গত ২০শে জানুয়ারী লবণহ্রদ মঞ্চে অভিনীত হল অশোকনগর নাট্যআনন প্রযোজিত বাংলা নাটক ‘আর্কিমিডিসের মৃত্যু’। আমরা কাহনের পক্ষ থেকে ২৫শে নভেম্বর একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের লেডি রানু মুখোপাধ্যায় মঞ্চে এই নাটকের অভিনয় দেখেছিলাম। নভেন্দু সেনের লেখা এই নাটকটার নির্দেশক চন্দন সেন।
অশোকনগর নাট্যআনন দলটা বেশ কিছুদিন ধরেই বিজ্ঞানমনস্কতা সম্পর্কিত নাটক প্রযোজনা করে চলেছেন। এই যেমন আগের নাটকটা ছিল ‘অ-পবিত্র’ – Inherit the Wind নামের বিখ্যাত নাটক/সিনেমাটার বাংলা! প্রায় একশো বছর আগে মার্কিন মুলুকে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিয়ে কী রকম সমস্যা তৈরি হয়েছিল, সেই নিয়েই ছিল নাটকটা। এবারে তারা পিছিয়ে গেছেন আরও প্রায় দু’হাজার বছর। এবারের নাটকের মূল চরিত্র হলেন বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস (২৮৭ – ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। সেই আর্কিমিডিস, ছোটবেলায় যার দেওয়া সূত্র মুখস্থ করতে গিয়ে আমাদের সবাইকে ঘোল খেতে হ’ত। সেই আর্কিমিডিস, যার জীবন সম্পর্কে আমরা যতটা জানি তার অনেকটাই মিথ! তাঁর মৃত্যু সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায়না। একটা মতবাদ অনুযায়ী, রোমান সেনারা তাঁকে চিনতে না পেরে হত্যা করে ফেলেন। আর ঠিক এইখানেই নাট্যকারের কল্পনার পাখা মেলার শুরু! আর্কিমিডিসের শেষ জীবনের কিছুটা সময়কে উপজীব্য করে নাট্যকার তৈরি করেন একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ নাট্যমুহূর্ত, শুনিয়ে যান ফলিত বিজ্ঞান ও কায়েমী স্বার্থের চিরকালীন দ্বন্দ্বের কাহিনী!
Previous Kaahon Theatre Review:
নভেন্দু সেন (১৯৪৪-২০০৮) আধুনিক বাংলা নাট্যকারদের মধ্যে একটি অগ্রগণ্য নাম। বোকারোতে কর্মস্থল হওয়ার দরুন তিনি কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলা নাট্যচর্চার মূল ফোকাস এরিয়ার বাইরেই থেকে গেছিলেন। তবে বর্তমানে নাট্যকার নভেন্দু সেনকে এই শহর নতুন করে আবিষ্কার করছে। এই মুহূর্তেই কলকাতায় আরও অন্তত দু’টি নাট্যদল তার লেখা দু’টি ভিন্ন নাটক অভিনয় করে চলেছে। এই ‘আর্কিমিডিসের মৃত্যু’ নাটকটি তিনি লিখেছিলেন নব্বই এর দশকে। তার লেখা অন্য অনেক নাটকের মত এখানেও উঠে এসেছে পুঁজিবাদের চক্করে পড়ে নিষ্পেষিত হতে থাকা মানুষের গল্প, তবে এই নাটকে সেই বিধ্বস্ত মানুষটি হলেন স্বয়ং আর্কিমিডিস ! আর্কিমিডিস বিশুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চায় ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু জন্মস্থান সিরাকাস আক্রান্ত হলে কতকটা বাধ্য হয়েই তিনি কয়েকটি সমরাস্ত্র ডিজাইন করেন। সেই অস্ত্রের ডিস্ট্রিবিউশন রাইটস কব্জা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন দেশের রাজা হেরণ, বণিক সর্দার পেরিবুলাস থেকে আক্রমণকারী রোমান সেনাপতি মার্সিলুজ, সকলেই। ইতিহাসের সীমার বাইরে গিয়ে নাট্যকার কল্পনা করেন আর্কিমিডিস আর মার্সিলুজের মধ্যে একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দৃশ্য, আর ঐ ডিসকোর্সের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পায় বিজ্ঞান, সভ্যতা, ও পুঁজিবাদ সম্পর্কিত নাট্যকারের যাবতীয় চিন্তাভাবনা !
