বাংলা নাট্যজগতে টানা পাঁচ দশক ধরে কোনো নাট্যদলের পক্ষে সফলভাবে নাট্যপ্রযোজনা চালিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। সেই কাজটিকে বাস্তবে পরিণত করেছে ‘রঙরূপ’ নাট্যদল। পায়ে পায়ে চলতে চলতে এ বছর তারা পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল। ১৯৬৯ সালে গৌতম মুখোপাধ্যায় ও শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে যে পথ চলা শুরু হয়েছিল আজও তা অব্যাহত। অর্ধ শতাব্দী সময়কালে মোট ৩৪টি প্রযোজনার আঠারোশোর অধিক অভিনয় মঞ্চস্থ করেছে রঙরূপ। একান্নতম বর্ষে তাদের নবতম প্রযোজনা ‘গরল’। সায়ন্তনী পুততুণ্ডর ছোটগল্প থেকে নাটকটি রচনা করেছেন মৈনাক সেনগুপ্ত, সম্পাদনা ও নির্দেশনা সীমা মুখোপাধ্যায়। এই নাটক সম্প্রতি অভিনীত হল ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ একাদেমী মঞ্চে। এই রিভিউ নাটকের দ্বিতীয় অভিনয়(১৯শেঅক্টোবর গিরিশমঞ্চ) এর উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
Previous Kaahon Theatre Review:
জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী একদা সফল আইনজীবি ভাস্কর মজুমদার বর্তমানে বিশাল ভগ্নপ্রায় বাড়িতে বসবাস করে, সঙ্গে তার স্ত্রী নীলিমা, একমাত্র ছেলে বাবাই, এবং পুরোনো কাজের লোক গুপী। এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ভাস্কর এখন সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী, চলৎশক্তিহীন স্ত্রী নীলিমা তাকে নিষ্ঠা ও যত্নসহকারে দেখাশোনা করে। ছেলে বাবাই ছোটবেলা থেকেই মায়ের অত্যধিক আদর ও ভালোবাসায় কিছুটা বিপথগামী হয়ে গেছে, এখন সে প্রায় দিনই রাতে বাড়ি ফেরে না। ছেলের জন্য উৎকন্ঠা নিয়ে রাত কাটে মায়ের কিন্তু আপাত শান্ত স্বভাবের নীলিমার চোখে মুখে সেই উৎকণ্ঠার কোন ছাপ পড়ে না। এভাবেই তাদের দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন রাতে বাবাই ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে জানায় যে সে আর তার বন্ধু কমলেশ মিলে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছে এবং তাকে খুন করে ফেলেছে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় চায় মায়ের কাছে। ছেলেকে আস্বস্ত করে মা। সেদিনের পর বেশ কয়েক বছর কেটে যায় বাড়ি ফেরে না বাবাই। ছেলের প্রতীক্ষায় দিন কাটে। নাট্যপরিণতি জানার জন্য নাটকটি অবশ্যই দেখা জরুরি।
সায়ন্তনী পুততুণ্ড বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেছেন খুব বেশিদিন হয়নি, এর মধ্যেই তার সাবলীল গল্প বলার ধরণ অতি সহজেই পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। তার লেখার মধ্যে যেমন ডার্ক শেড থাকে, সাথে সাথে তার মধ্যে দিয়ে সমাজের প্রতি বিশেষ বার্তা দেবার চেষ্টা থাকে। তার ছোট গল্প গরলের কাহিনী কিছুটা সংযোজন, পরিমার্জন, ও সম্পাদনা করে মূল বার্তাটি আরো স্পষ্ট ভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছোনোর চেষ্টা করা হয়েছে, ফলে নাটকে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। খুব সাধারণ ভাবে নাটকের শুরু হয়। নাটক যত এগোতে থাকে একটা রহস্যের অনুভূতি সৃষ্টি হতে থাকে। নাট্যপরিণতিটি দর্শককে শুধু চমকিতই করে না, সাথে তাদের চেতনাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গটির কারণে নাট্য প্রযোজনাটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। নাটকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ভালোবাসা, আবেগ এই সবকিছুকে ছাপিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা বড় হয়ে ওঠে। মানবিক মূল্যবোধ সঠিক পথের দিশা পায় আর তার মধ্যে থেকেই তৈরি হয় প্রকৃত সম্পর্ক। গল্পটি নাট্যরূপ দেবার সময় নাট্যকার যে সংযোজন বা পরিবর্তন করেছেন সেগুলির মধ্যে দিয়ে নাটকটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ লাভ করছে তবে গল্পের মূল স্পিরিটটি পুরোপুরি বজায় ছিল। নির্দেশক নাট্য পরিবেশনায় বিশেষ কোন চমক না রেখে সহজ ও সরল পদ্ধতিতে নাট্যগতিকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শেষে গিয়ে কাহিনীর চমক দর্শক মনে বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করতে পেরেছে। তবে এই পরিণতিকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান হিসেবে না দেখে তার প্রতীকি প্রয়োগটি অনুধাবন করতে পারলে প্রযোজনাটি সার্থক হয়ে উঠবে।
