গত ২৭শে ডিসেম্বর গঙ্গাযমুনা নাট্য উৎসবে আকাদেমি মঞ্চে অভিনীত হল ‘কলকাতা রঙ্গিলা’ দলের নাটক ‘কুকুরের লেজ’, নির্দেশনায় কৌশিক কর। যদিও এই রিভিউ ১২ই নভেম্বর গিরিশমঞ্চের অভিনয়ের নিরিখে করা হয়েছে। নির্দেশকের বক্তব্য অনুযায়ী, বহুদিন আগে পত্রিকায় পড়া বিস্মৃতনামা দু-একটি গল্পের ছায়া থেকে তিনি নাটকটা লিখেছেন, একটি গল্পের লেখক সম্ভবত ছিলেন রমানাথ রায়।
মূল গল্পটা স্যাটায়ার ধর্মী। ঘটনার কেন্দ্রে আছেন একজন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতা। সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে নিম্নশ্রেণীর একদল লোক মৃত্যুর পরে ভূত হয়েছেন, তারা নিজেদের দুর্দশার কারণ হিসেবে নেতাদেরকেই চিহ্নিত করেন, এবং তাদের শাস্তি বিধানের পরিকল্পনা নেন। বাকি নাটকটা মূলত সেই নেতাকে নিয়ে খিল্লি! চাপের মুখে নেতা কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে বদলান? নাকি কুকুরের প্যাঁচানো লেজের মতো তিনিও শোধরানোর ঊর্ধ্বে? সেটা দর্শক হলে গিয়েই দেখবেন। এই নাটকে নাচ আছে, গান আছে, আর বিজ্ঞাপনে তো বলেই দেওয়া আছে যে নাটকে অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ আছে! তবে এই নাটকের সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হল মঞ্চের ওপর প্রায় কুড়িজন অভিনেতার অদম্য এনার্জির প্রকাশ, যা কিনা দর্শকদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়! সারা মঞ্চজুড়ে ভীষণ দ্রুত চলা ফেরা, নাচ গান, লম্ফঝম্ফ – দেখলে বোঝাই যায় যে অভিনেতারা নিজেরাই খুব আনন্দ করে, প্রায় উৎসবের মত করে, নিজেদের এই পারফরমেন্সটা উপভোগ করছেন। নাটকের ঘটনাগুলো ভীষণ রকমের দর্শক মনোগ্রাহী, রাজনৈতিক নেতার পেছনে লাথি মারতে মারতে দর্শকদের চমৎকার উইশ ফুলফিলমেন্ট হয়ে যায়। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও নাটকটা এমন কোনো নতুনত্ত্বের অভিঘাত নিয়ে আসে না যা দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে, তাই দর্শকও চুটিয়ে নাটকটা উপভোগ করতে পারেন। সমীরণের করা লাইভ সঙ্গীত, মঞ্চে প্রায় একটা অপেরার আমেজ এনে দেয় – গানের কথা, সুর, সেগুলো যথেষ্টই আকর্ষক। মোটের ওপর, বিনোদনের একটা কমপ্লিট প্যাকেজ!
Previous Kaahon Theatre Review:
এই নাটকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় নিরাভরণ একটা মঞ্চ। কস্টিউম একেবারেই বাহুল্য বর্জিত, প্রপসও সামান্য। আর প্রচুর সোর্স ব্যবহার করা হলেও লাইট স্কিমটা এমনভাবে করা যে চাইলে অতসব কিছুর সাহায্য ছাড়াও অভিনয় সম্ভব। এইধরণের ফ্লেক্সিবল ব্যবস্থাপনার জন্য এই নাটকটা প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে অভিনয়ের জন্যও যথেষ্ট উপযোগী। এই শোটা ছিল সদ্য তৃতীয়শো, আশা করা যায় অভিনেতাদের কো-অর্ডিনেশন আস্তে আস্তে আরও বাড়বে। পলাশ কর্মকার অভিনীত নেতার সহকারী চরিত্রটা তোতলা, কিন্তু তিনি একেকটা দৃশ্যে একেক রকম ভাবে তোতলান ! ভূতেদের মধ্যে কেবল একটা চরিত্রই ‘শিক্ষিত’, বাকিরা হয় ‘দোখনো’ নয় ‘বাঙাল’! গম্ভীরা ভট্টাচার্য এই সময়ের একজন শক্তিশালী অভিনেতা, কিন্তু এইরকম স্টিরিওটাইপ চরিত্রে তার বিশেষ কিছু করার ছিল না। দর্শকদের কিছু রাজনৈতিক জ্ঞান দানের উদ্দেশ্যে ভূতেদের মধ্যে একটা বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়েছিল, ঐ অংশে দর্শকদের চটাচট হাত তালি দেখে বোঝা গেল যে তারা প্রপার নাট্যমুহূর্তের তুলনায় এইধরণের ভাষণ শুনতেই বেশি আগ্রহী! গালাগালির ফোয়ারা, বা প্যান্ট খুলে জাঙ্গিয়া প্রদর্শন – এগুলো অবশ্যই একধরণের প্রতিবাদ, কিন্তু সবমিলিয়ে দর্শকের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়াটা ইভোক করছে সেটা হল – ‘ওহ গুরু কি দিলো! ডান বাম সবার একেবারে প্যান্টালুন খুলে নিয়েছে!’
