কালিন্দী ব্রাত্যজনের নাটক ‘মীরজাফর’। উফ, সে একটা ব্যাপার বটে ! এত্ত বড় বড় অ্যাক্টর ! এত্ত এত্ত আলো, এত্ত বড় বড় সেট, এত্ত এত্ত কোরাস, এত্ত এত্ত মিউজিকের ব্যবহার আর এত্ত এত্ত দর্শক! এসব নাটক দেখতে গিয়ে মনে হয় “ওহে লাভহীন, দর্শকহীন, মজুরীহীন বাংলা থিয়েটার, তুমি কি কেবলই ছবি? অলীক? কিছু মানুষের ঘ্যানেঘ্যানে কান্না মাত্র?” নাটকটির সাম্প্রতিক অভিনয় হল ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে একাডেমী মঞ্চে।
মীরজাফর নাটকটি বলাই বাহুল্য মীরজাফরকে নিয়ে লেখা। সিরাজ-উদ-দৌল্লার সাথে পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাকে হত্যা করে সবেমাত্র মুর্শিদাবাদের তখ্তে বসেছেন প্রায় বৃদ্ধ মীরজাফর। সেই ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টুকু এই নাটকের সময়কাল। নাটকের গল্প আর কি বলব মশাই, ইতিহাস বই খুলে পড়ে নিলেই হবে। লর্ড ক্লাইভ কিভাবে রক্ষা করার নামে মীরজাফরকে দোহন করে চলে, কিভাবে খনি, খাজনা, তাঁত হয়ে বাংলার অর্থনীতির স্তম্ভগুলো বাগিয়ে নেয়। মীরজাফরের ছেলে মীরন কিভাবে সিরাজের বংশ নির্বংশ করতে উঠে পড়ে লাগে, মীরজাফরের জামাতা মীরকাশিম কিভাবে বেইমানি করে তার শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে, এবং সবশেষে তাঁরা কিভাবে একে একে মারা যায়। এসবই ইতিহাসের পাতা থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরা আছে নাটকে। কি করা যাবে আর, নাট্যকার যখন ইনফরমেশনের বাইরে কিছুমাত্র দিলেন না, তখন যাদের সামনে হিস্ট্রি পরীক্ষা, তারাই বরং ঘণ্টা তিনেক সময় খরচ করে দেখে ফেলুন নাটকটা, ভালমত রিভাইস হয়ে যাবে।
Previous Kaahon Theatre Review:
অথচ ঘটনা প্রবাহগুচ্ছটির একটি সম্পূর্ণ নাটক হয়ে ওঠার সম্পূর্ণ সুযোগ ছিল। বাংলায় তখন যে অরাজকতা চলছে, যেভাবে মুনাফার লোভে বিশ্বাসঘাতকতার স্রোত রেহাই দিচ্ছে না একজনকেও, যেভাবে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ, সেটাই হয়ে উঠতে পারত নাটকের বিষয়বস্তু, নাটকটাকে একটা ট্র্যাজেডি করে তুলতে পারত, কিন্তু তার বদলে নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে উঠলেন কয়েকজন আদ্যপান্ত ভিলেন এবং তাঁদের জীবনের কিছু ঘটনা-পরম্পরা। তাও মানা যায়, প্রোটাগনিস্টকে যে হিরোয়িক হতেই হবে তার তো কোন মানে নেই, কিন্তু একটা নাটকের নাটক হয়ে ওঠার জন্য তো কোন একটা কনফ্লিক্ট তো দরকার ! ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে গেলেই তো আর নাটক হয় না! বিশেষত ব্রাত্য বসুর মত অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী নাট্যকারের থেকে এইরকম টেক্সট একেবারেই অভিপ্রেত নয়।
মীরজাফরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন স্বনামধন্য গৌতম হালদার। তাঁর অভিনয়ের ম্যানারিজমের কথা সকলেই কমবেশী জানি। তবে এই চরিত্রে তাঁর ম্যানারিজম এত বেশীমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে (হয়েছে? না করেছেন?) তা একসময় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যেন চরিত্রটির প্রয়োজন প্রাথমিক নয়, ম্যানারিজমের প্রয়োজনটিই বেশী। ব্রাত্য বসু অভিনয় করেছেন লর্ড ক্লাইভের ভূমিকায়, মীরনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কাঞ্চন মল্লিক। এই নামগুলো নিতে হচ্ছে কারণ এগুলো এক একটি বিখ্যাত নাম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এঁরা অসামান্য অভিনয়ের প্রমাণও রেখেছেন কিন্তু তাঁদের কাছে এই নাটকের চরিত্রগুলিতে অভিনয় করার মত বিশেষ কিছু ছিল না।
তবে সকলেরই অভিনয় বেশ উঁচুতারে বাঁধা, (এত উঁচু যে দেখতে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় ব্যথা করে।) আরও উঁচু উঁচু তারে বাঁধা হয়েছে আলো ও শব্দের ব্যবহার। প্রোফাইল, এলইডি পার, পিসি, ফ্লোর, এফ ও এইচ সমস্ত মিলিয়ে সে একটা ঝকমকে উজ্বল চোখ ধাঁধানো ব্যাপার। মিউজিকের ক্ষেত্রে হালুম হালুম বাঘের ডাক, করকরাৎ বাজের আওয়াজ, শপশপ চাবুকের আওয়াজ এসব বেশ ঝনঝনিয়ে বাজানো হয়েছে। আর তার চেয়েও অদ্ভুত, ব্যবহৃত হয়েছে মেহেমুদের সেই বিখ্যাত গান, (হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, বিখ্যাত ভারতীয় কমেডিয়ান মেহেমুদের কথাই বলা হচ্ছে) হাম কালে হ্যাঁয় তো কেয়া হুয়া দিলওয়ালে হ্যাঁয়! সংলাপেও ব্যবহৃত হয়েছে জীবনানন্দের কবিতার লাইন, সানি দেওলের বিখ্যাত ডায়লগ, রবি ঠাকুরের সুরে (নাকি সরলাদেবীর? এ ভরা বাদর মাহভাদর…) বিদ্যাপতির গান। কালানৌচিত্য দোষ (যখন এক সময়কালে লিখিত টেক্সটে অন্য সময়কালের রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়।) শুনেছি কোন একটি সিচুয়েশনকে বিশদে এক্সপ্লেইন করার জন্য, দর্শক বা পাঠকের সাথে বেশী যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এমনভাবে টেক্সট সাজানো হল কেন কেজানে!
তাও শেষ অবধি কোটি কোটি দর্শক এসব দেখতেই পছন্দ করেন। নাহলে এমন পিলপিলিয়ে হল ভরানো দর্শক কই অন্য নাটক গুলোয় দেখা যায় না! দর্শক কি তাহলে সিরিয়ালের মায়া কাটিয়ে, মেট্রোর ভিড় ঠেলে তখনই নাটক হিট করাচ্ছেন যখন সেখানে অলরেডি এস্ট্যাব্লিশড স্টারেরা রয়েছেন? দর্শকের তাহলে নিজের কোন চাহিদা নেই? উজ্বল আলো, ঝকমকে পোশাক, উচ্চকিত অভিনয় – নাটকের বহিরঙ্গের রূপটুকুই তাঁদের চাহিদা? তাঁরা শুধুই এন্টারটেইনমেন্ট চান? জানিনা। তবে এবার হয়ত এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।