কাঞ্চনমালা – সময়ের নিরিখে পিছিয়ে পড়া একটি নাটক

Posted by Kaahon Desk On February 8, 2019

সমীক্ষণ নাট্যদলের নতুন নাটক কাঞ্চনমালা। রচনা সৌমিত্র বসু এবং নির্দেশনা পঙ্কজ মুন্সি। সৌমিত্র বসু এবং পঙ্কজ মুন্সি দুজনেই বাংলা থিয়েটারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছেন। সমীক্ষণ দলটির বয়সও প্রায় ৪০ বছর। তাই এঁদের কাজ দেখতে যাওয়ার সময় প্রত্যাশার পারদ চড়ে থাকবেই।

কাঞ্চনমালা নামটা শুনলেই মনে হয় এটা নিশ্চয়ই রূপকথা! (বিশেষত কিরণমালার পর থেকে সব মালাকেই রূপকথা মনে হয়। ব্যতিক্রমঃ ঊর্মিমালা, জুঁইয়ের মালা, নারকেল মালা… প্রভৃতি)। আর ড্রামাটিক ডিভাইস হিসেবে রূপকথা যে কত আকর্ষণীয় সেটা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘদিন ধরেই তাবড় বিখ্যাত লিখিয়েরা রূপকথার আড়ালে বলে চলেছেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা, করে চলেছেন প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন, এবং দেখিয়ে চলেছেন জীবনের রাজনীতি – তবে সকলই খুব সহজবোধ্য ভাষায়। তাই এতদিনের একটি দলের ব্যানারে একটি রূপকথা প্রযোজনা দেখতে যাওয়ার সময় প্রত্যাশার পারদ দ্বিগুণ মাত্রায় চড়ে থাকে।

Previous Kaahon Theatre Review:

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় লেখক নির্দেশক বা কলাকুশলীরা কেউই এই প্রত্যাশার দায় নিতে চাননি। নাটকের মধ্যে কোন কনফ্লিক্ট তৈরি হয়না এবং নাটকটি কার্যকারণ রোহিত সংযোগহীন কিছু দৃশ্যের সমাবেশে পরিণত হয়। নাটকের মূল চরিত্র, রাজকুমারী কাঞ্চনমালা শুরুতে জানায় সে নিয়মের বিরুদ্ধে লড়তে চায়। কিন্তু গোটা নাটকে একটি সাপের সাথে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া সেরকম কিছুই তাকে করতে দেখা যায় না। রাজকুমারীর বাবা মা মেয়েকে দেশের রানি করার লোভে ৭৭ বছরের বুড়ো রাজার সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায় কিভাবে? বৃদ্ধ রাজাকে বিয়ের পরামর্শ দেওয়ার পিছনে জ্যোতিষীর স্বার্থই বা কি? শাপভ্রষ্ট হয়ে সাপে রূপান্তরিত রাজা তাঁর শাপ মোচনের জন্য কেন বা কিভাবে কাঞ্চনমালাকেই আগে থেকে ঠিক করে রাখেন – এসব কিছুই জানতে পারা যায় না। বুঝতে পারা যায় না বুড়ো রাজার সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার বিপদ থেকে রাজকুমারীকে উদ্ধারকারী এই সাপ কিভাবে আগে থেকেই নিজের ছেলের সাথে কাঞ্চনমালার বিয়ের প্ল্যান করে রাখে। এবং সর্বোপরি নতুন রাজ্যে গিয়ে রাজকুমারীর প্রচলিত ভাল মেয়ের ধারণা অনুযায়ী রাজকুমারের ঘর গুছিয়ে দেওয়া দর্শকের মধ্যে একধরনের অঞ্জন-চৌধুরী-চিত বিরক্তির উদ্রেক করে।

কার্টেন কলে পঙ্কজ বাবু জানান এই নাটক তাঁরা হারিয়ে যাওয়া শৈশবের উদ্দেশ্যে বানিয়েছেন। কাঞ্চনমালা নাটকটিকে শিশুদের মনোগ্রাহী করে তোলাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। কিন্তু কিভাবে উপরোক্ত ঘটনাগুলি শিশুদের আনন্দ দেবে বা শিশু মনকে পসিটিভলি প্রভাবিত করবে তা বুঝতে দর্শক অক্ষম।