এটা অনস্বীকার্য যে বাংলা নাটক দর্শক স্বল্পতায় ভুগছে, যারা একটা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত তারাই আবার অন্য একটা গ্রুপের নাটক দেখতে যান! নতুন প্রজন্মকে দর্শকাসনে কিভাবে টেনে আনা যায় সেই নিয়ে সকলেই নিজের নিজের মতো করে চেষ্টা করে চলেছেন। এই নাটক দেখতে গিয়েও যেমন চোখে পড়ে দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের একটা প্রাণপণ চেষ্টা! নাটক শুরুর আগে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকলে দেখতে পাওয়া যায় যে মঞ্চের পর্দা তোলা, অভিনেতারা মঞ্চের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর পরিচিত দর্শকদের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা বলছেন। তারপর শুরু হয় দর্শকদের উদ্দেশ্য করে নির্দেশকের ভাষণ ! প্রসঙ্গত, নির্দেশক কৌশিক কর তার নির্দেশিত প্রায় প্রতিটি নাটকের শুরুতেই কম্পিত কণ্ঠে একটি করে নাতিদীর্ঘ লেকচার দিয়ে থাকেন – নাটকটা কী নিয়ে, কেন করছেন, কী তার প্রত্যাশা, কেন এত অশ্লীল শব্দ – সব মিলিয়ে নাটকের একটা চলন্ত ‘মেডইজি’। এবারে তার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা গেল নাটকের শেষের এক্সটেন্ডেড লেকচারে। ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা ভয়ে ভয়ে তার দিন কাটে, বা তাকে কতদিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে, এরকম নানান তথ্য দর্শকরা হয়তো জেনে গেলেন !এসব নার্সিসিজমের বদলে যদি এমন একটা নাটক প্রযোজনা করা যেত যেটা দেখে দর্শক সত্যি সত্যি বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতেন, তাহলে আর দর্শককে ডেকে ডেকে ‘আপনার ভয় লাগেনা?’ জাতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হত না! প্রসঙ্গত, নাটকে নেতার চরিত্রে অভিনয়ের সময় কৌশিক যতটাই শক্তিশালী ও স্বতঃস্ফূর্ত, নাটকের বাইরের এই ভাষণগুলোর সময় ভাবাবেগ প্রকাশের দিক থেকে ততটাই দুর্বল এবং মেকি!
এইরকম বিদ্রুপাত্মক একটা নাটক তখনই এফেক্টিভ হয়ে উঠতে পারে যদি দর্শকরা নাটকের মধ্যে নিজেদের দেখতে পান, বুঝতে পারেন যে হাস্যরসের লক্ষ্যবস্তু তারা নিজেরাই ! কুকুরের লেজ নাটকটা যথেষ্ট জন মনোরঞ্জক হওয়া সত্ত্বেও, এই বিশেষ দিকটির সাপেক্ষে পুরোপুরি ব্যর্থ। এর কারণ হয়ত নিহিত আছে নাটকের ঘটনাবলীর মধ্যে। এই ধরণের ঘটনা নিয়ে নাটক সত্তর আশির দশকে ব্যাপক পরিমাণে দেখা যেত, সম্ভবত স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে একটা স্বর্ণযুগ আসার স্বপ্ন দেখা মানুষের আশাভঙ্গের প্রতিক্রিয়া হিসেবে! বর্তমান সময়টাও আশাভঙ্গের সময়, উদার অর্থনীতি মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি! কিন্তু এই আশাভঙ্গের স্বরূপটাকে দেখতে হবে আজকের যুগের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে! তবেই তারা নাটকের সঙ্গে একাত্মবোধ করবেন, শুধুমাত্র মজার নাটক হিসেবে দেখে আমোদিত হয়ে বাড়ি চলে যাবেন না।
আর বাংলার নাট্যমোদী দর্শক বন্ধুরা – আপনারা যদি প্রতিটা গালাগালিতে হাসতে থাকেন, প্রতিটা চটুল ডায়লগে, আর প্রতিটা ফিল্মি নায়কোচিত কাণ্ডকারখানায় বাহবা জানাতে থাকেন, তাহলে নির্মাতারা ধরেই নেবেন যে আপনারা কেবল ঐগুলোই চান! তারপর তারা কোনো সত্যিকারের গভীর, মননশীল নাটক নির্মাণে নিজেদের মোটিভেট করবেন কি করে?