একটা নাট্যের ক্ষেত্রে এমনটা কি হওয়া সম্ভব যে সেটি দর্শককে একটি ভরাট ও তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতা উপহার দিল, অথচ সেটির ধারণাগত মজ্জায় থেকে গেল একটা বিরাট শূন্যতা, যার ফলে নাটকটাই হয়ে গেল অনপনেয়ভাবে সমস্যাযুক্ত, ত্রুটিপূর্ণ এবং, অন্তিম বিচারে, গভীরভাবে অসন্তোষজনক? নিভা আর্টস এবং সংসৃতি’র যৌথ প্রয়াসে তৈরী হওয়া সওদাগরের নৌকা ঠিক এই সম্ভাবনাকেই সাকার করেছে।
এই নাট্যের যে সব দিক আনন্দ দেয়, সে নিয়ে কোন কথা শুরু করতে হলে তা করতে হয় অভিনয়ের বিষয়টি থেকে। মূখ্য চরিত্র প্রসন্নের ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদারকে দেখতে পাওয়ায় কোন বিস্ময় নেই, যদিও বলতেই হচ্ছে অসামান্য শক্তিধর এই অভিনেতাকে ইদানীং যেন কিছুটা নিজের পুনরাবৃত্তি করতে দেখা যাচ্ছে। নিবেদিতা মুখোপাধ্যায় (আশার ভূমিকায়) এবং রণজিৎ চক্রবর্তী (হরিসাধনের ভূমিকায়) অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য তাদের চরিত্রের শৈলীকৃত উদ্ভাসনে। সুদীপ্তা চক্রবর্তী (সতী, প্রসন্নর স্ত্রীর ভূমিকায়) আবার প্রতিপন্ন করেন চমৎকার অভিনেতা হিসেবে তার ক্ষমতা, যখন আপাত অনায়াস দক্ষতায় তার নিজের স্বত্তা ঢেকে দেন অনেকটাই বেশি বয়সের চরিত্রের স্বত্তা দিয়ে। তবে, অন্তত আমার বিচারে, সুজন মুখোপাধ্যায়ের কাজ বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। কালো চরিত্রটি বেশ জটিল ও বহুস্তরীয় – সুজনের নিখুঁত সময়জ্ঞান, চরিত্রের বিবিধ দ্বন্দ্বসমূহ কন্ঠ, অঙ্গবিক্ষেপ ও গতিবিধির সমন্বয়ে নির্দেশ করার ক্ষমতা আর সমান সাবলীল ভাবে অনুভূতির উচ্চ শিখরে ওঠা ও প্রয়োজনে তীব্র অনুভূতি শক্ত রাশে ধরে রেখে তা প্রকাশ করা, কালোকে আশ্চর্যভাবে জীবন্ত করে তোলে। সুমিত চক্রবর্তীর আলো, দেবজ্যোতি মিশ্রর আবহ সংগীত (প্রক্ষেপণে অনিন্দ্য নন্দী) সঞ্চায়ন ঘোষের মঞ্চ, পিয়াল ভট্টাচার্যের নৃত্যবিন্যাস এবং মহম্মদ আলী’র রূপসজ্জা কার্যকরভাবে একত্রিত হয় নির্দেশক/পরিকল্পক-এর ভাবনাকে মূর্ত করতে। (এখানে বলে রাখা দরকার, প্রযোজনাটি তপন থিয়েটারে না দেখার কারনে ঘূর্ণায়মান মঞ্চের ব্যবহার আমার দেখে ওঠা হয়নি।)
Shekal Chhenra Hater Khonje is Rangaloke’s latest production…..https://t.co/NRUQAfXlKu#theatre pic.twitter.com/j7jwUUbAnQ
— kaahon (@kaahonwall) February 23, 2017
কিন্তু, যেমন শুরুতেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, এই নাট্যে রয়ে গেছে বেশ কিছু সমস্যা, যার মূলে আছে নির্দেশক, সীনোগ্রাফার (আমি ব্যবহার করব পরিকল্পক শব্দটি, ডিজাইনার বোঝাতে) দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত, যে তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটকটিকে নতুনভাবে কল্পনা করবেন না বা নতুনভাবে সাজাবেন না। এমনটা মনে হয় যে নাট্য প্রযোজনাটি ভাবার সময় দেবেশ একটি ছুরি চালিয়ে গোটা ব্যাপারটাকে দু’টো ভাগে বিভক্ত করে নিয়েছিলন, যার একটা টুকরো হলো নাটকের টেক্সট আর ওপর খন্ডটি হলো তার নাট্যরূপ দেওয়ার বিষয়টি। এই নাট্যরূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেবেশ সমসাময়িক হলেন আলো, মঞ্চ নির্মাণ, সংগীত ও নৃত্যবিন্যাসে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকরণ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। এর ফলে উৎপাদিত হলো একটি অত্যন্ত সুশ্রী অডিও-ভিসুয়্যাল বস্তু, পরিপাটি মোড়ক সম্বলিত; চল্লিশ বছর পুরানো নাটকটি একধরনের প্রসাধনী পালিশ লাভ করল আর আমারা পেলাম সৌন্দর্যবর্ধিত অজিতেশ। কিন্তু, তার পরিকল্পক স্বত্তার হাতে তার নির্দেশক স্বত্তাকে পরাজিত করে দেবেশ নাটকের টেক্সট – অনেকেই যেটাকে চিহ্নিত করবেন প্রযোজনার স্পন্দিত হৃৎপিণ্ড হিসেবে – রেখে দিলেন একেবারে অপরিবর্তিত। টেক্সটের অন্তত তিনটি স্পষ্ট ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা যায়, যা কিনা নির্দেশকের গঠনমূলক হস্তক্ষেপে লব্ধ হতে পারত।
