বাংলা নাটকের দুনিয়ায় নতুন দল হিসেবে ‘ভীমরতি’ আত্মপ্রকাশ করেছে গত ২৪শে ডিসেম্বর তাদের নাট্য প্রযোজনা ‘মেষ মানুষ কাহন’ নিয়ে, নির্দেশনায় নয়না। তিনটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র অভিযোজন করে নাট্যরূপ দিয়েছেন দীপঙ্কর সেন (যথাযথ ঋণ স্বীকার সহ)। তার মধ্যে প্রথম ছবি দুটি অ্যানিমেশন, জার্মান চলচ্চিত্রকার Gottfried Mentor নির্মিত ‘Oh Sheep!’ এবং ‘Lambs’, অন্যটি ব্রিটিশ/ইরানিয়ান পরিচালক Babak Anvari-র তৈরি ‘Two and Two’। নির্মাতারা এই তিনটি ছবির কাহিনীকে ধারাবাহিকতায় গেঁথে নিয়ে, তার মধ্যে কিছু নাট্যোপাদান মিশিয়ে, একটি সম্পূর্ণ নাট্যাভিজ্ঞতা দর্শকদের উপহার দিতে চেয়েছেন। আবহমানকাল ধরে চলে আসা শাসক-শাসিত সম্পর্ক ইহল এই নাটকের মূল থিম। প্রসঙ্গত, নাটকটি ‘ইন্টিমেট’ বা ‘অন্তরঙ্গ’ থিয়েটার হিসেবে পরিবেশিত, এখানে অভিনেতা-অভিনেত্রী ও শব্দযন্ত্রীদের সঙ্গে দর্শকরা একটাই স্পেস শেয়ার করেন।
নাটকের প্রথম অংশটি নির্বাক, এখানে শিল্পীরা কোরিওগ্রাফের মাধ্যমেই বাঙ্ময় হন। কর্তৃপক্ষ কীভাবে তাদের স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে কৌশলে অধীনস্থদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, একে অপরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে – শিল্পীদের নীরব অঙ্গসঞ্চালন ও সৃষ্ট শব্দের ব্যবহারে তা দর্শককে স্পর্শ করে। রঙের প্রতীকী ব্যবহার মনে করিয়ে দেয় দেশ ভাগের যন্ত্রণা। মূল বিষয়ে প্রবেশের আগে দুই প্রভুর যুগ্মনৃত্য কিছুটা দীর্ঘায়িত, বিশেষ করে বর্তমান যুগের দর্শকদের মনঃসংযোগের ব্যাপ্তির দৈন্যের কথা মাথায় রাখলে; তবে অন্যদিক থেকে দেখলে এই সময়টা দর্শকদের কিছুটা প্রশমিত হতে দেয়, নির্দেশক চোখে আঙুল দিয়ে কিছু দেখিয়ে দেওয়ার আগে দর্শক নিজে থেকে কিছুটা অনুধাবনের সুযোগ পান। নাটকের এই অংশে অন্তরঙ্গ স্পেসের সুবিধাকে সেভাবে ব্যবহার করা হয়নি, আর যেহেতু কম্পোজিশনের মাধ্যমে দুটি অংশের মধ্যে বারেবারে বিভাজন দেখানোটাই মূল উদ্দেশ্য, তাই হয়তো প্রসেনিয়াম মঞ্চে দর্শকের সম্পূর্ণ দৃষ্টিক্ষেত্রকে ব্যবহার করে উপযুক্ত আলোক সম্পাতের সাহায্যে বৃহত্তর অভিঘাত সৃষ্টি করা যেত।
Previous Kaahon Theatre Review:
দ্বিতীয় অংশটি নির্বাক নয়, তবে সংলাপ ও নেই, কন্ঠ নিঃসৃত কিছু শব্দের ব্যবহার রয়েছে মাত্র, আর নাট্য ভাষায় বিমূর্ত ভাবটাও তুলনামূলক কম। এখন শাসিতদের অধীনতা সম্পূর্ণ হয়েছে, তারা সকলে একই ভাষায় কমিউনিকেট করে, কিন্তু তারই মধ্যে জন্ম নেয় ভিন্নস্বর এবং সেই ভিন্নস্বরের অধিকারীরা এটাও উপলব্ধি করে যে তারা একা নয়। এখানে কিছু সামগ্রী আগে থাকতে সরবরাহ করে রেখে দর্শকের মধ্যে ঢুকে আসার একটা চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু খুব যে বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছে তা বোধহয় বলা যায় না।
