যারা ক্ষমতায় রয়েছে, যারা প্রিভিলেজড, তারা সবসময়ই যাদের উপর ক্ষমতা ফলায় তাদের একরকম করে ভাবতে শেখায়, ইতিহাসকে, বর্তমানকে আর ভবিষ্যৎকেও। তারা সর্বত্র জানান দিতে চায় তাদের ক্ষমতায় থাকাটা কতটা জাস্টিফায়েড, তারা উচ্চাসনে থাকাটা কতটা ডিসার্ভ করে আর তারা নীচের মানুষগুলোকে কিভাবে মোটেই নীচের মানুষ বলে মনে করে না। মনে করে বন্ধু, অ্যালাই। আর বলতে চায় তারা সারাক্ষণ নীচের দিকের লোকগুলোকে প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কায়িক শ্রমজীবী, আদিবাসী ও মেয়েদের মত প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষদের প্রতি সমাজের পজিশনখানা একটু তলিয়ে ভাবলেই এই ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট করে বোঝা যাবে। কিন্তু আরও যদি একটু তলিয়ে ভাবি তাহলে কেমন এই দেখানোটার ইন্টেনশন নিয়ে একটা প্রশ্ন ওঠে। তাই না? যদি সত্যি ক্ষমতা ডিসার্ভ কর তাহলে আর এত ঢাক পিটিয়ে জাহির করা কিসের? আর যদি বন্ধুই মনে কর তাহলে সমান সমান সুযোগ পাওয়া যাবে না কেন? বস্তুত আর একটু স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকলেই মনে হতে শুরু করে, উহাদের আসল বক্তব্যটি হইল, আমাদের উত্তম থাকিতে গেলে তোমাদিগকে সুচিত্রা (সরি, অধম) হইতেই হবে।
এইসবের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকে যে দেখা, যে দেখা তাদের তৈরি “নীচ” থেকে তাদের তৈরি “উপরের” দিকে, তাই হল কাউন্টার ন্যারেটিভ। এই ন্যারেটিভ সবসময় কাউন্টার করে, উচ্চাসনে আসীনদের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে ন্যারেট করে ওঠে এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আখ্যান। কথা বলে আন্ডারডগদের জন্য আর দাগিয়ে দেয়, কিভাবে যারা ক্ষমতার স্তরে উপরের দিকে রয়েছে তারা অবহেলিত, মারজিনালাইসডদের “…ফ্লাইস টু ওয়ান্টন বয়েস…” এর মত ট্রিট করে এসেছে নিজের পজিশনটি বজায় রাখার সুবিধার্থে এবং কিভাবে তারাই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে – “শোন, তোরা হলি নিচু, আর আমরা হলাম উঁচু”।
Previous Kaahon Theatre Review:
সমূহ প্রযোজিত ‘অথ হিড়িম্বা কথা’ এইরকমই একটি চোখে আঙ্গুল দেওয়া কাউন্টার ন্যারেটিভ, নাটকের আগে দেওয়া নোটের বক্তব্য অনুযায়ী “পরাজিতের জবানবন্দী”। লেখক নির্দেশক তিতাস দত্ত কাউন্টার ন্যারেটিভের বিষয় নির্বাচনে “হিড়িম্বা”কে বেছে নিয়ে একই সঙ্গে ক্লাস, জেন্ডার এবং কালচার নিয়ে কথা বলার একটা দুর্ধর্ষ সুযোগ তৈরি করেছেন যা তাঁর ম্যাচিওরিটির একটা বড় প্রমাণ। ম্যাচিওরিটি শব্দটা ব্যবহার করতে ভীষণ ইচ্ছে হল কারণ তিনি বয়সে নবীন, তাঁর দলও তাই, তাও তাঁদের কাজের মধ্যে সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত ভাবে নির্দিষ্ট