১৯৭২ সালে বিখ্যাত মারাঠি নাট্যকার বিজয় তেন্দুলকার তাঁর নাটক ‘সখারাম বাইন্ডার’-এ কয়েকটি জোরালো প্রশ্ন তোলেন ভারতবর্ষের সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের অন্ধকার দিককে আক্রমণ করে। প্রশ্ন তোলেন ভারতীয় সমাজের এমন কতগুলো ভণ্ডামির বিষয় নিয়ে যার ফলস্বরূপ ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত নাটকটি নিষিদ্ধ থাকে রাষ্ট্রের আদেশে। তারপর বয়ে গেছে অনেক বাতাস ভারতবর্ষের মাটির উপর দিয়ে, ভেসে গেছে অনেক জল বিভিন্ন নদীর প্রবাহমানতায়। ভারতবর্ষ আজ বিশ্বায়িত, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বলীয়ান। সামাজিক চিন্তাভাবনাও আজ অনেক পরিবর্তিত। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে যৌনতা, যৌনতা কেন্দ্রিক নৈতিকতা ও হিংসার প্রসঙ্গে পরিবর্তন বিশেষ কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না। আর সেইজন্যই ১৯৭২ সালে মারাঠি ভাষায় লেখা নাটক ‘সখারামবাইন্ডার’ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কোন অসুবিধেই হয় না প্রাচ্য থিয়েটার গোষ্ঠী প্রযোজিত, অবন্তী চক্রবর্তী নির্দেশিত ‘সখারাম’ নাটককে আজ ২০১৭ সালে বুঝতে। মনে হয় যেন আজকের কথাই তো বলছে নাটকটি। অবশ্য এখানে বলতেই হবে নাটকটির এতটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে অবন্তীর যথাযথ নাট্য-রূপান্তরের গুণে। তাঁর অভিজ্ঞ নাট্যচেতনার দ্যোতনায় ফুটে ওঠে এক অন্য ভারতীয় বাস্তব, নিঃসঙ্গ সখারামের একান্ত বাস্তব, যে বাস্তবে বিচ্ছুরিত হয় ভারতীয় সমাজের অনৈতিক বিষয়গুলির প্রতি তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ। সখারাম এক অদ্ভুত বাস্তব রচনা করে, সেখানে সে আশ্রয় দেয় স্বামী প্রত্যাখ্যাতা নারীদের। তার আপাত অসুন্দর থাকবার জায়গাটিতে এই নারীরা বসবাস করে, খাবার পায় আর পায় বছরে দুটি শাড়ি। বিনিময়ে তাদের পালন করতে হয় ভারতীয় স্ত্রীদের সমস্ত কর্তব্য। এমনকি নিয়মিত শারীরিক বিনিময়ও ঘটে সখারামের সাথে। প্রশ্ন ওঠে ভারতীয় বৈবাহিক বন্ধনের ভণ্ডামির নিরিখে।
একুশ গ্রাম (২১ গ্রাম): একটি প্রতিবাদ, নাটকের রিভিউ নয় https://t.co/TwVIzCisdG via @Crunchify
— kaahon (@kaahonwall) May 7, 2017
দর্শকাসনে অনুভব করা যায় এক অসোয়াস্তির। অসোয়াস্তি সখারাম কে নিয়ে। কারণ গৌতম হালদার অভিনীত চরিত্র সখারাম যে ঢুকে পড়েছে ভারতীয় তথাকথিত সুখী সম্মানিত দাম্পত্য জীবনের বাইরের আবরণের অন্দরে। বিশেষ এক ধরণের অভিনয় শৈলীতে আবদ্ধ থাকার দোষে দুষ্ট গৌতম হালদার এ নাটকে অনবদ্য। তাঁর একান্ত নিজস্ব অভিনয় শৈলীই যেন সখারাম চরিত্রের সঠিক আধার হয়ে ওঠে। এ সখারাম তার সম্ভোগী যৌন যথেচ্ছাচারের জন্য কোনও সামাজিক গ্লানি বহন করে না। বরং সে যেন সমাজ সংস্কারক। সে উদ্ধার করেছে সামাজিক ভাবে নিপীড়িত নারীদের। যেন এটাই তার পরিচয়। নির্দেশকের মনন ও গৌতম হালদারের