কিন্তু এমন একটা স্ট্রং আর যুগোপযোগী নাটককে নির্মাতারা যেরকম আলস্যের সঙ্গে পরিবেশন করলেন সেটা খুবই হতাশজনক। মদন হালদার ও বাসুদেব সাহার তৈরি মঞ্চ অবশ্য গতানুগতিক হলেও ছিমছাম ও প্রয়োজনানুগ। কিন্তু কল্যাণ ঘোষের আলো একেবারেই দিশাহীন ! এতগুলো বিভিন্ন রঙের লাইট সোর্স, তার কোনটা, কখন, কেনই বা জ্বলছে, একসঙ্গে এতগুলোই বা জ্বলছে কেন, কোনোকিছুই ঠাহর করে ওঠা যায়না ! গৌতম ঘোষের সঙ্গীত উচ্চকিত, কিছুটা যাত্রা বা টিভি-সিরিয়াল ঘরানার, তারপর ততোধিক লাউড প্রক্ষেপণের ঠেলায় অনেক সময়েই সংলাপের ওপর দিয়ে যায় ! অভিনেতারা অনেকেই টিভি-সিরিয়ালের ব্যস্ত আর পরিচিত মুখ, অভিনয়ের মধ্যে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। খুব সম্ভবত মহলার জন্য খুব বেশি সময় তারা ব্যয় করতে পারেন না, তাই প্রায়ই সংলাপ ভুলে ভুলে যান। পেরিবুলাস চরিত্রে পঞ্চানন ব্যানার্জী প্রায় পাঁচ-ছ’বার সংলাপ অর্ধসমাপ্ত রেখে আবার সংশোধন করে বলেন; মনে হচ্ছিল কোনোক্রমে সংলাপগুলো বলে দিতে পারলে তিনি বেঁচে যান ! হ্যাঁ, এই নাটকটা সংলাপ প্রধান, বিশেষ করে আর্কিমিডিস ও মার্সিলুজের কথোপকথনটাই নাটকের মূল অংশ। মার্সিলুজ চরিত্রে শান্তিলাল মুখার্জীরও সমস্ত সংলাপ আত্মস্থ ছিলনা, কিন্তু তিনি একজন খুবই অভিজ্ঞ অভিনেতা, তিনি কনসেনট্রেট করেছেন খুব ধীরে ধীরে মাতাল হয়ে যাওয়ার অভিনয়ের দিকে। যার ফলে দর্শকের পুরো মনোযোগ গিয়ে পড়ে ঐ স্টিরিওটাইপটার ওপর, আর তাতে করে অভিনয়ের প্রস্তুতির অভাবটা মাস্কিং হয়ে যায় ! নির্দেশক চন্দন সেন নিজের গলা বিকৃত করে বৃদ্ধ আর্কিমিডিসের চরিত্রে অভিনয় করেন, কিন্তু কখনো কখনো তার নিজের আসল গলাটা বেরিয়ে আসে ! এছাড়াও তিনি সামান্য নিচু হয়ে হেঁটে, শুরুর দিকে কিছু কৃত্রিম অঙ্গভঙ্গি করে, সেই আবার আরেকটা স্টিরিওটাইপকেই ফলো করেন। মৃত্যুর সময় আর্কিমিডিসের বয়স পঁচাত্তর হলেও এই নাটকে তিনি কী কী বলছেন সেটাই মুখ্য, তাই দৃপ্ত কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সেই কথাগুলো দর্শকের মগজে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন ছিল, ঐ বিকৃত গলার কোনো প্রয়োজনই ছিলনা[১]! দুই মুখ্য অভিনেতার আগ্রহের অভাবে কোনো নাট্যমুহূর্তই সেভাবে দানা বেঁধে ওঠেনা, নাটকের দ্বন্দ্বটিও দর্শকের