অভিমুখে যাওয়ার একটা জব্বর তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। মঞ্চে নির্দেশকের সঙ্গে যাঁরা পারফর্ম করলেন সেই শতাক্ষী, নবদীপা, মধুরিমা, অতসী, সুতপা, অন্তরা, গার্গী, লাবন্য, শ্রীতমারা এক একজন দারুণ পারফর্মার। পারফর্মার হিসেবে কারুর কারুর হয়ত অভিনয় কেন্দ্রিক, শারীরিক বা ভোকাল কিছু খামতি রয়েছে, কিন্তু সেসব তাঁরা এনার্জি আর ওই তাগিদ দিয়েই পূরণ করে দিতে পেরেছেন। মঞ্চে যারা ছিলেন না, কিন্তু নেপথ্যে ছিলেন, সেই পামেলা, শাওন, নিশান্ত, দ্বৈপায়ন, সুদক্ষিণা, মোম, সৌরমি, রেশমি, মধ্যমা, পাঞ্চালী, শ্রেয়সী, ঈপ্সিতা, সুরম্য এবং নির্নিমেষ-এর শ্রমটুকুও সারাক্ষণ মঞ্চে ধরা পড়ে। বলতে বাধা নেই, বেশীরভাগ অভিজ্ঞ নাট্যকার ও নির্দেশকের দিশাহীন “আমাকে দেখুন” ধরণের পদচারণার মধ্যে এই তাগিদের অভাব ভীষণভাবে লক্ষণীয়। প্রসঙ্গত মিনার্ভা রেপার্টারির অভিনেতাদের নিজেদের তৈরি কাজ “পাঁচ কড়ির গপ্পোতেও” এই ম্যাচিউরিটির অভাব বেশ মন খারাপ করায়। অথ হিড়িম্বা কথার সবচেয়ে বড় জোর সম্ভবত এই নাটকের সৎ তাগিদটুকুই ।
হিড়িম্বার গল্প তো আপনারা সবাই জানেন। সেসব আর কি বলব? তার কাউন্টার ন্যারেটিভটা সমূহের সবাই মিলে ভীষণ মজাদার অথচ ততোধিক সিরিয়াসলি এবং ডেডিকেটেডলি ডিজাইন এবং পারফর্ম করেছেন। রিভিউ পড়ে তার স্বাদ পাওয়া মুশকিল হবে মশাই, যান চট করে পরের শো টা দেখে নিন। কন্টেন্ট এবং ফর্মে হিড়িম্বা এত জোরদার যে টানা প্রায় দু ঘণ্টা ধরে আপনার সারাক্ষণ মনে হতে থাকবে- তাই? এরপর কি হল? বহুদিন বাদে বাংলা থিয়েটারে একটা বেশ কাজের মত কাজ দেখতে পেয়ে মনটা ভারি খুশি হয়ে রয়েছে।
কিন্তু…
আন্ডারডগদের আখ্যান নির্মাণ করতে গিয়ে কি কোথাও তাদের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হয়ে পড়লেন সমূহরা? ‘প্রচলিত ভালো’রা যাদের ‘মন্দ’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তাদের কথা বলতে গিয়ে কি তাদের একটু ‘প্রচলিত ভালো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন? প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়। আসলে, নাটকে একটা দৃশ্য যোগ করা হয়েছে যা মহাভারতে নেই। সেই দৃশ্যে হিড়িম্বা, ভীম, ঘটোৎকচের কথোপকথন চলে। পাণ্ডবরা ততক্ষণে হিড়িম্বা ও তাঁর গোষ্ঠীকে ইমোশনালি, সোশ্যালি, পলিটিকালি যারপরনাই এক্সপ্লয়েট করে ফেলেছে, ভীম নিজেও এসেছে আরও খানিক বড় বড় কথা বলে ক্ষমতা জাহির করতে। হিড়িম্বাও ততক্ষণে জেনে গেছেন পাণ্ডবদের অভিসন্ধি। হাতে তীর ধনুক এবং কল্পনার অনুকূল আশ্রয় থাকা সত্বেও ভীমকে হত্যা করেন না তিনি। কেন? মূলত ৩ টি সম্ভাব্য যুক্তি মাথায় আসে।
১। তাঁর কি জীবন দান করার দায় আছে? তিনি তো একথা জানেন যে পাণ্ডবরা বেঁচে থাকা মানেই তাঁদের গোষ্ঠীর মানুষ, তাঁদের জঙ্গল, তাঁদের কেপেবিলিটিকে সারাক্ষণ এক্সপ্লয়েট করে যাবে।