সূক্ষ্ম চরিত্র-বিশ্লেষণ সখারামের যৌনবৃত্তি-কে যে পরিমিত শারীরিক অভিনয় ও পরিকল্পিত শারীরিক স্পর্শ দ্বারা নির্মাণ করেছে তা খুবই উচ্চমানের ও প্রশংসনীয়। কোনরকম অতিমাত্রিক যৌনতা কেন্দ্রিক শারীরিক আস্ফালন ব্যবহৃত হয় না। অথচ নারী শরীরকে সামাজিক পর্দার অন্তরালে যৌনপণ্য হিসেবে ব্যবহার করা ও সেই সংক্রান্ত যৌনহিংস্রতাকে যথেষ্ট অসোয়াস্তিকর ভাবে পরিবেশন করার এক অনবদ্য নিদর্শন হয়ে ওঠে সখারাম চরিত্রটি গৌতমের অভিনয় ও চরিত্রায়নের গুণে। দ্যুতি ঘোষের লক্ষ্মী প্রশংসার দাবী রাখে। লক্ষ্মী একজন দূর্বল ভারতীয় নারী, সখারামকে স্বামী হিসেবেই মান্য করে। এ চরিত্রে দ্যুতির অভিনয় কৌশলের শিক্ষিত, সুচর্চিত দিকটি বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। মনীষা আদকের চম্পা-ও হয়ে ওঠে খুবই জোরালো ও বিশ্বাসযোগ্য। মনীষার তীক্ষ্ণ অভিনয় ও তার বিস্তার একদিকে চম্পা চরিত্রের শারীরিক যৌনক্ষুধা আবার অন্যদিকে তার নিপীড়িত, অসহায়, মদ্যপ পরিণতিকে সমান দক্ষতায় পরিবেশন করে। সখারামের বন্ধু দাউদ যে কিনা পরে হয়ে ওঠে একজন বিশ্বাসঘাতক- এ চরিত্রে বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ প্রশংসার যোগ্য। চম্পার পূর্ব-স্বামীর চরিত্রটি উপভোগ্য হয়ে ওঠে অসীম রায়চৌধুরীর বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশনায়।
নাটকের দৃশ্য-শ্রাব্য নির্মাণ মূলত রূপকধর্মী এবং তা দর্শককে কল্পনার এমন এক পরিসরে নিয়ে যায় যা বিমূর্ত অথচ কখনোই কাহিনীর স্থান ও কালের বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হয় না। নাটকের প্রকাশভঙ্গীতে সমান গুরুত্ব পায় সংলাপ, মঞ্চবিন্যাস ও শব্দের ব্যবহার। চরিত্রগুলির অন্তরভাবনা সুন্দরভাবে মুক্তি পায় নির্দেশক অবন্তীর বিমূর্ত-উপকরণ-ধর্মী দৃশ্যনির্মাণে ও দেবাশিস চক্রবর্তীর যথাযথ আলোর ব্যবহারে। এপ্রসঙ্গে বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে একটি শেকলের ব্যবহার যা হয়ে ওঠে ভিতরের সমস্ত কালিমাকে লুকিয়ে রেখে বাইরের গৃহস্থালি সান্ত্বনার বিমূর্ত প্রকাশ। যদিও দৃশ্য-শ্রাব্য নির্মাণের ভাবনায় আরেকটু ভারতীয়ত্ব এবং শব্দ-নির্ভর পরিবেশ রচনার প্রতি আরেকটু যত্ন নাটকের ভৌগোলিক ও দর্শকের সাথে মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারতো বলে মনে হয়।
নাটক দৈর্ঘ্যে আরেকটু ছোট হতে পারতো। তাতে দর্শকের উপর নাটকের প্রভাব হয়তো আরও সংহত হত। আর কয়েকটি ছোট ভুল, যেমন, শাড়ির আঁচল দিয়ে চায়ের কাপ ধরার এলোমেলো ব্যবহার নাটকের ছন্দকে সামান্য হলেও বিঘ্নিত করে। ঘরে এবং রান্নাঘরে হাওয়াই চপ্পলের ব্যবহার হয়তো বর্জনীয়।
সব শেষে ‘সখারাম’ নাটকের বিষয় অবন্তী চক্রবর্তীর উপস্থাপনায় দর্শককে যেভাবে ভারতীয় সামাজিক শালীনতার ভান সম্পর্কে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, তা সত্যিই বিশেষ সাধুবাদ দাবী করে।
শ্রীজয়ী ভট্টাচার্য