মাচার মানুষ আয়োজিত থিয়েটার পার্বণ এর তৃতীয় পর্বে গত ১৫ই সেপ্টেম্বর তপন থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল ‘সংস্তব’ এর নবতম প্রযোজনা ‘অনাহুত’। নাটক স্নেহাশিস ভট্টাচার্য। নির্দেশনা সীমা মুখোপাধ্যায়। সংস্তব বললেই যে নামটি মনের কোনে সহজেই উঁকি দেয় সেটি হল দ্বিজেন বন্দোপাধ্যায়। সংস্তব এবং দ্বিজেন বন্দোপাধ্যায় পরস্পর এমন ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে যে আমরা আজও পৃথক ভাবে চিন্তা করতে পারি না, তাই সংস্তবের নাটক দেখতে এসে তাঁর কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে আর তাঁর অভাব ভীষণভাবে অনুভূত হয়। আনন্দ ও আশার কথা এই যে সংস্তবের বর্তমান সদস্যরা সুষ্ঠু ভাবে প্রযোজনার ধারাকে সচল রাখতে সচেষ্ট রয়েছেন।
Previous Kaahon Theatre Review:
অনাহুত নাটকের আখ্যানের মূলবিষয়টি বহু গল্প-উপন্যাস, নাটক-চলচ্চিত্রে আমার বারবার দেখতে পেয়েছি। অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার নিরুপম গোস্বামী বর্তমানে একজন সফল ব্যবসায়ী। স্ত্রী সুজাতা আর একমাত্র সন্তান দেবোপমকে নিয়ে তার সুখের সংসার। সেই সুখের সংসারে একদিন হঠাৎ করেই ঝড়ের মতো হাজির হয় এক আগন্তুক। মুহূর্তেও লোট পালোট হয়ে যায় সবকিছু। নিরুপম সুজাতার সাজানো সংসারে নেমে আসে এক বিপর্যয় কারণ আগন্তুক লোকটি দাবি করে যে সেই আসলে নিরুপম এই বাড়ির কর্তা অথাৎ সুজাতার স্ত্রী আর বর্তমান কর্তা একজন ঠগতার প্রকৃত নাম মৈনাক। আগন্তুক জানায় কার্গিল যুদ্ধে দ্রাসসেক্টরে ২৩৭ ব্যাটেলিয়নের মেজর হিসেবে লড়াই করেছিল সে আর নিরুপমরূপী মৈনাক তারই অধীনে সেই ব্যাটেলিয়নের সদস্য ছিল। আগন্তুকই যে আসলে নিরুপম তার স্বপক্ষে নানা যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করতে থাকে। পুলিশ ডাকা হয়। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা নির্ধারণের জন্য ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু আদালত কি সর্বদা পারে সত্য-মিথ্যার সঠিক মীমাংসা করতে? আদালতের রায়ের পরিধি পেরিয়ে সত্য যে আরো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত! আসলে সব সত্যের ভিতরে আরো একটা সত্য বাস করে। অনেক সময় আমরা শুধুমাত্র বাইরের সত্যটা দেখতে পাই বা দেখাতে চাই আর ভিতরের সত্যটা অপ্রকাশিত থেকে যায়।বুঝি বা অন্তরের সেই অনাহুত সত্যটাই ‘প্রকৃত সত্য’! এখানে সুজাতা (স্ত্রী) জানে আসল সত্যিটা কী এবং আগন্তুকের কাছে একান্তে কবুল করে ফেলে সে। সুজাতার এই সত্যিটা মেনে নেওয়ার মধ্যেই আগন্তুক নিজের জয় খুঁজে পায়।
নাট্যকার যেভাবে নাটকটি গড়ে তুলেছেন তাতে শুরুতে একটা সাসপেন্স তৈরি হয়। বাড়ির পরিচারিকা মেনকা এবং ড্রাইভার যুধিষ্ঠিরের রোমান্টিক আলাপচারিতার মধ্যে হঠাৎ করে আগন্তুকের আবির্ভাবে হাস্যকর মিশ্রিত রোমাঞ্চের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা ক্রমশ সাধারণ ক্রাইমথ্রিলারের আকার নেয়। ক্রাইমথ্রিলারের নিয়ম মেনেই ক্রমশ রহস্যের জট খুলতে থাকে।তবে রহস্য উন্মোচনের পরিণতির একটা আভাস প্রথম থেকেই পাওয়া যায় (কারণ হিসেবে মনে হয় এধরনের কাহিনীর বহুপাঠ ও দর্শনের ফল) এবং সেই কাঙ্খিত পরিণতিতেই নাটক শেষ হয়, ফলে নাটক যত এগোয় টানটান ভাবটা ক্রমশ হ্রাস পায়।