতে যতটা সহজ, ভারতের কোনো জনবহুল শহরের আবাসনে ঠিক ততটাই কঠিন! কোনো স্বাভাবিক ভারতীয় কিডন্যাপার নিঃসন্দেহে প্ল্যানটা অন্যভাবে করত! তারপর আবার শেষের দিকে পুলিশ, মিডিয়ায় জানাজানি হবার পরেও সে বিনা বাধায় সেই বাড়িতে গটগট করে ঢুকে আসে!! আর ভারতে বন্দুক জিনিসটা আমেরিকার মত সহজলভ্য মোটেই নয়, কোনো বাড়িতে বন্দুক থাকলে তার প্রপার জাস্টিফিকেশন থাকতে হয়! কোটি টাকা জোগাড় করার জন্য ছ’ ঘন্টার সময়সীমা একেবারেই অবাস্তব, ব্যাঙ্কিং আওয়ার্সের বাইরে সেটা প্রায় অসম্ভব! মহিলা কিডন্যাপারটি ডাক্তারকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেও শেষে গিয়ে কোন যুক্তিতে তাকে টাকা আনার জন্য বাইরে যেতে অ্যালাউ করতে পারে? কিডন্যাপার টাকা নিয়ে চলে যাবার পরে সঙ্গে সঙ্গেই যদি ডাক্তার পুলিশে খবর দেবেন তাহলে আগেই সেই চেষ্টা করেননি কেন? স্বভাবতই, এসব অসঙ্গতি নিয়ে সামান্যতম চিন্তাভাবনাও করা হয়েছে বলে মনে হয়না! অথচ শুরুর দিকে ডাক্তার ও তার স্ত্রীর প্রেমালাপের একটা দীর্ঘ দৃশ্য যোগ করা হয়েছে, বোকাবোকা বাংলা সিনেমার মতো সংলাপ সুদ্ধু! এমনকি স্ত্রীকে দিয়ে একটা রোমান্টিক গানের প্লে-ব্যাকের সঙ্গে লিপ পর্যন্ত মেলানো হয়েছে! ডাক্তারি প্রফেশনে মরালিটি নিয়ে তৈরি নাটকটা তো চূড়ান্ত একপেশে আর অগভীর। স্ত্রীর এক ধমকেই ডাক্তারের চৈতন্য ফিরে আসে আর তিনি সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ার সামনে গিয়ে নিজের দোষ কবুল করে নেন! এই সারল্য বাংলা সিরিয়ালে চলতে পারে, সস্তার সিনেমায় চলতে পারে, কিন্তু বাংলা মঞ্চে কেন লোকে দেখবেন? নির্দেশক ইন্টারভিউতে বলেছেন যে নাটকটা অর্থলোভী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে, যদি তারা নিজেদের শোধরান তাহলে সাধারণ মানুষেরা বেঁচে যাবেন! খুব সুন্দর চিন্তাধারা। তাহলে এমন একটা নাটক বাছুন না, যেটা এই সমস্যার উৎপত্তির পেছনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণগুলোকে অ্যাড্রেস করবে? সমস্যার গভীরে গেলে তবেই না দর্শক আপনাকে সিরিয়াসলি নেবে? আর নইলে থ্রিলার করতে চাইলে ঠিকঠাক করে থ্রিলারই করুন, বাংলা মঞ্চে ভালো থ্রিলারের অভাব চাহিদা দুই-ই আছে! এরকম আধাখ্যাঁচড়া কিছু কমেন্ট জুড়ে দিয়ে একটা বড় সমস্যাকে ট্রিভিয়ালাইজ করবেন না!
নাটকের বাকি অ্যাস্পেক্ট গুলো নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই! একটা টুকলি করে বানানো নাটকে সেগুলোর আলাদা করে সেরকম গুরুত্ব নেই। মঞ্চসজ্জা গতানুগতিক হলেও কিছুটা চিন্তা ভাবনার ছাপ আছে। তবে থ্রিলটা ধরে রাখতে গেলে দৃশ্য পরিবর্তন আরও দ্রুততার সঙ্গে করা উচিত, বিশেষ করে স্টেজের মাঝের অংশে। অভিনয় অংশে আলাদা করে চোখে পড়েন সপ্রতিভ শিশুশিল্পী দিশা সিং, তার স্বাভাবিক অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে! তবে তার লাঠির ঘায়ে কবিরের অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটা অবাস্তব! তবে সব মিলিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার যে অভাবটা নাটকের শুরু থেকেই অনুভূত হয়, শেষ পর্যন্ত সেটাই বজায় থাকে!
তো সহৃদয় পাঠক এবং বাংলা নাটকের দর্শকবন্ধুরা, কাহনের পক্ষ থেকে আমরা অবশ্যই চাই যে আপনারা নাটক দেখুন এবং আপনার চেনাপরিচিতদের নাটক দেখতে উৎসাহিত করুন। কারণ দর্শক না দেখতে এলে তো নাটকই থাকবে না। আমি আপনি কেউই সেটা চাই না। তবে দয়া করে নাটককে একটু ক্রিটিকালি দেখুন আর নাটক নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করুন। কোন নাটককে আপনারা গ্রহণ করছেন আর কোনটাকে করছেন না, সেটা নির্মাতাদের টের পাওয়াতে হবে। তবেই তো তারা নিজেদের আরও উন্নত করার সুযোগ পাবেন, নিজেদের চারদিকের অলিখিত গণ্ডী ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবেন[১]!
[১] কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ডক্টর সৈকত চক্রবর্তী (বিজ্ঞানী ও বাংলা নাটকের দর্শক) ।