নাটকের অভিনয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। মূলত নীলিমা (সীমা মুখোপাধ্যায়), ভাস্কর (জয়ন্ত মিত্র), এবং গুপী (জগন্নাথ চক্রবর্তী), এই তিন জনের অভিনয়ের উপর নাটকটি দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমেই বলতে হয় সীমা মুখোপাধ্যায়ের কথা। ইতিপূর্বে অনেক বিশিষ্ট চরিত্রে তার অভিনয় দক্ষতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। স্নেহপ্রবণ মা, যত্নশীল স্ত্রী, এবং সাথে সাথে দৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নারীর চমৎকার মিশেলে চরিত্রটি বাস্তব লেগেছে। একটি বিশেষ বাচনভঙ্গি ও চলাফেরার মধ্যে দিয়ে নীলিমার বার্ধক্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। অপরদিকে ভাস্কর চরিত্রটি কিছুটা একমাত্রিক হওয়ায় জয়ন্ত মিত্র অনায়াসেই শুধু বাচিক অভিনয় দ্বারাই প্রকাশ করতে পেরেছেন। জমিদার সুলভ ভাব ও শারীরিক অক্ষমতার কারণে তার অসহায়ত্ব অভিনয়ে ধরা পড়েছে। তার অভিনয় দেখতে দেখতে ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’ নাটকের রজনীনাথ চরিত্রটির কথা মনে আসছিল। গুপী চরিত্রে জগন্নাথ চক্রবর্তী বেশ পরিশ্রম করে চরিত্রটি মেলে ধরেছেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার অভিনয়ের (জখম পায়ের) ধারাবাহিকতা প্রশংসাযোগ্য। তবে ভাস্কর এবং গুপী, দু’জনের অভিনয়ের মধ্যেই নির্দেশকের অভিনয়শৈলীর প্রভাব প্রবলভাবে লক্ষ্য করা গেছে। এই ‘নির্দেশক অনুসারী’ অভিনয়ের প্রবণতা অবশ্য বাংলা রঙ্গমঞ্চের চিরকালই খুব কমন প্র্যাকটিস! কমলেশ চরিত্রটি অল্প সময়ের জন্য মঞ্চে আসে। এই চরিত্রটির দুটি ভিন্ন রূপ পৃথকভাবে অভিনয়ের মাধ্যমে অপূর্ব কুমার সাহা তার অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে এখানে একটি প্রশ্ন মনে জাগে, একজন মানুষ যার বাচনভঙ্গি মূলত রাফ, ভাষা অমার্জিত এবং উচ্চারণে ‘স’-এর টান আছে, তার পক্ষে অবলীলায় মার্জিত ভাষায় পরিশীলিত ভাবে ‘স’-এর টান অতিক্রম করে কথা বলা স্বাভাবিক কি? প্রথমাংশের অভিনয়ে পরিশীলিত ভাবটি সামান্য কমিয়ে দুটি অংশের অভিনয়ের মধ্যে সমতা আনলে হয়তো আরো বাস্তবিক লাগতো।
বিশিষ্ট প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব অরুণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনা নাটককে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। পারিপার্শ্বিক শব্দের (ambiance sound) চমৎকার ব্যবহারে কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ও কিছু নাট্যমূহুর্ত সৃষ্টি করেছেন। সঙ্গীতের প্রয়োগ নাট্যচলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়ে তার সঠিক গতি ও অভিমুখ বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। সন্দীপ সুমন ভট্টাচার্যের বাস্তবধর্মী মঞ্চ পরিকল্পনায় বিশাল ভগ্নপ্রায় পুরোনো বাড়ির অংশ সুন্দরভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। মঞ্চের একদিকে ভাস্করের ঘর এবং অন্যদিকে রান্নাঘর। মঞ্চসজ্জায় ডিটেলিংএর ব্যবহার বেশ ভালো। বাদল দাসের আলোক পরিকল্পনা সঙ্গীত ও মঞ্চকে বিশেষ সাহায্য করেছে। নাটকের মুড অনুসারে মূলত লো লাইটের ব্যবহার করা হয়েছে। নাটকে আলোক প্রক্ষেপণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মহঃ আলীর রূপসজ্জারও এই নাটকে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
রঙরূপের নাট্য প্রযোজনার তালিকায় চোখ রাখলে লক্ষ্য করা যায় যে বিষয় নির্বাচনে তারা চিন্তাশীল ভাবনার ছাপ রাখার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার কথা তুলে ধরে দর্শকদের মনে বিশেষ ভাবনা সঞ্চারে সচেষ্ট থেকেছে। বর্তমান প্রযোজনাটিও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পূর্ববর্তী সব প্রযোজনাই যে সম মানের বা সম উচ্চতা স্পর্শ করতে পেরেছে এমন নয়, তবে তাদের বেশকিছু নাটক আজও আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। নাট্য বিষয়বস্তু নির্বাচনে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা প্রশংসাযোগ্য। আশা রাখি ভবিষ্যতেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।