নাটকের তৃতীয় ও সর্বশেষ অংশটি অনেক দ্ব্যর্থহীন, এবং তাতে সংলাপের যথাযথ ব্যবহার রয়েছে (তিনটি অংশের মধ্যে প্রয়োগ কৌশলের ক্রমবিবর্তন লক্ষণীয়)। প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা নিশ্চিত করতে চান যে সকলে একমাত্র তাদের ভাষাতেই কথা বলুক, কিন্তু সেই ভিন্নস্বরেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও প্রতিবাদ জানায়। কাহিনীর সারল্যহেতু, ‘প্রতিষ্ঠান’ এখানে আর প্রতীকী স্কুলমাস্টারের অবয়বের গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকে না, দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে সর্বজনীন। এই অংশে ইন্টিমেট থিয়েটারের সুযোগ নিয়ে কলাকুশলীদের দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তবে দর্শককে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আরও অগ্রগতির সুযোগ রয়েছে।
নাটকের বক্তব্য যুগোপযোগী, তবে যেহেতু নাটকটি চলচ্চিত্র থেকে অভিযোজিত, তাই একটা আলোচনার জায়গা থেকেই যায়। প্রথম চলচ্চিত্রটির প্রাথমিক সারল্য নাটকে রক্ষিত হয়নি, অবশ্য সেটা কষ্টসাধ্য; অ্যানিমেশনে একটি কার্ডবোর্ডকে দর্শক যত সহজে মেষ হিসেবে মেনে নিতে পারেন, নাটকে মানুষ অভিনেতাকে মেষ হিসেবে কল্পনা করতে এক ধাপ বেশি abstraction এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটিকে নাটকে পরিবর্তনের জন্য এক্ষেত্রে কোরিয়োগ্রাফির মাধ্যমে সমান্তরাল দুনিয়া নির্মাণ করা হয়েছে। এই নির্মাণের মধ্যে রয়েছে চমৎকারিত্ব। নাটকের শুরুতে সময়-চক্রের প্রদর্শন ঠিক কী নির্দেশ করে? একি সভ্যতার ইতিহাসকে বিধৃত করতে চলেছে নাকি যুগে যুগে পুনরাবৃত্ত এক কাহিনীকে? এইরকম বহুবিধ ব্যাখ্যা রজায় গা ছেড়ে রাখা নিঃসন্দেহে নাটকটির পরিধি বাড়িয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, শব্দের সাহায্যে সময়ের অনুসঙ্গ নাটকটিতে বারে বারে ফিরে আসে। সময়ে সময়ে অস্বস্তিকর শব্দের প্রয়োগও প্রশংসার দাবি রাখে। তৃতীয় চলচ্চিত্রটি প্রায় অবিকৃত অবস্থাতেই নাটকে উঠে এসেছে – শেষ দৃশ্যটি একান্তই সিনেমাটিক ছিল, তার মোটামুটি একটা নাট্য বিকল্প ও খাড়া করা হয়েছে। তবে যে ব্যাপ্তি নিয়ে মূলনাটকটি শুরুহয়, হঠাৎ একটা প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে যাওয়াতে, কোথাও যেন একটা পূর্ণতার অভাব অনুভূত হয়।
সব মিলিয়ে একটা চমৎকার পরীক্ষামূলক প্রয়াস। একঝাঁক তরুণ তরুণীর উদ্দীপিত টিমওয়ার্ককে বাহবা দিতেই হয়। তবে নাটকে নির্মিত সমান্তরাল দুনিয়ার গ্রাহ্যতা হয়ত ইন্টিমেট স্পেসের বদলে প্রসেনিয়াম মঞ্চে বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে (হয়ত অন্যান্য কিছু কারণেও) ছোটদলের পক্ষে মঞ্চায়ন এক ভীষণ কষ্ট সাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই পরিবেশে দাঁড়িয়ে হাতের কাছে যা উপকরণ আছে তাই দিয়েই যতটা সম্ভব নিজ বক্তব্য প্রকাশ জরুরী। সেদিক থেকে নাটকটি সঠিক দিশাতেই এগিয়েছে বলে মনে হয়।
ভবিষ্যতে ‘ভীমরতি’র কাছ থেকে আরও উন্নত মানের স্বতন্ত্র প্রযোজনার আশা রইল।