ঘুম নেই – ভদ্রলোকদের নাট্যমঞ্চে সাব-অল্টার্নদের নিয়ে পুরনো রাজনৈতিক নাটক

Posted by Kaahon Desk On December 22, 2019

গত ১৫ ডিসেম্বর নিরঞ্জন সদন-এ অভিনীত হল ‘ইচ্ছেমতো’ নাট্যদলের প্রযোজনায় বাংলা নাটক ‘ঘুম নেই’। উৎপল দত্তের লেখা এই নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সৌরভ পালোধী। যদিও এই রিভিউ ১লা অক্টোবর মধুসূদন মঞ্চের অভিনয়ের নিরিখে করা হয়েছে।

আমরা সবাই জানি যে উৎপল দত্ত সাম্যবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, আর তার প্রায় সব নাটকই সেই স্ট্রং রাজনৈতিক কমিটমেন্টের জায়গা থেকেই লেখা। এই ‘ঘুম নেই’ নাটকটাও তার ব্যতিক্রম নয়। ষাটের দশকের শুরুতে দেশের রাজনীতিতে ক্রমশ গুরুত্ত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চাওয়া ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে মাথায় রেখেই নাটকটা লেখা। নাটকের মূল বিষয়বস্তু হল শ্রমিক ও মালিক শ্রেণীর চিরকালীন দ্বন্দ্ব! হাইওয়েতে একটা খাবারের দোকানের সামনে ট্রাক ড্রাইভারদের সান্ধ্য আড্ডার কয়েকটি ঘন্টা নিয়েই এই নাটক। ষাটের দশকে দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের প্রেক্ষিতে এ এক খুবই প্রাসঙ্গিক নাটক ছিল, আজ অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও নাটকের মূল বিষয়টি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির প্রচুর পরিবর্তন ঘটেছে। তাই আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, বর্তমান বাংলা নাট্যজগতের এক তরুণ প্রতিশ্রুতিমান নির্দেশক এই নাটককে ঠিক কী ভাবে দেখেছেন, কী ভাবে উপস্থাপনা করছেন, সেটা যথেষ্ট কৌতূহলের বিষয় ছিল।

Previous Kaahon Theatre Review:

এই নাটকটা নির্মাণ করতে গেলে প্রথমেই যে সিদ্ধান্তটা নিতে হত, সেটা হল নাটকটিকে বর্তমান সময়ে নিয়ে আসা হবে কিনা! সেটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে করতে পারাটা যথেষ্ট কঠিন, আর আধা-খ্যাঁচড়া ভাবে সেই চেষ্টাটা না করাই ভালো। নির্দেশক ব্যাপারটা শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলেন। প্রাথমিক সংলাপেই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের উল্লেখে স্পষ্ট হয়ে যায় যে নাটকটি বর্তমান সময়ে আনা হয়নি, আর পরে অভিনেত্রী হেলেনের প্রসঙ্গ আসায় সময়টা যে সত্তর দশক সেটা নিশ্চিত হয়ে যায়। মূল নাটকে হেলেনের বদলে মধুবালার উল্লেখ ছিল! এই পরিবর্তন কেন সেটা অবশ্য স্পষ্ট নয়, কারণ সময় সম্পর্কিত আর বিশেষ কোনো অনুষঙ্গ নাটকে নেই। তবে নাটকের সময়টা পুরোনো হলেও দর্শকরা তো এই সময়ের! তাই নাটকটার একটা যুগোপযোগী সম্পাদনার দরকার ছিল যেটা করেছেন নির্দেশক সৌরভ নিজেই। মূলনাটকে ওভারঅল একটা  ‘মিসোজিনিস্ট’ ব্যাপার ছিল, ট্রাক ড্রাইভারদের পুরুষ প্রধান দুনিয়ায় হয়ত সেটা খুবই বাস্তব, নির্দেশক সেটাকে কিছুটা অন্তত লঘু করার চেষ্টা করেছেন – একটি সুসজ্জিতা মহিলার অনাবশ্যক স্টেজে ঢুকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার অংশটিও বাদ গেছে। নাটকে দারোগা ও ট্রাক মালিককে সমবেত ধোলাই দেওয়ার একটা দৃশ্য আছে, কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে মঞ্চে মবলিঞ্চিং সাপোর্ট করা সম্ভব নয়, তাই ওই দৃশ্যটিকেও মিউজিক আর মাইমের সাহায্যে লঘু করে দেওয়া গেছে। তবে নাটকের চরিত্রগুলো ভীষণই একমাত্রিক – ড্রাইভারদের মধ্যে কেউ স্নায়ুর রোগে ভুগছেন, কেউ অনিদ্রারোগী, কেউ বা নায়কোচিত, কিন্তু সকলেই মানুষ হিসেবে ‘ভালো’; উল্টোদিকে ট্রাকমালিক আর শহুরে সাংবাদিকরা ‘খারাপ’এর দলে! মূল নাটকের এই সমস্যাটাকেও সম্পাদনার সময় একটু অ্যাড্রেস করতে পারলে হয়ত নাটকটা আরও সম্পূর্ণ হত।

