নাটকের ক্ষেত্রে টেক্সট এডিটিং এমন একটা বিষয় যা কখনও কখনও একটা ভালো নাটককে খারাপ করে দিতে পারে, আবার কখনও একটা বেশ খারাপ নাটককে ভালোভাবে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে মঞ্চে। একজন বুদ্ধিমান ডিরেক্টর খুব সহজেই বুঝতে পারেন একটা টেক্সটের কোন অংশটুকু দর্শকের ভালো লাগবে, কোন অংশটা ততটা ইন্টারেস্টিং নয়, কোন অংশটা খানিকটা বদলে যুগোপযোগী করা দরকার আর কোন অংশটা বাদ দিয়ে দিলে নাটকের ফ্লেভারটাই চলে যাবে। আজকাল বাজারে যখন অরিজিনাল নাটক প্রায় হচ্ছেই না, পুরনো, বিখ্যাত, বহুচর্চিত বহুঅভিনীত নাটক গুলোকেই কোনোমতে উপস্থাপিত করা হচ্ছে, তখন যেকোনো ডিরেক্টরের এই টেক্সট এডিটিং বিষয়টা নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকা উচিৎ।
যুগে যুগে সময়ের দাবী অনুযায়ী নাটকের ধরণ বদলেছে, বদলেছে বক্তব্য প্রকাশের ধরণও। ক্লাসিক নাটকে তো বটেই, মাত্র ৬০-৭০ বছর আগেও নাটক দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে অনেক বড় হত (বোধয় উচ্চতায়ও)। চরিত্রের সংখ্যাও হত আজকের চেয়ে বেশী। ইমোশানাল কমপ্লেক্সিটির ব্যাপ্তি এবং বক্তব্যের বিস্তারিত প্রকাশ – এগুলো ছিল নাট্যকারদের পছন্দের বৈশিষ্ট্য। এখনকার দর্শকের হাতে তো আর অত সময় নেই, তাছাড়া ধৈর্য ধরে অনেকক্ষণ বসে কিছু একটা দেখতে পারার অভ্যাসও চলে গেছে। ডিরেক্টরের হাতে এখন আর অত অভিনেতা নেই, সব অভিনেতার একসঙ্গে ডেট ফাঁকা নেই এবং সর্বোপরি বিস্তারিত ইমোশনাল কমপ্লেক্সিটি এখন ‘বোরিং’ বলে বিবেচ্য। সুতরাং অরিজিনাল নাটক লিখিয়ের কন্ট্যাক্ট নাজানা ডিরেক্টরকে যেটা করতে জানতেই হয়, সেটা হল – টেক্সট এডিটিং!
Previous Kaahon Theatre Review:
দানী কর্মকারের নির্দেশনায় রবীন্দ্রনগর নাট্যায়ুধের নবতম নাটক কবীরা দেখতে গিয়ে উপরোক্ত উপলব্ধি হারে হারে টের পাওয়া গেল। গত ৩রা জানুয়ারী অজিতেশ মঞ্চে নাটকটি অভিনীত হল। কবীরা নাটকটি হিন্দি ভাষার প্রখ্যাত নাট্যকার ভীষ্ম সাহানির “কবীরা খরা বাজারমে” (১৯৮১) থেকে নেওয়া। নেওয়া মানে ডিরেক্টর আসল টেক্সটটাকে প্রয়োজন মত এডিট করে নাটকটা দাঁড় করিয়েছেন। নাটকটা পঞ্চদশ শতাব্দীর সাধক, কাব্য রচয়িতা এবং ভারতবর্ষের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম মুখ সন্ত কবীরের জীবনীমূলক। এই নাটকটা সম্পর্কে একমাত্র যে সঠিক সিদ্ধান্তটি ডিরেক্টর নিয়েছেন, তা হল নাটকটির বঙ্গানুবাদ অথবা সমসাময়িক করে তোলার চেষ্টা না করা (ভালো অ্যাডাপ্টেশন করতে পারেন এমন লেখকও বিরল)। কিন্তু মূল নাটকটা তো অনেকক্ষণের… তাই এডিটিং-টা তাকে করতেই হয়েছে। আর এই কাণ্ডটি করতে গিয়ে নির্দেশক একেবারে ভুলে গেছেন যে কোন মতে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে-কনফ্লিক্টের স্টোরি লাইনটুকু মেন্টেইন করলেই নাটক সফলভাবে মঞ্চস্থ করা যায় না।