২। তাঁর কি স্বামী হত্যা না করার দায় আছে? তিনি তো একথা জানেন যে ভীম তাঁকে স্ত্রী মনে করেন না এবং কখনোই ঘটোৎকচকে রাজপুত্রের অধিকার দেবেন না।
৩। তাঁর কি অস্ত্রহীনকে হত্যা না করার দায় আছে? একথা জানা সত্বেও যে পাণ্ডবদের আসল অস্ত্র তাদের রাজনীতি এবং সময় বিশেষে তাঁদের কুরবান করার আগে পাণ্ডবরা এক মুহূর্তও ভাববে না।
এই প্রশ্নগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে আসে কারণ হিড়িম্বা ও তাঁর গোষ্ঠীকে শুরু থেকে শেষ অবধি আত্মাভিমানী, স্বনির্ভরশীল এবং সর্বোপরি প্রাগম্যাটিক হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেইখানে দাঁড়িয়ে হিড়িম্বা কেন চলতি সিনেমার “ভালো” হিরোর মত ভিলেন কে ছেড়ে দেবেন? সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কি স্বাভাবিক ছিল না এটাই যে হিড়িম্বা তাঁর এবং তাঁর পরবর্তী সমস্ত প্রজন্মের আপদ বিদায়ের কথা ভাববেন? হয়ত এই চয়েসটা পরিচালকের পক্ষে করা খুব কঠিন ছিল, কারণ মিসকমিউনিকেশন ও মিসইন্টারপ্রিটেশন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল একশ ভাগ।
এর সাথেই বলতে হয় হিড়িম্বার ও তাঁর গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি মানুষ ভীষণ ভীষণ ভালো। তাঁদের কোন কোরাপশন নেই, নিজেদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই, কোন কূট-ছল প্রভৃতি বিকার নেই। এমনকি কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। এইরম কি হওয়া সম্ভব? বড্ড বেশী প্রচলিত ভালোর মত হয়ে যাচ্ছে না? কাউন্টার ন্যারেটিভের ভালোরা প্রচলিত ভালোর ধারণায় পড়ে যেতে চাইলে বড্ড আশাহত লাগে। সমূহ এবং নির্দেশকের কাছে অনুরোধ থাকল… আমাদের এই হতাশার কথা যেন তাঁরা ভাবেন।
নাটকে মিউজিকের ব্যবহারও ইচ্ছাকৃতভাবেই উল্টোপাল্টা করে রাখা হয়েছে। সুরেলা স্কেল মেইন্টেইন করা গান, নিয়ন্ত্রিত তাল বাদ্য, সুন্দর শারীরিক ভঙ্গী… এসবও কালচারের ক্ষমতায় থাকাদের তৈরি করা ন্যারেটিভ। তার বেশ একটা লাইভ কাউন্টার প্রয়োগ হয়েছে তবে তা কখনোই বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি, উল্টে পারফর্মেন্সটিকে দারুণ কমপ্লিমেন্ট করেছে। আলো ডিজাইন করেছেন উৎসর্জনা মুৎসুদ্দি। যতটা সম্ভব মিনিমালই রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি, যদিও ছায়ার একটা ব্যাপক ব্যবহার হওয়ার সম্ভবনা ছিল। সেইটাকে একটু এক্সপ্লোর করে দেখবেন সমূহজনেরা? তাহলে দারুণ ভালো একটা নাটক আরও আরও দারুণ হয়ে উঠবে আর আমরা আবারও সব্বাইকে গলা ফাটিয়ে বলব… রিভিউ পড়ে হবে না… নাটকটা গিয়ে দেখে আসুন।
*এই রিভিউ ২৮শে ডিসেম্বর ২০১৯, EZCC-তে অভিনীত শো এর ভিত্তিতে করা।