প্রথমার্ধের চেয়ে দ্বিতীয়ার্ধটা বেশ দুর্বল লাগে। মক্কেলের অনুপস্থিতিতে তারই বাড়িতে বসে বাদীও বিবাদীপক্ষের উকিল দ্বয়ের দীর্ঘ আলাপচারিতার দৃশ্যটি নাট্যগঠনের প্রেক্ষিতে তাৎপর্যহীন এবং নাট্য চলনের স্বাভাবিকগতিকে ব্যাহত করে। শুধুমাত্র কিছু আদর্শের বাণী আর প্রচ্ছন্ন কিছু রাজনৈতিক কথাবার্তা দর্শকদের মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যই দৃশ্যটির অবতারণা বলে মনে হয়। নাট্যকাহিনীর মধ্যে কিছু অবাস্তবতা লক্ষ্য করা যায় (যা কোন বাণিজ্যিক সিনেমা দেখার সময় আমরা taken for granted করেনি), যেগুলিকে নির্দেশক পরিচালন দক্ষতায় নিবারণ করবার চেষ্টা করেছেন বটে তবে সম্পূর্ণরূপে সার্থক হয়েছেন বলে মনে হয় না।তবু একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে সাধারণভাবে দর্শকদের কাছে নাটকটি উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
সঞ্জীব সরকার বর্তমান সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় অভিনেতা। মঞ্চ, ছোট পর্দা, বড়পর্দা সর্বত্রই তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি নিজে তার অভিনয়ের একটি শৈলী তৈরি করেছেন যা কিছুটা উচ্চকিত এবং প্রকাশে সামান্য অতিরঞ্জিত (যা কখনই overacting নয়)। সংশ্লিষ্ট চরিত্রকে তিনি তার শৈলীর মধ্যে সুন্দরভাবে ফিট্ করে ফেলেন। এ নাটকে আগন্তুকের চরিত্র অভিনয়ের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে এই ধরনের চর্চায় পৌনঃপুনিকতার সম্ভবনা থেকেই যায়। সুজাতার চরিত্রে অমৃতা মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় ভালো লাগে। দ্বিস্তরীয় চরিত্রটি মঞ্চে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। আগন্তুকের সাথে একান্তে সাক্ষাতের দৃশ্যে তার অভিনয় দক্ষতার ঝলক লক্ষ্য করা যায়। যুধিষ্ঠির চরিত্রে পার্থসারথী চন্দ্রের কমেডি অভিনয়, বাচিকও শারীরিকভাবে বেশ সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত। কঙ্কাবতী বন্দোপাধ্যায়ের কাছে মেণকা চরিত্রটি অভিনয়ের যতটুকু সুযোগ ছিল তা তিনি সঠিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন।
সন্দীপ সুমন ভট্টাচার্যের বাস্তবধর্মী (realistic) মঞ্চ বেশ ভালো লাগে। একদিকে আসবাবপত্র ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে মঞ্চটি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে আবার সাথে সাথে অভিনয়ের পর্যাপ্ত স্থান ও রাখা হয়েছে। এরকম উপযোগী মঞ্চ স্বচ্ছন্দ অভিনয়ের গতিকে সচল রাখে।তবে বুক সেল্ফে বইএর বদলে বইএর কাট আউট রাখা খুব দৃষ্টিকটু লাগে বিশেষভাবে এরকম বাস্তব ধর্মী মঞ্চ ভাবনায়! বাদল দাসের আলোক পরিকল্পনায় আলো আঁধারি উপস্থাপন নাট্যগতিকে সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করেছে। দিশারী চক্রবর্তীর আবহেনীরবতা, শব্দও সুরের সঠিক মিশ্রণ এবং পরিমিতি বোধনাটকের মূলভাবকে ব্যক্ত করতে পেরেছে। মহঃআলী ও সঞ্জয় পালের রূপসজ্জা এবং সুমিতা বন্দোপাধ্যায়ের পোশাক পরিকল্পনা চরিত্রগুলিকে মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছে।
বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি যখন নির্দিষ্ট প্রামাণ্য দলিলের মাধ্যমে মানুষের পরিচয়কে নির্ধারিত করতে চাইছে এবং তার ফলে ব্যক্তিসত্তা আজ অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন, সেই সময়ে এইধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে নাট্যপ্রযোজনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আশা রাখি সংস্তব নাট্যদল তাদের সুষ্ঠু নাট্যউপস্থাপনার ধারাকে সচল রাখবে এবং ভবিষ্যতে আমরা আরো উন্নতমানের প্রযোজনা উপহার পাবো।