কবীরের জীবনকাহিনী, তাঁর ভাবধারা, তাঁর জীবনবোধ খুবই অন্যরকমের। মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি হিন্দুধর্মের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর দোঁহাগুলি শিখ ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবেও পাওয়া যায়। বস্তুত ধর্মভেদ, জাতিভেদ এর ঊর্ধ্বে উঠে একপরম মানবতাবাদের কথা শুনিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, তাই তাঁর রচিত দোঁহাগুলি আজও সমানভাবে বিখ্যাত। কিন্তু ধর্ম তো বরাবরই রাজনীতির পরমপ্রিয় বিষয়। বিশেষত যেই সময়ে হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণেরা মনের আনন্দে বর্ণের জোরে সুবিধা ভোগী হয়ে রয়েছেন এবং মুসলিম সমাজ গৌরবান্বিত হয়ে দাড়ি চোমরাচ্ছেন নিজেদের পবিত্র আচরণ বিধি নিয়ে, সেই সময় যদি কোন জন্ম পরিচয়হীন, নিচু মুসলমান বংশে পালিত গরীব তাঁতির ছেলে বলতে শুরু করে ধর্মটর্ম কিছু না, মানুষ যদি মানুষেরই পাশে না দাঁড়াল, তাহলে এসব জাতিধর্ম করে কিই বা হবে? এবং সে যদি ক্রমশ পপুলার হতে শুরু করে, তাহলে দুই সমাজের সুবিধেভোগীদের আত্মমর্যাদায় লাগে বৈকি! অগত্যা যা হওয়ার হয়, কবীরের উপরে নেমে আসে রাজ-রোষ ! মন্দির মসজিদ উভয়পক্ষেরই মনে হয় – এই লোকটাকে সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন।
বুঝতেই পারছেন এই নাটকটা কেন আজও সময়োপযোগী। আসলে ভালো টেক্সটের মজাই এইটা। এমনকিছু এলিমেন্ট নিয়ে তৈরি হয় একটা ভালো নাটক যা সমকালের সীমা ছাড়িয়ে ভবিষ্যতেও সমান প্রাসঙ্গিক থাকে। কিন্তু ডিরেক্টর মশাই এই পুরোব্যাপারটাকে কবীরের জন্মমৃত্যু বিবাহ আর একটুখানি কনফ্লিক্টের মধ্যে আটকে ফেলেছেন। তাই না ফুটে উঠতে পেরেছে টেক্সটটির যথার্থ প্রাসঙ্গিকতা, না জায়গা পেয়েছেন চরিত্ররা অভিনয় করার। একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে তো একজন অভিনেতার ঠিকঠাক কিছু ডায়ালগ সমেত মঞ্চের উপরে কিছুটা সময় দিতে লাগে। এখানে কোন অভিনেতাই কিছু করবার স্কোপ পাননি। নাটকটা প্রায় শুরু হতে হতেই শেষ হয়ে গেছে। অথচ নাম ভূমিকায় শম্ভুনাথ শাউকে সম্ভবনাময় বলেই মনে হচ্ছিল। তার উপর বাংলা ভাষায় স্বচ্ছন্দ অভিনেতারা হিন্দিতে কথা বলতে গিয়ে সেটা নিয়েই এতবেশী বিব্রত হয়েছিলেন যে যেটুকু সময় তাঁদের মঞ্চে পাওয়া গেল, সেটুকুতেও তাঁরা তটস্থ হয়ে রইলেন (রিহার্সাল দেওয়ার সময় এখন এতকম… অভিনেতাদের পেটের ভাত জোগাড় করতেই পাগলের মত খাটতে হয় এদিক ওদিক)।
মঞ্চ আলো আবহ নিয়ে কিছু বলবার নেই, কেউই কিছু করতে চাননি, অথবা ডিরেক্টরই হয়ত তাঁদেরকে বুঝিয়ে উঠতে পারেননি তাঁর আসলে কী চাই। ফলতঃ দর্শকাসনের মানুষজন ক্রমশ বিরক্ত হয়েছেন এবং মঞ্চের উপরের মানুষগুলোর হাত থেকে নিষ্কৃতি চেয়েছেন। দু-একজন বোধ হয় শব্দ না করে বলছিলেনও “এরকম নাটক করার কি দরকার?”
হয়ত এত কঠিন কথায় কড়া রিভিউ না করলেও চলত, কিন্তু বাংলা থিয়েটারে বিলো-স্ট্যান্ডার্ড কাজ এত বেড়ে যাচ্ছে, যে স্পষ্ট কথায় না বলে আর পারা যাচ্ছেনা। আমাদের জানানেই আজ থেকে ২০–৩০ বছর পরেও নতুন লেখা নিয়ে নাটক করার ট্রেন্ড শুরু হবে কিনা, অধিকাংশ ডিরেক্টারই আজকের মত নিজের শৌর্যে নিজেই মুগ্ধ হয়েই থাকবেন কিনা, সর্বোপরি বছরে ৩টে নাটক না নামালে মান যাবে, গ্রান্ট আসবে না এবং আমি কিছু করতে পারিনা তাই নাটক করি – এই চিত্রটি বদলাবে কিনা। ততদিন পর্যন্ত যে যেখানে যত খারাপ নাটক দেখতে পাচ্ছেন, সেই দলকে, সেই নির্দেশককে একটু রেস্ট নিতে, একটু অন্যের কাজ দেখতে অনুরোধ করুন, অনেক অনেক নাটক দেখুন, ভালো নাটকের সঙ্গে থাকুন, সৎ প্রচেষ্টা অসৎ প্রচেষ্টা এবং খারাপ ভালোর পার্থক্যটা বুঝতে শেখা এবং জানাতে শেখাটা দর্শক হিসেবে আপনারও কর্তব্য।