মধ্যে কমিউনিকেটেড হয়না, আর নাটকটাও শুধুমাত্র সংলাপের পর সংলাপ হিসেবেই থেকে যায়! নাটকের শুরুতে ও শেষে ইয়স চরিত্রাভিনেত্রীর দুর্বল চিৎকৃত অভিনয় নাটকটার আরো সর্বনাশ ঘটায় ! এই ধরণের নাটকে কোরাসের কাজ হওয়া উচিত নাটককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, কিন্তু এখানে একটা বেশ কমন মুখোশ পরে একদিক থেকে অন্যদিকে ছুটে যাওয়া ছাড়া তাদের বিশেষ কোনো কাজ নেই! সব মিলিয়ে মনেহয় যে নির্মাতারা কোনো একটা ভাবে নাটকটা মঞ্চস্থ করে ফেলার দিকেই বেশি উৎসাহী ছিলেন, প্রয়োগ সম্পর্কিত কোনো বিশেষ চিন্তাভাবনার চেষ্টাই করেননি!
এত দায়সারা একটা প্রযোজনার মধ্যেও যে ব্যক্তিটি ‘অড পার্সন আউট’ হয়ে দেখা দেন, তিনি হলেন ঋতব্রত মুখার্জী। তার অভিনীত চরিত্র গেলনের মঞ্চে উপস্থিতি খুব কম সময়ের জন্য; কিন্তু তার এনার্জি, অঙ্গসঞ্চালন, বাচনভঙ্গি, সবকিছুর মধ্যেই একটা ফ্রেশনেস, একটা আধুনিকতার স্বাদ পাওয়া যায়! এই দুর্বল, প্রাচীনপন্থী প্রযোজনার মধ্যে তিনি যেন এক ঝলক টাটকা হাওয়া। সন্দেহ নেই যে তিনি একজন লম্বা রেসের ঘোড়া। আশা করা যায়, তাৎক্ষণিক সাফল্য বা সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে তিনি নিজেকে নষ্ট করবেন না।
এই নাটকের এটাই ছিল দ্বিতীয় শো। নির্মাতারা দাবি করতে পারেন যে আরো কয়েকটি শো হয়ে গেলে হয়ত অভিনয় আরও পলিশড হবে, আঁটোসাঁটো ভাবটাও চলে আসবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, এই ক’টি শো এর দর্শকরা কী এমন দোষ করেছিলেন? টিকিট কেটে তারা কেন একটা অর্ধপ্রস্তুত নাটক দেখবেন? নাটকের দর্শকদের এই টেকেন ফর গ্রান্টেড করাটা কবে বন্ধ হবে? নির্মাতারা কি এটা ধরে নিচ্ছেন যে সিরিয়ালের অভিনেতাদের দেখতে পেলেই দর্শকরা খুশি হয়ে যাবেন, নাটক কেমন হল তাতে কিছু যায় আসে না? নইলে প্রযোজনায় এরকম গা-ছাড়া মনোভাব কেন? নাট্যমোদী জনগণ যদি আগ্রাসী হয়ে নির্মাতাদের কাছে জবাবদিহি চান, তবেই একমাত্র এইরকম ফাঁকিবাজি প্রবণতা বন্ধ হতে পারে !
[১] ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’ নাটকে সক্রেটিস চরিত্রে দৃপ্ত কণ্ঠস্বর নিয়ে অভিনয় করেছিলেন দ্বিজেন বন্দোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, মৃত্যুর সময় সক্রেটিসও সত্তরোর্ধ্ব ছিলেন!