তবে এই নাটকের একটা স্পেশালিটি হল, নাটকটা আউটরাইট পলিটিকাল নয়। মানে, প্রথম থেকেই ‘শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ’ বলে চেঁচানো হয়না। ড্রাইভাররা একে একে জড়ো হয়; দোকানদার, সেতুর গার্ড, পুলিশ, সাংবাদিক, সকলের সঙ্গে ইন্টারেকশন, গল্পগুজব চলতে থাকে – সেগুলো সবই সাধারণ সুখ-দুঃখের গল্প, বিশেষ কোনো নাটকীয় ঘটনাও ঘটে না – আর খুব ধীরে ধীরে, একেবারে প্র্যাকটিকাল সিচুয়েশন থেকে, শ্রমিক ঐক্যের প্রসঙ্গটা উঠে আসে।  এই যে মঞ্চে প্রায় ‘কিছুই ঘটছে না’, অথচ দর্শকদের মনোযোগ অটুট থাকছে, এইটাই এই নাট্য নির্মাণের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এইরকম প্রয়োগ আমরা সাধারণত সিনেমায় দেখতে অভ্যস্ত, কিন্তু মঞ্চে নয় – সেদিক থেকে নাটকটা স্বাতন্ত্র্য দাবি করতে পারে। এই সফল প্রয়োগটা সম্ভব হয়েছে বেশ জুতসই একটা মঞ্চসজ্জা, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কম্পোজিশন, এবং সেই অনুযায়ী অভিনেতাদের স্বতঃস্ফূর্ত সঞ্চলনের জন্য! মঞ্চসজ্জাটা দলের একটা সমবেত প্রয়াস, সকলে মিলে খুব সাধারণ কিছু প্রপস ব্যবহার করে মঞ্চ সাজিয়েছেন। অভিনয়ের স্টাইলও যথেষ্ট রিয়ালিস্টিক; যদিও সকলেই কৌশিক করের মত দক্ষ অভিনেতা নন, কিন্তু সকলেই তেজিয়ান, এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। বিনাবিরতিতে নাটকটা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নাটকের এই বাস্তবোচিত ভাবটা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। তবে ট্রাক এলেই নাটক থামিয়ে, মঞ্চের আলো কমিয়ে, দুটো হেডলাইটের মত আলো দর্শকদের দিকে ফেলা (আলো: সৌমেন চক্রবর্তী), এবং তার সঙ্গে ট্রাকের ইঞ্জিনের প্রচণ্ড আওয়াজ – এই প্রয়োগটা একবার দু’বার হলে ঠিক ছিল, কিন্তু বারবার ব্যবহারে নাটকের গতি তো ব্যাহত হয়ই, উপরন্তু একধরনের বিরক্তিও উৎপাদন করে। এই বিশেষ প্রয়োগটি শেষ দৃশ্যের জন্য বাঁচিয়ে রাখলে মন্দ হত না।