১। নাটকটি সার্থকভাবে সম্পাদিত হতে পারত। উদাহরন হিসেবে, সম্পাদনা করা যেত প্রসন্নর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করে এমন বহু দৃশ্যের বেশ কিছু অংশ, সে সব অংশ যা আলোকপাত করে প্রসন্ন ও সতীর সম্পর্কের ওপর এবং সেই অতি দীর্ঘ দৃশ্য যেখানে সতী আর আশা অপেক্ষা করে প্রসন্ন’র ফেরার। থেকে থেকেই আখ্যান গড়ায় পীড়াদায়ক শ্লথতায়, পুনরাবৃত্তির ভারে ন্যুব্জ হয়ে।
২। আজিতেশের নাটক জায়গায় জায়গায় কাব্য নাটক এবং তা বহন করে এই গোত্রের নাটকের বৈশিষ্ট চিহ্ন – কথাবাহুল্য। কিছু অংশে কথার এত রমরমা যে নাট্য সেখানে শ্রুতি নাটকের চলন পায়; কেউ যদি সে সব অংশে চোখ বন্ধ রেখে শুধু শোনেন, তিনি বিশেষ বঞ্চিত হবেন না। অতিকথনের হাত ধরে আসে দেখানোর চেয়ে বলার ওপর বেশি নির্ভরতা। তাই এটা মোটেই আশ্চর্যের নয় যে বেশির ভাগ সময়েই অভিনেতারা টেক্সট-নির্ভর, সংলাপ সর্বস্ব অভিনয়ের সেই আদি অভ্যাসে ফিরে যান, চরিত্রদের নানামাত্রিক ভাবনা, অনুভূতি ও ভাব পারফর্মেন্সদিয়ে ধরার চেষ্টা না করে। পারফর্মেন্সের তত্ত্ব ও চর্চার ওপর দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের দখল প্রশ্নাতীত, এবং ঠিক এ কারনেই তিনি যখন পারফর্মেন্স-বিমুখ হয়ে যান, তখন আমরা হয়ে পড়ি হতভম্ব ও নিরাশ।
৩। অজিতেশের নাটকের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে যে, তা যতটা একজন বৃদ্ধ যাকে নিরন্তর ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সময়ের আবর্জনা পাত্রের দিকে তার সঙ্কটকে প্রকাশ করে, ততটা উন্মোচন করে না একজন যাত্রা-শিল্পীর সঙ্কট।(এর কারন হয়ত নাটকের রচনার সময় যাত্রা কিছুটা হলেও জীবিত ছিল।) কোন নান্দনিক সঙ্কট, তার শিল্প মাধ্যম ও চর্চার সঙ্কট প্রসন্ন’র চরিত্র ব্যক্ত করে না বললেই চলে। তাই, একবার নয় দু’বার, প্রসন্ন নাচের ছন্দে ছুটে চলে যেতে পারে তাই করতে যা সে এতদিন ধরেই করে আসছিল। টেক্সটের এই অংশ দাবী করছিল নির্দেশকের প্রভূত হস্তক্ষেপ। আমাদের আজকের সময়ে যখন নানা কিসিমের পর্দার বিনোদন ও শিল্পকলা, তা ভার্চুয়াল হোক বা রিয়াল, লাইভ পারফর্মেন্স ব্যাপারটার অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে, তখন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের টেক্সটের বদল ঘটিয়ে এই সঙ্কটকে প্র্যাক্টিশনারের দৃষ্টি দিয়ে সম্বোধন না করার সিদ্ধান্তটা নান্দনিক দায়িত্ব না নেওয়ারই সামিল।
বছরটা ২০১৭, শিল্প মাধ্যম হিসেবে যাত্রা এখন একটি কুৎসিত, হীন মরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে আর সরকারি অনুদান চেষ্টা করছে থিয়েটারকে কোমা থেকে জাগাতে। কিন্তু তবুও, এই সময়ের প্রেক্ষাপটে, নাট্যের অন্তিম দৃশ্যে প্রসন্ন আলোর তীব্র ঝলকানির আর দাপুটে আবহ সংগীতের সহায়তায় একটি অতিনাটকীয় উদাত্ত আহ্বান করে তার শিল্পের নৌকা পুনরায় ভাসানোর। এই সুচারুভাবে সাজানো দৃশ্য দর্শকের সাংস্কৃতিক স্মরণবেদনায় তার কাঙ্খিত অভিঘাত করে এবং মিথ্যা আবেগে ভেসে যাওয়া দর্শক দুর্দান্তভাবে তালি দেন, হর্ষধ্বনি দেন। আশা রাখি, আবেগের উচ্চ শিখর থেকে তারা যখন নেমে আসবেন, দর্শকরা তখন স্থিত হয়ে সত্যি দরকারি প্রশ্নগুলো করবেন – কোন নৌকার কথা বলে প্রসন্ন? সে নৌকা কি আদৌ আছে? থাকলে, কেউ দেখে নিয়েছে তো যে সে নৌকার তলদেশে একটা বিরাট ফুটো নেই? আর, নৌকার কথা যখন উঠল, আমি আশা করব দর্শকদের সাংস্কৃতিক স্মৃতি তাদের মনে ভাসিয়ে তুলবে আরেকটা নৌকার ছবি –জলসাঘর চলচ্চিত্রের সেই মৃত, ডাঙায় আটকে থাকা নৌকা, যা কিনা একভাবে বিশ্বম্ভর রায়ের যন্ত্রণাময় জীবনের ইতি ঘটায়। সেই নৌকাটি ছিল নির্দেশকের সৃষ্টি, আমাদের সওদাগরের নৌকা পরিকল্পকের ক্ষুদ্র গয়নামাত্র।
দীপঙ্কর সেন