একটা নাটকের প্রত্যেকটা মুভমেন্ট রাজনৈতিক। লেখক বা নির্দেশক চান বা না চান রচনা এবং নির্দেশনার মধ্য দিয়ে তাঁদের জীবনের রাজনীতিটি বেরিয়ে আসবেই। তাছাড়া রূপকথা ডিভাইসটিও চিরকাল অ্যালিগোরি রূপে এই কারণেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এই নাটকের সঙ্গে যুক্ত কেউই এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। শিশুমনে কি বোধের বিকাশ থাকে না? তারা কি বুঝতে পারে না যা ঘটছে তার কার্যকারণ সম্পর্ক? অভিভাবকদের কি দায়িত্ব থাকে না তাদের বোধের বিকাশের দিকে আর একটু এগিয়ে দেওয়ার? বিশেষত সৌমিত্র বসু এবং পঙ্কজ মুন্সির মত শিক্ষিত এবং সাংস্কৃতিক অভিভাবকদের? আর কতদিন বাংলা থিয়েটারের রূপকথা শুধুমাত্র গড়িয়াহাটের ঘাঘরা-পাঞ্জাবি আর গয়নাগাঁটিতে আটকে থাকবে? এখনো কি সময় হয়নি কি করছি আর কেন করছি সেই নিয়ে ভাবার?

এই নাটকের একমাত্র সম্পদ নাটকের মঞ্চসজ্জা। মঞ্চভাবনা করেছেন সৌমিক-পিয়ালি। এবং কম খরচে এত সুন্দর একটি সেট বানিয়েছেন তাঁরা, যা শিক্ষণীয়। নাটকের আলো সেটেরই অংশ বলা যায়। তাই আলোও বেশ সুন্দর। গৌতম ঘোষের মিউজিকের ব্যবহার খুবই বস্তাপচা এবং অভিনয় একেবারেই বাজারচলতি মেগা সিরিয়ালের মত। থিয়েটারের দিকপালরা যদি থিয়েটারের প্রাণশক্তি-জীবন্ত বা লাইভ আদান-প্রদান, এই কথাটাই ভুলে যান এবং দর্শকের জন্য এইরকম একটি না-দৃষ্টিনন্দন না-মনোগ্রাহী প্রযোজনা তৈরি করেন, তাহলে বারবার থিয়েটারে লোক নেই টাকা নেই বলে কেঁদে ভাসিয়ে যাওয়া কেন?

তাই শেষ পর্যন্ত সমীক্ষণের কাঞ্চনমালা দর্শককে একরাশ হতাশা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। নাটকের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা সমীক্ষণের থেকে আর অনেক ভাল কাজ দেখার আশা রাখছি।

পুনশ্চঃ
১। রাজকুমারী মানেই মাঝে মাঝে নেচে নেচে কথা বলেন না। বিশেষত পাহাড়, আকাশ, নদী ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণের সাথে মুদ্রা বা ভঙ্গিমা না করলেও শব্দগুলির মানে একই থাকে।

২। সাপেরা নিজেদের সাপ বোঝাতে সাধারণত সাপেরকস্টিউম পরেন না। সারাক্ষণ ফনা তুলেও থাকেননা। থিয়েটারে ইমাজিনেশন বলে একটা ব্যাপার আছে।

৩। নাটকের রিভিউ পড়ে সিদ্ধান্ত নেবেন না নাটক দেখবেন কিনা। হলে যান, নাটক দেখুন। সহমত বা ভিন্নমত হলে তলায় কমেন্ট সেকশনে জানান।

 

 

Ebong Ipsita
A Kolkata based theatre practitioner, she has been doing theatre from 2005 and now she is co-directing and adapting plays for different theatre groups in Bengal. She believes to explore the web medium as well to express herself to the world.

Read this review in English.

ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।

Related Updates

Comments

Follow Us

Show Calendar

Message Us