Khajanchibabu– Bengali literature on Bengali stage; a relief from foreign dramas and filmsতারুণ্যের আতিশয্যে নির্মাতারা কিছু প্রেজুডিসকে আক্রমণ করতে চেয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল বিখ্যাত বাউল গানের (রবীন্দ্রসংগীতেরও) সুরে তথাকথিত অশ্লীল শব্দ সম্বলিত একটি গানের সংযোজন! গানটি শুনতে যে খুব একটা খারাপ লাগে এমন নয়, তবে নাটকে একাধিক গানের প্রয়োগ নাটকের কলেবর বৃদ্ধি করেছে। আরও কয়েকটা প্রয়োগ রয়েছে যেগুলো চিন্তাভাবনা করে করা বলেই মনে হয়! যেমন একটা সংলাপে মারুতি গাড়ির উল্লেখ রয়েছে; তখন যে মারুতি গাড়ির  অস্তিত্ব ছিল না সেটা নির্মাতারা জানেন না বলে তো মনে হয় না! সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল ‘ভবানী’ চরিত্রটিকে ‘একলাখ’ বানানো, যে কিনা শেষদৃশ্যে হঠাৎ করে স্টিরিওটিপিক্যাল মুসলিম চরিত্র সেজে, একটা ফেজ টুপি মাথায় দিয়ে প্রার্থনা করতে বসে যায়! দেখে শুনে মনে হয়, নির্মাতারা এইসব ক্ষেত্রে হয়ত কতকটা ইচ্ছে করেই সমালোচনা আহ্বান করতে চেয়েছেন!

এই নাটকটা দেখতে ঢুকলে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে সেটা হল দর্শকাসনে প্রচুর সংখ্যক ইয়াং ছেলে মেয়ের উপস্থিতি, বাংলা নাটকে প্রায় বিরল একটা দৃশ্য! এই জনতাকে থিয়েটারে টেনে আনার সম্পূর্ণ কৃতিত্ত্ব ‘ইচ্ছেমতো’ গ্ৰুপ ও তার কর্ণধারদের প্রাপ্য! নাটকের একেবারে শেষ পর্যায়ে, যখন লাল পতাকা তোলা হয়, বা কাস্তে-হাতুড়ি চিহ্নটা দেখানো হয়, তখন এই ইয়াং দর্শকদের উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করার মত! কাস্তে-হাতুড়ির দৃশ্যে অবশ্য অভিনেতারা ঐ পোজে দাঁড়িয়ে থেকে দর্শকদের হাততালি দিতে প্ররোচিত করেন। এখন প্রশ্ন হল, এই নাটকের রাজনীতিটা কি দর্শকদের সত্যিই স্পর্শ করতে পারছে, নাকি তারা নাটকটিকে শুধু একটা পুরনো ক্লাসিক হিসেবেই দেখছেন, সঙ্গে গালাগাল, টুকটাক কমেডি, নাচগান, আর কৌশিক করের নায়কোচিত পারফরমেন্সের প্যাকেজটার জন্যই এই উচ্ছ্বাসটা প্রকাশ করছেন? কার্টেন কলের সময় পরিচালকের বক্তব্য থেকে কিন্তু মনে হতে পারে যে তিনি নাটকটা ক্লাসিক হিসেবেই বানিয়েছেন। ‘ঘুম নেই’ অবশ্যই একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নাটক। উৎপল দত্ত চাইতেন যে এইরকম রাজনৈতিক নাটক অভিনয় হবে শ্রমক্লান্ত মানুষের মাঝে। তার নিজের ভাষায় (জপেনদা) – “রাজনৈতিক নাটক তৈরি করে তারপর একাডেমী নামক ক্ষুদ্র প্রেক্ষাগৃহে কয়েক কুড়ি সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি-সম্পন্ন ভদ্রলোকের সামনে অভিনয় করতে থাকলে, সেটা আর রাজনৈতিক নাটক থাকে না। সেটা কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয়”। সময়ের ফেরে এই নাটকই এখন ক্ষুদ্র প্রসেনিয়াম মঞ্চে অভিনীত হচ্ছে, সাব-অল্টার্ন সংগ্রাম নিয়ে তৈরি নাটক এখন সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধির ভদ্রলোকদের এন্টারটেনমেন্টে পরিণত হয়েছে। তবুও আশা ছাড়লে চলবেনা, নবীনরা এত পরিমাণে উৎসাহ দেখাচ্ছেন, এটা সত্যিই কম কথা নয়! সৌরভ পালোধীর নির্দেশনায় পরবর্তী নাটকের অপেক্ষায় রইলাম।

Anjan Nandi
A science student, postdoctoral researcher, writer-translator of science oriented popular literature and a dedicated audience of theatre for last two decades, he has observed many changes in Bengali theatre from a very close proximity. He is a regular contributor in Bengali Wikipedia and engages himself deeply in photography and cinema.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us